আত্মহননের ঠিকানা জাপানের আওকিগাহারা

বৃক্ষ সাগরের গহন-

আয়তনে প্রায় পঁয়ত্রিশ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এই বন । এদিক সেদিকে ঝুলন্ত মানুষের লাশ।

বনের আনাচে কালাচে গাছেদের কোলে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল।ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের ব্যবহৃত জামা-কাপড়, ব্যাগ, ঘড়ি। প্রবেশপথে  অসংখ্য পরিত্যক্ত গাড়ি।

সকলেই বনে ঘুরতে এসেছিলেন। আর ফেরা হয়নি।বন নিয়ে নিয়েছে তাঁদের; না তাঁরা সঁপে দিয়েছে নিজেদের?

কেউ বলে বৃক্ষ-সাগর। সমুদ্রের মতোই নাকি অসীম সংখ্যক গাছ রয়েছে এখানে। কেউ আবার  শয়তানের  বন তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আত্মহত্যার  বন নামেই।

sui-1

বন্যপ্রাণীদের বসবাস তেমন নেই বললেই চলে। কিছু সরীসৃপ আর পোকামাকড় হয়ত  রয়েছে। তাই  পরিবেশ  একটু বেশিই নির্জন বলা চলে।

সূর্যের আপন দেশেও সূর্যের আলো ভাগে পায়না এই বনের গাছপালা

 বনের ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি অজানা এক শিহরণ হয় শরীরে। স্থানীয় প্রশাসন একটি সতর্কবার্তা লিখে রেখেছেন প্রবেশ দ্বারে।

 তোমার জীবনটি একটি মহামূল্যবান উপহার শান্ত মনে একবার হলেও ভাই, বোন, সন্তান পরিবারের অন্য সকলের কথা ভাবো

শুনতে কানে লাগছে? পড়তে জিভ জরাচ্ছে?রক্তচাপ বাড়ছে?  সত্যের তাতে বিশেষ কিছুই আসে যায় না

আওকিগাহারা- আত্মহত্যার ঘন বন।জাপানের ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরিটি চলতে চলতে একটু শান্ত হয়ে সমতলে মিশেছে। সেখানেই জন্ম নিয়েছে চিরহরিৎ বৃক্ষের এই আওকিগাহারা।

এ যেন আগ্নেয়গিরিরই আরও এক শাপমোচন

অপরূপ সুন্দরের মাঝেই ভয়ঙ্কর রহস্যঘেরা সত্যের বাস। এই অরণ্য তার যথাযোগ্য উদাহরণ। জাপানের সাধারণ মানুষ আত্মহননের পথ খুঁজে পান এই সবুজের আন্দোলনে । ইতিহাস তাই বলছে।

গত শতকের ষাটের দশক থেকে এই গল্পের পর্দা ওঠে।এই  ফরেস্টে কত লোক যে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে—তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবছর ওই বন থেকে গড়ে ১০০ টি করে আত্মহত্যা করা লোকের লাশ সরায় কর্তৃপক্ষ।

২০০২ সালে এই জঙ্গলে ৭৮ টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০-এ।  ২০০৪-এ ছাড়িয়ে গেল সেই অঙ্কও। এর পর থেকে স্থানীয় প্রশাসন মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়

বিভিন্ন জরিপের ফলাফল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে আত্মহত্যার স্থানের জনপ্রিয়তার বিচারে আওকিগাহারা ফরেস্ট রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে

sui-3

 এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ঝুলন্ত সেতু দ্য গোল্ডেন গেট ব্রিজ

সাধারণ মানুষ এই বনের পথে মুক্তির স্বাদ পেলেন কীভাবে?এর উত্তরে আবার প্রচলিত রয়েছে একটি জনশ্রুতি-

তখন ১৯৬০। জাপানে প্রকাশিত হল লেখক সেইচো মাতসুমোতোর  উপন্যাস কুরোয় কাইজু। অর্থ বৃক্ষের কৃষ্ণসাগর এক যুগল তরুন তরুনী নিজেদের প্রেমের অমরকথা লিখে রাখতে বেছে নিলেন আত্মহননের পথ।

সেই ঠিকানার নাম ছিল আওকিগাহারা

তাদের এই পরিণতিতেই বইয়ের গল্পের দাড়ি পড়ে। এই গল্পই তখন বহু মানুষকে প্ররোচনা দেয় এবং সেই অরণ্য সাগরের পথে মুখ ঘোরায়। ঠিক যেমন অই যুগল জীবনের সন্ধান পেতে সেই বন কে বেছেছিল।

এরপর আবার ১৯৯৩ সাল। আরও এক জাপানি লেখক ওয়াতারু তসুরুমুইয়ের একটি বই প্রকাশিত হল। দ্য কমপ্লিট সুইসাইড ম্যানুয়াল বিতর্কিত বইটিই সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের স্থান দখল করে। এতে আত্মহত্যার বিভিন্ন ধরণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

 এখানেও উল্লেখ মেলে আওকিগাহারার এ যেন এক সহজ পথ। ওই বনে গিয়ে সবুজের মধ্যে হারিয়ে যাও। তারপর কোনও গাছে উঠে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ো ডালে।মুক্তির নিঃশ্বাস !

বনে পড়ে থাকা বেশ কয়েকটি মৃতদেহের পাশে পাওয়া গিয়েছিল ওয়াতারুর লেখা সেই বইটি! পরে নিষিদ্ধ হয় সেটিও।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ধনধান্যে সমৃদ্ধ জাপানে আত্মহত্যার প্রবণতা খুব বেশি। প্রতিবছর সে দেশে গড়ে তিরিশ  হাজারেরও বেশি লোক আত্মহত্যা করে থাকে।

sui-4

কিংবদন্তীর শেষ এখানেই নয়।একসময় জাপান এখনকার মতো সচ্ছল  ছিল না। ছিল দুর্ভিক্ষের  দুর্ভোগ। অনাহারে মরতে হত  অনেককে।তখন ১৮৩৩

 এই অনাহার থেকে মুক্তি পেতেই পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হতো ওই বনেএ এক অদ্ভুত রীতির আকার নিয়েছিল।

 এতে করে পরিবারে খাওয়ার পেটের সংখ্যা কম হত। আর যাদের বনে রেখে আসা হতো, না খেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরণ আগলাত তারা

এইভাবেই  অনাহারে কষ্ট পেয়ে মারা যাওয়া সেসব দুর্ভাগা মানুষের অতৃপ্ত আত্মা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই বনের গহীনে। তারাই বেড়াতে যাওয়া মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে

তবে এ আত্মহত্যার প্রবণতার পিছনে আসল রহস্য কী, তা ধোঁয়াশার চাদরে আপাতত ঢাকা।

একদল গবেষকদের মতে, যত দিন যাচ্ছে, বিষণ্ণতা তত গ্রাস করছে জাপানীদের। মানুষ আরও বেশি করে একলা হচ্ছে, অসহায় হচ্ছে একটা বয়সের পরে।

sui-2

 একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, অনেক জাপানি মানুষই মনে করেন বাস্তব জীবনে যেহেতু তাঁরা একা, তাই তাঁরা ওই বনে গিয়ে আত্মহত্যা করলে অন্য মৃত আত্মাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন, মৃত্যুর পরপারে।

 প্রসঙ্গত, আজুসা হায়ানোর মতো একজন গবেষক তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে এই রহস্যের চাদর সরানোয় লেগে রয়েছেন; তবে অরণ্যের মুশকিল আসান কি এতই সুলভ!

সময় বলুক

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...