কথা বলতে গেলে গলা ভেঙে যায়। বেশিক্ষণ এক ভাবে কথা বলতে পারেন না। বারবার জল খেয়ে তবে মনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন। তাও সব কথা কি বলা যায়! বেঁচে থাকার লড়াইটা সহজ ছিল না তাঁর। তবুও জীবনে হাসতে ভোলেননি সুনন্দা সিংহ। জীবন নিয়ে সেভাবে আক্ষেপ, আফশোস বা দুঃখ করেন না। জীবন যতটুকু দিয়েছে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বীরভূমের স্বাধীনতা সংগ্রামী লালবিহারী সিংহের মেয়ে সুনন্দা সিংহ। আদ্যোপান্ত লড়াই দিয়ে গড়া এক মানুষ। লড়াইয়ের কথা সহজে বলতে চান না। সুনন্দা সিংহ বিশ্বাস করেন জীবন মসৃণ,ছায়া মাখানো গাছের মতো হয় না। জীবনে যন্ত্রণার রোদ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে কোন ঘটনা বা কিছুই যেন তাকে আদর্শের পর থেকে সরাতে না পারে। এই মন্ত্রকে মাথায় রেখেই বাঁচার চেষ্টা করেছেন সুনন্দা সিংহ।
বাবা লালবিহারী সিংহ বীরভূমের হয়ে লড়াই করেছেন। সন্ধ্যা রানী সিংহ ছিলেন স্বামীর যোগ্য স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে লড়াই করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। লালবিহারী সিংহকে বীরভূম-কেশরী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবার নিজেদের জমানো পুঁজিটুকুও দেশের ভালোর জন্য তুলে দিতেন। বীরভূমে বিপ্লবীদের সংগঠন মজবুত রাখা, বিপ্লবীদের পরিবারের মানুষের খেয়াল রাখা, কোনও সংগ্রামী গ্রেফতার হলে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের খেয়াল রাখা, এই সব কাজ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করতেন সুনন্দা সিংহের পরিবার।
এমন পরিবারের মেয়ে সুনন্দা সিংহ আদর্শকেই সঙ্গী করেছিলেন। বাবা-মায়ের আদর্শের দিকটা একেবারে যখের ধনের মত করে আগলে রেখেছিলেন। সেই কাজেই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন বাবা-মা। সুনন্দা সেসব দেখে আনন্দ পেতেন, উৎসাহিত হতেন, কাজ করার জন্য আগ্রহ বোধ করতেন। মেয়ের আগ্রহ দেখে বাবা-মাও ধীরে ধীরে নিজেদের কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন সুনন্দাকে। মায়া ঘোষ, নীহারিকা দত্তে্র মত মহিলা বিপ্লবীদের স্নেহধন্যা ছিলেন সুনন্দা।
শান্তিনিকেতনের রানী চন্দ ও তাঁর স্বামী অনিল চন্দের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল এই পরিবারের। সেবার প্রতি আগ্রহী ছিলেন বরাবর। বাবা-মা স্বাধীনতার কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে বিভিন্ন হোস্টেল ও আশ্রমে সুনন্দার জীবনের বড় অংশ কেটেছে। পাটনায় জয়প্রকাশ নারায়ণ ও তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবীর তৈরি আশ্রমেও পড়াশোনা করেছিলেন সুনন্দা সিংহ। সেবার ইচ্ছেকে ছোট্ট চারা গাছের মতোই লালন করেছিলেন নিজের ভেতরে। কৈশোর ও যৌবনের মাঝামাঝি সময়ে যখন সুনন্দার মন সমাজসেবার জন্য একেবারে প্রস্তুত তখন হয়ে যায়।
এমন সময় অসুস্থ বাবা-মায়ের ইচ্ছে রাখতেই বিয়ে করেন। রাজ্যের বাইরে থেকেছেন অনেক বছর। সংসার, পরিবারের স্বাভাবিক নিয়মে আসে সন্তান। স্বামী, সন্তান, সংসারকে সঙ্গী করে জীবন-তরী ভেসে চলছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান আসে। মেয়েদের মানুষ করা, তাদের পড়াশোনার বিষয়ে খেয়াল রাখা, অন্যান্য সংসারের কাজ করা এর মধ্যেই গতানুগতিকভাবে সুনন্দার জীবন কাটত। এমন সময় সুযোগ আসে মানবসেবার।
এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হন সুনন্দা। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেশের জন্য মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করার পথে একটু একটু করে এগিয়ে চলেন। মূলত মেয়েদের জীবনের অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে কাজ করেন সুনন্দা। যেসব মেয়েরা পরিবার বিতাড়িত, আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জন্যে কাজ করেন সুনন্দা। মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো,পড়াশোনা শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর মত কাজকেই জীবনের ব্রত হিসেবে দেখেছেন সুনন্দা। নিজের জীবনের লড়াই শুরু হয় এখানেই। স্বামী কিছুতেই দেশসেবামূলক কাজে দেখতে চান না তাঁর স্ত্রীকে। এর মধ্যে বাবাকে হারান সুনন্দা। দেশসেবার কাজে আরো বেশি করে নিজেকে নিংড়ে দিতে থাকেন সুনন্দা সিংহ।
এমন সময় বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয় সুনন্দাকে। সঙ্গে দুই সন্তান। বাপের বাড়ি বা স্বামীর তরফ কারোর থেকেই আর্থিক সাহায্য নিতে রাজি ছিলেন না তিনি। ছকভাঙ্গা সিদ্ধান্ত নেন দুই সন্তানের মা সুনন্দা সিংহ। ফের পড়াশোনা শুরু করেন। পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো। সন্তানদের প্রতি মনোযোগেও ঘাটতি হতে দেননি। দীর্ঘদিন এমন অসম লড়াই করেছেন। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর তরে স্তরের পড়াশোনা শেষ করেছেন। ছেলে-মেয়েদের বড় করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজও করেছেন।
তবে এই দীর্ঘ লড়াই পথে দেশ সেবার ইচ্ছে, দেশের প্রতি ভালোবাসা কখনও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত। আর্থিক অবস্থা আগের থেকে অনেকটা ভালো। তবে মানুষের সেবার ক্ষেত্রে আজও একইভাবে এগিয়ে আসেন এই দৃঢ়চেতা নারী।