বয়স তিরিশের ওপর। ছোটখাটো চেহারা। শান্ত। দেখে মনে হয় না এই মেয়ে খুব সহজে ছক ভাঙতে পারে। চেহারার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। ছোটবেলা থেকেই অনিতা দাসের ইচ্ছে ছিল জীবনে ছক ভাঙা কাজ করবেন। পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন। প্রথাগত চাকরির পথে যাননি। বাড়ির লোক আপত্তি করেছিল। পড়াশোনায় সাধারণ, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে চাকরি না করে অন্যরকম কিছু কাজ করবে কেন? বাড়ির লোকের কথায় সেই ভাবে পাত্তা দিলে হয়তো ছকভাঙা হয়ে উঠতো না অনিতা দাসের।
প্রথাগত চাকরির পথে না গিয়ে সমাজসেবাকে নিজের কাজ হিসেবে বেছে নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। বিভিন্ন বেসরকারি এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে মেয়েদের জন্য কাজ করতে থাকেন। এইচ আই ভি বা এইডস আক্রান্ত মেয়েদের জন্য লড়াই করেছেন তিনি। এখনো এইডস আক্রান্ত হলে সমাজ ভালো চোখে দেখে না। এমনকী রোগ সেরে গেলেও পরিবার ফিরিয়ে নেয় না। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তাদের হারাতে হয় আপনজনেরও। এমন মেয়েদের হয়েই কাজ করেন অনিতা। এই সমস্ত মেয়েদের চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে।
এই ছাড়াও অন্যান্য যৌন রোগের ক্ষেত্রেও আমাদের সমাজে রয়েছে নানা কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। এইসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয় মেয়েদের। অনিতা লড়াই করেন তাঁদের জন্যেও।
এইসব কাজ করতে করতেই আলাপ হয় সায়ন দাসের সঙ্গে। ভালোবেসে যখন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় আবার ছক ভাঙার চেষ্টা করেন অনিতা। দুজনের সম্মতিক্রমে ঠিক করেন তারা কখনোই বায়োলজিক্যালি বাবা-মা হবেন না। তবে সন্তানসুখ আসবে। তা আসবে দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে পূর্ণসম্মতিতে তাঁরা কন্যা সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন। সেই কন্যা সন্তান দত্তক নেওয়ার পথ কিন্তু খুব একটা সহজ ছিল না।
আইনি প্রক্রিয়া মেনে যখন দত্তক নেওয়ার জন্য আবেদন করেন তখন নানা প্রশ্নের সম্মুখে পড়তে হয়। স্বামী ছাড়া বাকি পরিবারের মানুষরাও তেমন ভাবে পাশে ছিলেন না। তবুও নিজের পথ থেকে সরে আসেননি
অনিতা। তবে দত্তক নিতে গেলে প্রয়োজন হয় দত্তক যিনি নিচ্ছেন তার অঞ্চলের থানার একটি বিশেষ ভেরিফিকেশন। সেই ভেরিফিকেশন পাওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সারারাত জেগে থানায় বসে ছিলেন সঠিক পথে লড়াই করার জন্য। ভেরিফিকেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ ছিল পুলিশের। সেই সন্দেহ মেটানোর জন্য অনিতা নিজের সমস্ত কাজ ফেলে সারাদিন থানায় বসেছিলেন। অনিতার জেদ দেখে অবশেষে সেই ভেরিফিকেশন কাগজে সই করেন পুলিশ অফিসার।
সেদিন রাতেই ট্রেন ধরে সেই কাগজ নিয়ে অনিতা পাড়ি দিয়েছিলেন দিল্লী। ফিরে এসেছিলেন ছোট্ট কন্যা সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে। অনিতার বেঁচে থাকার অন্যতম আলো সেই কন্যা সন্তান। তবে অনিতা শুধু নিজেই এরকম আলো মাখা কাজ করেন না তিনি অন্য মেয়েদেরও আলো দেখান নানাভাবে। অনিতা দাসের বেঁচে থাকার উপজীব্য আজও মানুষের সেবা আর ভালোবাসায় সকলকে জড়িয়ে নেওয়া।