মায়ের সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ করতেন, আজ সেই ছেলে কমনওয়েলথে সোনাজয়ী

২০২২ বার্মিংহাম কমনওয়েলথে ভারতের তৃতীয় সোনার পদক এল পাঁচলার অচিন্ত্য শিউলির হাত ধরে। তৃতীয় দিনের প্রায় শেষ পর্বে পুরুষদের ৭৩ কেজি বিভাগে সোনা জিতলেন অচিন্ত্য।

হাওড়া জেলার দেউলপুর গ্রামের ২০ বছর বয়সী এই যুবক দু'বার স্ন্যাচ এবং ক্লিন অ্যান্ড জার্ক উভয় ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ ভারোত্তোলন করেন। তিনি যথাক্রমে ১৪৩ কেজি ও ১৭০ কেজি।  ৩১৩ কেজি লিফ্ট নিয়ে নিজের একটা স্মরণীয় অভিষেক  করলেন তিনি। অচিন্ত্যতার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, মালয়েশিয়ার এরি হিদায়াত মহম্মদকে পরাজিত করেন। মহম্মদ মোট ৩০৩ কেজি ভারোত্তোলন সক্ষম হন।

অচিন্ত্য শিউলি একজন জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পদক বিজয়ী, এবং জাতীয় রেকর্ডধারী। কলকাতা থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে দেউলপুরে একটি জরাজীর্ণ ইটের কাঠামো বুনো ঝোপঝাড় এবং বৃদ্ধ গাছের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।  এবড়োখেবড়ো বাড়ির দাওয়া।  ওজনের প্লেটগুলি মরচে ধরা।  ছেঁড়া কাপড় ছাদে বাঁধা হয়েছে রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য। এতক্ষণ যে আস্তানার বিবরণ পড়ছিলেন, তা আসলে একটা জিম, এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে অচিন্ত্য। তাঁর ছোটবেলার কোচ অষ্টম দাস, যিনি ঐ অস্থায়ী জিম চালান তার কথায়, "আমি যখন অচিন্ত্যকে প্রথম দেখেছিলাম, তখন সে খুব পাতলা ছিল এবং মোটেও ভারোত্তোলকের চেহারা ছিল না, কিন্তু তার গতি ছিল যা যে কোন খেলায় একজন অ্যাথলিটের জন্য খুবই  গুরুত্বপূর্ণ।"

FotoJet - 2022-08-01T151811.970

পরিবারের খুব সীমিত সম্পদ থাকায় অষ্টমবাবু এগিয়ে আসেন। অচিন্ত্যকে গিয়ার তোলার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে সহায়তা করেন। যদিও শেষ কয়েক বছরে হাতে গোনা ৩০দিন হয়তো এখানে সময় কাটান অচিন্ত্য, কিন্তু তাঁর মা পূর্ণিমা দেবী মনে করিয়ে দেন শুরুর রাস্তাটা।

অচিন্ত্য তাঁর দাদা অলোক শিউলিকে এই পদক উৎসর্গ করেছেন। বার্মিংহামের জানিয়েছেন "আমি এই স্বর্ণপদকটি আমার ভাইকে উৎসর্গ করছি"। তিনি চান বিশ্ব জানুক তার ভাই ছাড়া সোনার পদক হত না। দুই ভাইয়ের মধ্যে অলোকই ভারোত্তোলন করতেন একসময়। প্রায় এক দশক আগে, অচিন্ত্যতার বড় ভাই অলোকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রথমবারের মতো এলাকার ঐ জিমে যান।

দাদা অলোক শিউলির কথায়, “২০১৩ সালে যখন আমরা জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন আমাদের বাবা মারা যান এবং আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়।  তখন আমি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ছিলাম। পরিবারের রুজি রুটির টান পরে। উপার্জনকারী হওয়ার দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়েছিল, তাই আমাকে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল।"

পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত ছিল। অলোক তখন ২০। সে জানত যে বড় ভাই হিসাবে তার আরও বড় দায়িত্ব। অলোক নিজেও যথেষ্ট প্রতিভাবান। রাজ্য স্তরে সোনা পেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপ, বাড়ির টালমাটাল অবস্থা সামাল দিতে সরে আসেন খেলার জগৎ থেকে। কাজ নেন হাওড়ার এক মিলে।

এটা কল্পনা করা কঠিন যে বার্মিংহামে ভারতকে তৃতীয় ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক এনে দেওয়ার জন্য লোহার ওজনের সঙ্গে উত্তোলনকারী হাতগুলি একবার মহিলাদের সালোয়ারে সূচের কাজ করত একদিন। সূচ-সুতো-জরির সূক্ষ টানে ফুল-লতা ফুটে উঠত পোশাকে। করেছিল। অচিন্ত্যকে সেটাই করতে হয়েছে। তার কমনওয়েলথে সোনা,  ভারোত্তোলন কেরিয়ার  সেই সুতোর টানেই সাড়া ফেলেছে আজ।

একজন পেশায় রিকশাচালক এবং একজন শ্রমিক।  তাদের সেই যৌথ আয় পরিবারের চার সদস্যের ভরণপোষন,  অলোকের ডায়েট, প্রোটিন এবং সরঞ্জামের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে যথেষ্ট ছিল না। মা পূর্ণিমা শিউলি, স্বামীর মৃত্যুর পর সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। অলোক স্থানীয় একটি জিমে প্রশিক্ষক হিসাবে যোগ দেন।

অচিন্ত্য মাকে তার সূচের কাজ এবং অর্ডার সরবরাহ করতে সাহায্য করতেন। ভাইয়ের সঙ্গে রোজকার ওয়ার্কআউট সেশনের জন্য জিমে যেতেন। দাদা ভাইয়ের মধ্যে আগুন দেখেছিলেন। তাই জিমের মেম্বার করে নেন। তাঁর অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর সঙ্গে যেন পরিচয় করান অচিন্ত্যের।

শুধু সেলাইয়ের কাজ নয়, দিন গুজরানের জন্য কোনও কাজকেই ছোট করে দেখেননি তাঁরা। অলোকের কথায়,  "কোনও কাজ আমাদের জন্য খুব ছোট ছিল না। অচিন্ত্য আর আমি মাঠে কাজ করতাম, আমরা ফসল কেটেছি, মাথায় বোঝা বয়েছি।  আমরা সবসময় টাকার জন্য নয়। আমরা এক সময় এক সপ্তাহের জন্য একটি মাঠে কাজ করেছি, কারণ কাজ শেষে এক কেজির একটা মুরগি দেওয়া হত।"

অচিন্ত্য এখন ভারতীয় সেনাবাহিনিতে হাবিলদার পদে কর্মরত। তাঁর সোনা জয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনি। 

শ্রমিক পরিবার থেকে উঠে আসা অচিন্তর এই পদক জয়ের কাহিনী একটা যেন স্বপ্নের জাগরণ। এখনও এই ক্রিকেট সর্বস্য দেশে ছোট ছোট প্রদীপের আলো জ্বলে। সেই আলোয় বাঁচতে চায় স্বপ্ন। পেটে খিদের জ্বালা আর চোখে স্থির লক্ষ্য এনে দেয় সম্মান। 

মীরাবাই চানু (মহিলাদের ৪৯ কেজি) দ্বিতীয় দিনে ভারতের হয়ে প্রথম সোনা এনে দিয়েছিলেন। গতকাল বেলায় তার আরেক সহকর্মী সতীর্থ এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু, জেরেমি লালরিনুঙ্গা (পুরুষদের ৬৭ কেজি) ভারোত্তোলনের বিভাগে দেশের দ্বিতীয় সোনা এনে দেন। আর শেষ মুহুর্তে পুরুষদের ৭৩ কেজি বিভাগে অচিন্ত্যশিউলির সোনা দিয়ে, ভারতীয় ভারোত্তোলন দল গেমসের ষষ্ঠ পদক জিতেছে। এখনও পর্যন্ত ভারতের সংগ্রহ ৩টি সোনা, ২টি রূপ এবং ১টি ব্রোঞ্চ। সবকটি এসেছে ভারোত্তোলনে। ভারতকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন ভারোত্তোলনকারীরা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...