ক্রিকেট কেবল ধনী লোকের ছেলে মেয়েরাই খেলে। বহু মানুষের তাই মনে কোথাও একটা সংকোচ থাকত ক্রিকেট নিয়ে। পরবর্তীকালে সেই ভুল ভেঙেছিল যখন মানুষ দেখেছিল মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ডাল-ভাত-রুটি খেয়েও লক্ষ্মীরতন শুক্লার মত ক্রিকেটাররা দেশের হয়ে খেলেছিল।
সালকিয়ার বিট্টু। ছেলেটার নাম বললে যতটা না আসবে বঙ্গ দলের হয়ে প্রভূত সফলতা, তার চেয়ে বেশী হয়তো কুরে কুরে খাবে মাত্র ১৮ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। এখন চোট পেয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে হরদম, ক্রীড়াক্ষেত্রে এটাকে নিতান্তই 'প্লেয়ার্স কাপ অফ টি' বলাই প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে ঘটনাটি পুরো আলাদা।
১৬ বছর বয়সে ছেলেটা রাজ্যের অনুর্ধ-১৯ স্তরে খেলতে গিয়েছিল। ওড়িশার বিরুদ্ধে বল হাতে নেন ৫ উইকেট এবং ব্যাট হাতে করেন ৫৬। দেবাশীষ মহান্তিকে মারা টেনিস শট তোঃ হুলুস্থল ফেলে দিল বঙ্গ ক্রিকেটে। ঠিক সেই মরসুমেই ঘটে যায় বাংলার হয়ে অভিষেক। অভিষেকে মহারাষ্ট্রর বিরুদ্ধে ১৭ রান এবং ২/২৬। এরপর পাকিস্তান এ দলের বিরুদ্ধে ভারতীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে প্রথম ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৬ উইকেট যার মধ্যে ওয়াজাতুল্লাহ ওয়াস্তি, ইউসুফ ইউহানা পরাস্ত হলেন দুবার, ইনজামাম উল হক একবার। এবং দ্বিতীয় ম্যাচে দুটি ইনিংস থেকে চার উইকেট। এছাড়া উইলস ট্রফির সেমিফাইনাল ম্যাচে বল হাতে ৪ উইকেট এবং ১৩৬ রান করেন সঙ্গে নিখিল হলদিপুরে সঙ্গে ২১২ রানের পার্টনারশীপ। ফাইনালেও ছিল ৪ উইকেট।
আন্তর্জাতিক স্তরের রেকর্ড বলছে ব্যাট হাতে ৩ ম্যাচে ১৯ রান এবং ১টি উইকেট। আদতে সত্যি কথা যে নিজের সর্বোচ্চ ১৩ রানের ইনিংসটি লক্ষ্মী যেদিন আন্তর্জাতিক স্তরে খেলেন সেদিন দু-অঙ্কের রান পেরিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়, বিনোদ কাম্বলি এবং রবিন সিং এবং বল হাতে উইকেট নেন জিমি আদামসের। জীবনের প্রথম তিন আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে দুটি ম্যাচে তিনি অলরাউন্ডার হিসেবে শুরু করেও ওপেনিং বোলার! এরপরে ইলেক্ট্রনিক স্কোরবোর্ডে নাম ওঠার পরেও আশিস নেহরার অন্তর্ভুক্তির টেস্ট কেরিয়ার শুরুর অন্তরায় হওয়ার ঘটনা তো প্রায় সর্বজনবিদিত।
তার পরে ১৭ বছর কাটিয়েছেন বঙ্গ ক্রিকেটে। ১৩৭ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে করেছেন ৬২১৭ রান, নিয়েছেন ১৭২ উইকেট। ঋদ্ধিমান সাহার সঙ্গে ৪১৭ রানের পার্টনারশীপ আজও বাংলার ক্রিকেটে সর্বোচ্চ, তার ২৫০ তো বাংলার কোনও সাত নম্বর ব্যাটের সর্বোচ্চ রান। বাংলা ২০১২ সালে জিতল বিজয় হাজারে। লক্ষ্মী করলেন ৫৮.২০ গড়ে ২৯১ রান,২৪.৩৬ গড় এবং ৪.৫৯ ইকোনোমিতে নিলেন ১১ উইকেট। এক কথায় দুরন্ত।
‘আউট হ্যায়, ইয়ে মা কসম আউট হ্যায়’ কথায় চরম ক্রিকেট নিবেদিত প্রাণ ছেলেটির কেরিয়ার শেষ হয় নিতান্তই অনাড়ম্বরভাবে। হেডলাইন হয় ‘দা স্পার্ক দ্যাট নেভার গট ইগ্নিটেড’। তবুও তো বাংলা একইভাবে ভালোবাসা দেয় তাদের ‘লক্ষ্মীদা’কে।
প্রথম কোনও ক্রিকেটার ১০০তম রঞ্জি খেলেছেন সেটা লক্ষ্মীরতন শুক্লা। হনুমান জুট মিল স্কুলের ছাত্র ছিলেন। লড়াকু মানসিকতা। হাওড়ার ঘুসুড়ির গলি থেকে লক্ষ্মীরতন শুক্লা তাঁর 'জার্নি' শুরু করেছিলেন ১৫ বছর আগে৷ ৫ মার্চ ১৯৯৮, ১৭ বছর বয়সে রঞ্জি অভিষেক হয়েছিল মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে৷ বাংলার মানুষ অবশ্য সেই সময় মজে বেহালাবাসী এক ক্রিকেটারে৷ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তখন দাপিয়ে খেলছেন ভারতীয় দলে৷ সেই সময় অলক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল বাংলার অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারের ক্রিকেটজীবন৷ নজরে পড়তে অবশ্য খুব দেরি হয়নি৷ পরের বছরই ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় ওয়ান ডে টিমে৷ তিনটে একদিনের ম্যাচে খুব ভালো পারফর্ম করতে না পারায় সেখানেই ইতি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে৷ সেখান থেকে হারিয়ে যাওয়া নয়, ধীরে ধীরে লক্ষ্মী নিজেকে তৈরি করেন দলের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে৷ দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে কম বাংলার ক্রিকেটে কম ওঠা-নামা দেখেননি৷ বিজয় হাজারে ট্রফিতে দলকে চ্যাম্পিয়ন করানো যেমন আছে, তেমনই আছে কপিল দেবের আইসিএল-এর খুব কাছাকাছি চলে যাওয়ার ঘটনাও৷
দেখতে দেখতে ৩০টা বছর চলে গিয়েছে আজও একই মানসিকতার। বর্তমানে বাংলার অনুর্দ্ধ ২৩ দলের কোচ হয়ে কাজ করছেন লক্ষ্মী । ছাত্রদের পরামর্শ দিয়েছেন কাঁচা ছোলাবাদাম এবং ছাতু খেতে। ছেলেদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর জন্য শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছেন তিনি।
বাংলার ক্রিকেট প্রেমী মানুষ আজও তাঁকে মনে রেখেছেন তাঁর লড়াকু মানসিকতার জন্য। প্রায় ১০০ টার উপর বাংলার হয়ে রনজি ম্যাচ খেলেছেন লক্ষ্মী , শুধু তাই নয় দেশের হয়েও খেলেছেন। তাঁর দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনের অভিজ্ঞতা বাংলার আগামী প্রজন্মের অনেক কাজে লাগবে। হাওড়ায় নিজের ক্রিকেট এ্যাকাডেমিতে এতদিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোচিং করাতেন লক্ষ্মী| এই প্রথমবার রাজ্যস্তরে কোচিং করাচ্ছেন তিনি। আগামীদিনে বাংলার সিনিয়ার দলের কোচ হিসাবেও হয়তো তাঁকে অবশ্যই দেখা যাবে।