ঋদ্ধি: এক বাঙালি সুপারম্যান

একজন ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকের ঋদ্ধি সম্পর্কে কী মতামত? অনেকেই বলেন 'উইকেটরক্ষক নি:সন্দেহে দারুণ। কিন্তু ব্যাটসম্যান? চলে না মশাই।’ ধারণা ভাঙতে গেলে কখনো ফিরতে হবে ৬ বছর আগের আইপিএল ম্যাচে বা ৩ বছর আগের অস্ট্রেলিয়া টেস্টে। যেতে পারেন গত মৌসুমের রঞ্জি ফাইনালেও।

 

ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া, তৃতীয় টেস্ট, ২০১৭

অস্ট্রেলিয়ার ৪৫১ রান তাড়া করতে নেমে ভালো শুরু করেও দ্রুত করুন নায়ার এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন এর উইকেট ভারতকে ৩২৮-৬ স্কোরে ইনিংসে পিছিয়ে যাওয়ার ভ্রূকুটি দেখাচ্ছে সদ্য। ক্রিজে সেট হয়ে থাকা চেতেশ্বর পুজারার সঙ্গে ব্যাট করতে এলেন বাংলার ঋদ্ধি। শুরু খুব ধীরে। প্রথম বারো বল খেলার পরে স্টিভ ও’কিফকে মারা একটি শট দিল প্রথম বাউন্ডারি। এরপরে ধ্রুপদী ঢঙে চলল ব্যাটিং।

কখনো প্যাট কাম্মিন্সকে কভার দিয়ে মারা চার আবার কখনো নাথান লায়নকে কাউ-কর্নার দিয়ে মারা লফ্টেড ছক্কা তাকে পৌঁছে দিলো কাঙ্খিত অর্ধশতকে। তাও মাত্র ১০০ বলে। পরের হাফ সেঞ্চুরি এল ১০৬ বলে। অর্থাৎ সেঞ্চুরি ২০৬ বলে। অপরদিকে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফিরে গিয়েছেন সৌরাষ্ট্রর ব্যাটসম্যান। অত:পর ও’কিফকে ইনসাইড-আউট করতে গিয়ে যখন ক্যাচ উঠে ফেরত গেলেন ঋদ্ধি, তখন পুজারার সঙ্গে তার ১৯৯ পার্টনারশিপ এবং স্কোরবোর্ডে ৯০ রানের লিড বিরাট কোহলির মুখে চওড়া হাসি এনে দিতে প্রচণ্ডভাবে সফল।

 

WriddhimanSaha1

 

রঞ্জি ফাইনাল, বাংলা বনাম সৌরাষ্ট্র, ২০২০

সৌরাষ্ট্র স্কোরবোর্ডে তুলেছে ৪২৫। ব্যাট করতে নেমে বাংলা হারিয়েছে সুদীপ ঘরামী এবং অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরনকে। বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান সুদীপ চ্যাটার্জীর সাথে চা-পরবর্তী সেশন সামলে দিয়েছেন মনোজ তিওয়ারি (৩৫)। মনোজ আউট হতেই আবার ব্যাট হাতে নামলেন শিলিগুড়ির পাপালি। প্রথমদিকে একটু ছন্দের অভাব ছিল। বেশ অসুবিধায় ফেললেন রাউন্ড দ্য উইকেট বল করা চেতন সাকারিয়া এবং জয়দেব উনাদকাত।

সাকারিয়ার একটি বল রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেন ঋদ্ধি। চতুর্থ দিন থাকল না কোনও জড়তা। স্ট্রেইট-ব্যাটে খেলতে লাগলেন ঋদ্ধি। উনাদকাত-সাকারিয়া-প্রেরক মানকর-ধর্মেন্দ্র সিং জাদেজা কেউ লুজ বল দিয়ে পার পেলেন না। ধীরে ধীরে হাফ সেঞ্চুরি এবং ইনিংস শেষ হওয়ার মুহূর্তে তার নামের পাশে থাকল ১৮৪ বলে ৬৪। আরো গুরুত্বপূর্ণ দিনের শুরুর সুইং সামলে দুটো সেশন খেলে দিলেন সুদীপের সঙ্গে।

 

WriddhimanSaha2

 

আইপিএল ফাইনালে ১০০ রান করা একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার তিনি। ইডেন টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ কিন্তু ক্যাচ বা স্ট্যাম্পিং এর জন্য আসেনি, এসেছে দুই ইনিংসে দুটি হাফ সেঞ্চুরির জন্য। এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কঠিন সময়ে শতরান আছে, ওটা না হয় ছেড়ে দিলাম দুর্বল দল বলে। রঞ্জি ডেব্যুতে হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে ১১১, এছাড়াও অন্য ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসে রয়েছে ৯৭, প্রথম শ্রেণীর খেলায় সেঞ্চুরি মোট ১৩টি। রয়েছে ডাবল সেঞ্চুরিও। সাফল্যের তুলনায় ব্যার্থতা বেশি আছে, ৩৭ টেস্টে ৩০ গড়, প্রথম শ্রেণীর খেলায় ৪৩ গড় এবং লিস্ট ‘এ’ খেলায় ৪২ গড় থাকা ব্যাটসম্যান খারাপ হতে পারেন না, খারাপ কোনও দিন নন। সমস্যা শুধুই এক্স ফ্যাক্টরে। ডাকাবুকো নন।

 

WriddhimanSaha3

 

শিলিগুড়ি শহরের এক নিভৃতচারী তরুণ একমনে বুনে যাচ্ছিল স্বপ্ন। স্বপ্নটা ভারতীয় দলে খেলার। নিবিড় অনুশীলনে ঘাম ঝরিয়েও সাহস হচ্ছিল না সেটা মুখ ফুটে বলার। মহেন্দ্র সিং ধোনির জায়গায় ভারতের উইকেটকিপার হওয়ার স্বপ্নটাও যে তামাশার মতো শোনায়! সেই তরুণ ঋদ্ধিমান সাহার স্বপ্ন অবশ্য ব্যর্থ হয়নি। ইডেন গার্ডেনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ফিফটির পাশাপাশি অসাধারণ কিপিং করে বাঙালি হিসেবে গড়েছেন দারুণ এক কীর্তি। যা পারেননি খোদ সৌরভ গাঙ্গুলীও। প্রথম বাঙালি হিসেবে ইডেন গার্ডেনে হয়েছেন টেস্টে ম্যাচ সেরা।

 

ঋদ্ধিমান সাহা ও স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। দুজনের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছেন? ঠিক ধরেছেন। দুজনই জন্মেছেন ‘অন্যদের সময়ে’।’ ম্যাকগিলের ক্ষেত্রে যেমন দলে ঢোকার বাধা ছিলেন শেন ওয়ার্ন তেমনি ঋদ্ধিমানের জন্যও মহেন্দ্র সিং ধোনি। ব্যাটিং নিয়ে দুজনের তুলনা চলে না। তবে তাঁদের আসল যে কাজ - কিপিং, সেখানে যথেষ্টই উজ্জ্বল ঋদ্ধিমান। মূলত ধোনি চোট-টোট পেলেই দলে ডাক পড়ত ঋদ্ধিমানের। লাল বলের ক্রিকেট থেকে ধোনির অবসরের পর জায়গাটা ভালোই পোক্ত করেছেন বাংলার এই তরুণ। সেন্ট লুসিয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পেয়েছেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। তবে সামর্থ্যের দারুণ নিদর্শন দেখিয়েছেন ইডেনে। হিমালয়ের কোলে বেড়ে ওঠা অখ্যাত তরুণটিকে চট করে আলাদা করা গেছে অন্যদের ভীড়ে।

 

WriddhimanSaha4

 

৮২ বছর ধরে টেস্ট খেলা হচ্ছে ইডেন গার্ডেনে। এ পর্যন্ত সেখানে অনুষ্ঠিত ৪০টি খেলায় ম্যাচসেরা হয়ে দর্শকের অভিবাদন কুড়িয়েছেন অনেক কীর্তিমান ক্রিকেটার। কিন্তু এ পর্যন্ত সে কীর্তি ছোঁয়া হয়নি কোনও বাঙালির। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সৌরভ গাঙ্গুলী সেঞ্চুরি করেছিলেন ইডেনে। কিন্তু ওয়াসিম জাফরের ডাবল সেঞ্চুরিতে ম্লান হয়ে গিয়েছিল তাঁর ১০২ রানের ইনিংস। ম্যাচসেরাও হন জাফর। তবে এবার আর তেমন কিছু হয়নি। দুই ইনিংসে অপরাজিত ফিফটি করে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন ঋদ্ধিমান। পশ্চিম বাংলাজুড়েও ছড়িয়ে দিয়েছেন উচ্ছ্বাস। কাছের মানুষরা তাকে তাঁকে চেনেন পাপালি বলে। নিভৃতচারী এই তরুণ পছন্দ করেন প্রচারের আলোর বাইরে থাকতে। সেটাই ভালো। নিজের কাজটা ঠিকঠাক করেন। সেটাই তো আসল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...