১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বেশিরভাগ যুদ্ধ পায়রাই আহত। কর্ম-ক্ষমতা হারিয়েছে। মাত্র কয়েকজন সুস্থ ছিল। কিন্তু যুদ্ধ মানেই জীবন-মৃত্যুর লড়াই। মৃত্যুর মধ্যে থেকেও জীবন খুঁজে নেওয়ার এক-চিলতে চেষ্টা। আর সেই চেষ্টায় বিশেষ ভূমিকা ছিল এই উড়ুক্কু যুদ্ধবাজদের।
ইংল্যান্ডের সৈন্যবাহিনীরা তাই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল কিছু পায়রা, যাদের তাঁরা প্রশিক্ষণ দিয়ে জীবনের সংকেত বয়ে নিয়ে আসার জন্য তৈরি করবে।
তখন তাঁরা খোঁজ পেল ইংল্যান্ডের একজন জুতো-বিক্রেতার। চার্লি ব্রিউয়ার। যাঁর কাছে আছে একটা বুদ্ধিমান, সাহসী পায়রা। নাম 'মেরি'।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের প্রিয় পোষ্যকে চার্লি তুলে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সেনাদের হাতে। মানুষকে বাঁচানোর গুরু-দায়িত্ব পালনের জন্য।
খুব কম সময়ের মধ্যেই মেরি প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধের বার্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে নেমে পড়েছিল। কিন্তু ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বারবার আহত হয়েছিল সে।
প্রথমবার সে যখন আহত হয়, সেই সময় তার চারপাশে প্রবল বোমা বর্ষণ চলছিল। প্রচন্ড আঘাত লেগেছিল পাখিটির ছোট্ট শরীরে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইংল্যান্ডের সামরিক হাসপাতালে। বাইশটা সেলাই হয়েছিল।
সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা একপ্রকার ধরেই নিয়েছিল, মেরিকে আর যুদ্ধের কোনো কাজে পাঠানো যাবে না।
কিন্তু এই ক্ষুদে পাখি যেন বর-প্রাপ্ত ছিল। দু'সপ্তাহের মধ্যেই সারিয়ে ফেলল তার ক্ষত। আবার নেমে পড়ল যুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দিতে।
মেরির জীবনকাল ছিল খুবই অল্প সময়ের। ১৯৪০ সালে জন্ম। ১৯৪৫ সালে বয়সজনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে মৃত্যু হয় তার।
এই পাঁচ বছরের জীবনকালে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকটি আঘাত সে সহ্য করেছে। প্রত্যেকবারই মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জীবনকে ফিরিয়ে এনেছে।
মেরীর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। নিজের ক্ষত সারানোর ক্ষমতা। যাকে বলে ‘সেল্ফ-হিলিং’ পাওয়ার। ঠিক দু'সপ্তাহ সময় লাগতো তার সেরে উঠতে।
ক্ষত যতই গভীর হোক, দু'সপ্তাহের মধ্যে তা সারিয়ে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের সংকেত বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে নেমে পড়ত মেরি। মাঝে মাঝে সেনারা আশ্চর্য হয়ে ভাবতেন এটা মনোবল নাকি শারীরিক ক্ষমতা, যা একটা ছোট্ট পাখিকে বারবার মৃত্যুর কাছ থেকে জীবনের প্রান্তে ফিরিয়ে দিত। আর তার মাধ্যমেই হত জীবনের উদযাপন।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মারা যায় মেরি। মৃত্যুর পরে মেরিকে সাহসিকতার জন্য বিশেষ সাম্মানিক মেডেল দেওয়া হয়েছিল। সেই মেডেল তুলে দেওয়া হয়েছিল মেরির মালিক চার্লি ব্রিউয়ারের হাতে। চার্লির দোকানে সযত্নে জ্বলজ্বল করত সেই মেডেল।
মেরির দেহাবশেষও বিশেষভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছিল।
সাতটি পর্বে আমরা কিছু সাহসী পাখিদের কথা জানলাম। এছাড়াও এমন অনেক অনামী যুদ্ধ-পাখিও আছে। তাদের জীবন অনুপ্রেরণা দেয়। যুদ্ধের অন্ধকারে ঝিলমিলিয়ে ওঠে এই সব পাখিদের আত্মত্যাগের কাহিনী। কখনো কখনো পশুপাখিদের উপস্থিতি মানুষের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।
কিন্তু এই অবলা প্রাণীরা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করে গেছে। অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে জীবন। চিয়ার এমি, দি মোকার, স্পাইক, কাইজার, জি আই জো, প্রেসিডেন্ট উইলসন এবং মেরির মত পাখিরা এক চিলতে আলোরই দৃষ্টান্ত।