আজ কালী কথায় ভিড়িঙ্গী কালীবাড়ির কথা। এই কালী বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেড় শতকের ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগের কথা, ভিড়িঙ্গীর কুমোরবাঁধ শ্মশানে নাগা সন্ন্যাসী তুলসীদাস গৌঁসাই নির্দেশিত পথে তান্ত্রসিদ্ধ সাধক অক্ষয় কুমার রায় ১২৫৯ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসের মহানিশায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে জগতের কল্যাণ কামনায় জগৎ জননী মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৫২ সালে। তালপাতার ঘরে গৃহে মা কালিকা এলেন। ভক্তের প্রার্থনায়, আর্তিতে সাড়া দিয়ে নীলাম্বরী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। উপেন এবং ব্রজ সূত্রধরের হাতের ছোঁয়ায় শিল্প দক্ষতায় মাতৃ মূর্তি হয়ে উঠেছে আকর্ষনীয়া। আয়ত নয়ন, মাথায় মুকুট পরিহিতা দেবীর ডানচরণ রয়েছে শিবের বক্ষদেশের উপর।
এই কালী মন্দিরে সাধনার পূর্ণক্ষেত্র। বহু সাধুসন্ন্যাসী, যোগী, গুপ্ত যোগী, গৃহী এখানে এসেছেন, থেকেছেন আবার এই মন্দির প্রাঙ্গণেই পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছেন। প্রতিদিন ভক্তেরা দূর-দূরান্ত থেকে এই জাগ্রতা শ্মশানকালী মাকে দর্শন করতে আসেন। অক্ষয় যে কুমারবাঁধের শ্মশানভূমিতে শ্যামা মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ঢাক ঢোল কাঁসর ঘণ্টাধ্বনি সহকারে মায়ের পুজোর আয়োজন করেছেন; সেই সংবাদ অল্প কিছু দিনের মধ্যেই গ্রাম থেকে গ্রামে লোকমুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কেবল ভিড়িঙ্গীর বেনাচিতি এলাকার মানুষজনেরাই নন, আশেপাশের বহু মানুষের কাছেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা। ভক্ত সাধারণ ছুটে এলেন মায়ের মন্দিরে। মাতৃমূর্তি দর্শন করেলেন। নিজেদের উপর মাতৃ কৃপা অনুভব করলেন। প্রত্যেকটি মানুষ আগ্রহায়ণ মাসের তীব্র শীতকেও হেলায় উপেক্ষা করে অভূতপূর্ব ভাবে মাতৃবন্দনার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সকলের মুখে তখন একটাই কথা অসাধ্যসাধন করলেন অক্ষয়।
পুজোর শুভলগ্ন আগত। কুমারবাঁধ থেকে গুরু শিষ্য মিলে মাটির কলস ভরে নিয়ে এলেন পবিত্র জল। গ্রামের নাপিতেরা দুর্লভ রক্ত পুষ্প, রক্ত জবা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন। চক্রহীন সম্পূর্ণ অক্ষত এবং সজীব ১০৮ বিল্বপত্র। আনা হয়েছে কলা, শসা, লেবু, নারকেল প্রভৃতি ফল। বাতাসা, কদমা, মণ্ডা, আম্রপল্বব, দুর্বা। ডাবও আনা হয়েছে পূজার সামগ্রী হিসেবে। ভিরিঙ্গী বেনাচিতি গ্রামের ভক্তরাও পুজোর নানা সামগ্রী নিয়ে পূজাস্থানে উপস্থিত হয়েছেন। দেবীকে তারা নিবেদন করবেন। তাদের আর আনন্দের সীমা নেই। মা আসছেন তাদের গ্রামে।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে শিবের সঙ্গে সঙ্গে পুজো শুরু হল। গুরুদেব অক্ষয়কে মন্ত্র বলে দিচ্ছেন। অক্ষয় গুরুদেবকে অনুসরণ করছেন। গুরু শিষ্য মিলে সুচারু রূপে পুজো পদ্ধতি মেনে পুজো শেষ হল। মন্দিরের বাইরে তখন ভক্তেরা মাতৃপুজো দেখছেন। অক্ষয় গুরুর নির্দেশে একের পর এক রক্ত জবা, বিল্ব পত্র মায়ের চরণে অঞ্জলি দিচ্ছেন। কখনও মায়ের বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করে শাস্ত্র বিহিতভাবে পুজো করছেন। মন্ত্রোচারণ হচ্ছে সর্বক্ষণ। গুরুদেব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুজোর কর্মানুষ্ঠান নিরীক্ষণ করছেন। অক্ষয়ের পরিধানে রক্তবস্ত্র। মস্তকে জড়ানো রয়েছে কৌশিক। শুভ্র উপবীত গলায় শোভা পাচ্ছে। কণ্ঠে রুদ্রাক্ষ মালা। কপালে লাল সিঁদুরের তিলক। মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে সুস্পষ্ট ।গম মন্ত্রধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে উর্ধ্বাকাশে। ব্যোম হতে মহাব্যোমে। অনন্তে গিয়ে মিশে যাচ্ছে। এবার ছাগ বলিদানের পালা। বলিদান করলেন গ্রামের বারিক কর্মকার। এখনও তাঁদের উত্তরসূরিরা বংশপরম্পরায় ভিড়িঙ্গী কালী বাড়িতে ছাগ বলি করে আসছেন। গ্রামের উপেন্দ্র, ফকির সূত্রধরেরা বংশপরম্পরায় মাতৃ মূর্তি তৈরি করে আসছেন।
এরপরেই এল শিব ভোগের সময়। একটি আহার্য পাত্রে নৈবেদ্য সাজিয়ে মাতৃ কুটীরের পশ্চাদ্ভাগে অশ্বত্থ বৃক্ষ মূলে নিয়ে গেলেন সাহায্যকারী পূজারী। চারদিকে অন্ধকার, সাবধানতার সঙ্গে শিবাভোগ শিবা পাত্রে স্থাপন করা হল। শিবাপাত্র হল প্রস্তর নির্মিত একটি গামলা বিশেষ। শিবাভোগ যথাস্থানে রাখা হল। সঙ্গে এক পাত্র জল এবং একটি তাম্বুল। শিবাভোগ রাখা মাত্র চারদিক থেকে শিবার দল এসে জড়ো হল। নিমিষেই তারা শিবাভোগ নিঃশেষ করল। অক্ষয় দুজন শিবার নামকরণ করেছিলেন রাম আর ভরত নামে। অক্ষয় যখন প্রতিদিন গভীর রাতে পুজো শেষ করে রওনা দিতেন বাড়ির উদ্দেশ্যে তখন রাম ও ভরত তাঁর সঙ্গী হত। তাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে ছিল বিশাল এক মাঠ। সেখানেই হয়ত তারা থাকত। আবার যখন সূর্য ওঠার অনেক আগেই অক্ষয় কালীবাড়ির দিকে পা বাড়াতেন তখন রামভক্ত হনুমান এর মতো রাম আর ভরত চলে আসত শ্মশানভূমিতে। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা হল, শিয়াল চতুর শ্বাপদ। পোষ মানে না কিছুতেই। শিয়ালের চিরশত্রু হল কুকুর। শিয়াল দেখলে কুকুর তাড়া করবেই, শিয়ালও রুখে দাঁড়াবে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি কখনও।
পুজোর যজ্ঞের আগুন প্রজ্জ্বলিত হল। পবিত্র ঘৃতের আহুতিতে অগ্নিদেবের শিখা জ্বলতে শুরু করল। শেষে পূর্ণাহুতি প্রদান করলেন অক্ষয়। হোম সমাপান্তে ভক্তরা আগুনের পবিত্র শিখা স্পর্শ করে ধন্য হলেন। পুজো শেষ হতে হতেই ভোর। সকাল হতেই ভক্তের ভিড় মাতৃপ্রসাদের গ্রহণের জন্য।
যে শ্মশানভূমিতে দেবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, কালের নিয়মে এখন আর সেই জঙ্গলময় শ্মশানভূমি নেই। জি টি রোডের ধারেই দুর্গাপুর-১৩, নাচোন রোডে বড় বড় দোকান বাজারের মধ্যে ভিড়িঙ্গী কালীমন্দির অবস্থিত। অনেকটা জায়গা জুড়ে এক চূড়াবিশিষ্ট দেবীর মন্দির। সামনেই অনেকটা জায়গা নিয়ে নাটমন্দির। সারা বছরই নানা অনুষ্ঠানে মুখরিত হয় এই কালী মন্দির।
ভিড়িঙ্গী কালী মন্দিরের আগে যেখানে অবস্থান ছিল। একটি গ্রামের উপর অবস্থান করত, তার পশ্চিম দিকে ছিল ধামাপুকুর। যেখান থেকে তিনটে বিষ্ণুমূর্তি ও মহাদেবের অনুচর নন্দী ও ভৃঙ্গি মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল।
এই মন্দিরের বিশেষ রীতি হল, এখানে মা কালীকে ভোগ নিবেদন করার আগে চন্ডভৈরবদের খাওয়ার নিবেদন করা হয়। এই মন্দির নিয়ে প্রচুর জনশ্রুতি রয়েছে বলা হয় মন্দিরের প্রতিষ্ঠতা অক্ষয় কুমার রায় যখন তার গুরুদেবের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ, সেই গ্রামের মানুষ গুরুদেব শেষ কৃত্যের সময়ে এ তাঁর চিতা ভস্মর মধ্যে রুপোর মোহর দেখতে পেয়েছিল। মন্দিরের পশ্চাৎ দেশে সিদ্ধাসন নামক এক পবিত্র স্থান আছে যেখানে পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গ বিরাজমান। একটি বাঁধানো ঘাটও আছে। মায়ের মন্দিরের সামনেই রয়েছে হাড়িখাট যেখানে বিশেষ বিশেষ সময়ে বলি হয়। তাছাড়াও নাগেশ্বর, মহাকালভৈরবী, সিদ্ধিদাতা ও হনুমানজীর মন্দিরও রয়েছে।
মন্দিরটি একটি সমাধি স্থানের উপর অবস্থান করছে। মন্দিরের নীচে শায়িত আছেন মন্দিরের প্রতিষ্ঠতা অক্ষয় কুমার রায় ও তার পুত্র রবীন্দ্রনাথ রায়। পুত্রের সাহায্যে তৈরি হয়েছিল মন্দিরের বর্তমান রূপ মন্দির প্রাঙ্গনে মায়ের এক বিরল দৃশ্য দেখা যায়। সংকোটমোচন হনুমানের কাঁধে নন্দী ভৃঙ্গিসহ মহাকালী।
অমাবস্যার ও কালীপুজোর দিনগুলো মায়ের বিশেষ পুজো আয়োজন করা হয়। ভক্তদের সমাগম হয়। মায়ের চিন্ময়ীরূপ ভক্তদের মনে আনন্দ, আশা ও সন্তুষ্টির সঞ্চার করে। বেনাচিতির বাজারের ভিড়িঙ্গী মায়ের মন্দির বর্তমান বাংলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ কালী পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে।