কৌশিক নগরে গোভদ্র নামে এক ব্রাহ্মণ ছিল। সে ছিল যেমন গরীব, তেমনি অলস। সংসারের কোন কাজেই তার কোন হেলদোল ছিল না।
এদিকে তার স্ত্রী সুভদ্রা গর্ভবতী। সন্তান জন্মের সময় প্রায় হয়ে এসেছে অথচ গোভদ্রর না আছে ধাইবৈদ্যের খরচ দেবার সামর্থ্য, না আছে তার জন্য অর্থ জোগাড় করার চিন্তা।
উপায় না দেখে সুভদ্রাই তাকে বার বার তাড়া লাগায়, যাও না গো, কোন বড়লোক বণিকের কাছে চেয়েচিন্তে ধারদেনা করে আগে থেকে কিছু টাকাকড়ি ঘরে এনে রাখো। দুম করে ব্যথা শুরু হলে তখন কোথায় ছোটাছুটি করবে বল তো? বিনিপয়সায় তোমার ধাইও আসবে না, বদ্যিও আসবে না। তখন কী মুশকিল হবে বল দিকি!
সুভদ্রার কথা শুনে গোভদ্র রেগেমেগে জানায়, ওসব চাওয়া-টাওয়া আমার দ্বারা হবে না। বামুনের ছেলে খেটেও খায় না, চেয়েও খায় না। ওসব কথা আমায় একদম বলবে না!
তবুও সুভদ্রা শান্তভাবে বলে, তোমায় খাটতে তো বলিনি। চাইতেও যখন পারবে না, তখন বারাণসীতেই না-হয় যাও। সেখানে শুনেছি যারা তীর্থ করতে আসে বামুন দেখলেই তারা না-চাইতেই দক্ষিণা দেয়। সেটা তো নিতে পারবে?
কথায় আর না-পেরে গড়িমসি করতে করতে একদিন গোভদ্র বারাণসী গেল। সেখানে দক্ষিণা পেয়ে কিছু টাকাকড়ি জমিয়ে কিছুকাল পরে যখন সে ঘরে ফিরল, তখন এসে শুনল সুভদ্রা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সূতিকায় মারা গেছে। সন্তানটিও বাঁচেনি।
তখন গোভদ্রর সংসারের বাঁধন গেল, সাময়িক বৈরাগ্য এল এবং সে জৈনধর্ম গ্রহণ করে শ্রমণ হয়ে গেল।
শ্রমণ হওয়ার কিছুকালের মধ্যে তার কিছু শিষ্যও জুটে গেল। বনের মাঝে আশ্রম হল। তখন ভিক্ষা হল তার জীবনধারণের উপায়, ধ্যানই হল কর্ম, অহিংসাই হল তার ধর্ম।
বর্ষার সময় একদিন ভিক্ষা করে শিষ্যদের সঙ্গে গোভদ্র বনের পথ ধরে আশ্রমে ফিরছিল। পথে অসাবধানতায় তারই পায়ের তলায় চাপা পড়ে একটি ব্যাঙ মারা গেল।
জৈনধর্মের ছ’টি প্রধান কর্তব্যের মধ্যে একটি হল, ‘প্রতিক্রমণ’। এতে কৃতকর্মের জন্য মানুষ অনুশোচনা করে।
গোভদ্র তার কৃতপাপের জন্য যাতে অনুশোচনা করে, সেজন্য শিষ্যরা সেই মৃত ব্যাঙটির প্রতি গোভদ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে ‘প্রতিক্রমণ’ করতে বলল।
কিন্তু, হঠাৎ বৈরাগ্যে শ্রমণ হলেও, অনুশোচনা গোভদ্রর স্বভাবে ছিল না। তাতে আবার গুরু হয়ে তার অহং খুব প্রবল হয়ে উঠেছিল। তাই শিষ্যরা যখন তাকে পাপের কথা বলল, তখন তাদের কথা শুনে গোভদ্রর খুব রাগ হল।
সেই পথের পাশে আরও কয়েকটি ব্যাঙ মরে পড়েছিল। তাই দেখে সে তেরিয়া হয়ে শিষ্যদের বলল, একটা কেন, ঐ যে পথের ধারে মরে থাকা ব্যাঙগুলোকেও বল না আমিই মেরেছি! গুরুর সম্মান কী করে রাখতে হয়, তোমরা সেটাও শেখনি!
গোভদ্র রেগে গেছে দেখে শিষ্যরা তখনকার মতো চুপ করে গেল। কিন্তু, পাপের জন্য কোন ‘প্রতিক্রমণ’ না-করায় তাদের মন বড় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
আশ্রমে ফিরে সন্ধ্যায় যখন তারা আর একবার গোভদ্রকে পাপের কথা ও প্রতিক্রমণের কথা মনে করাতে গেল; তখন গোভদ্র ভীষণ রেগে গেল এবং রাগে অন্ধ হয়ে শিষ্যদের প্রহার করার জন্য তাড়া করল। এই তাড়া করতে গিয়েই হঠাৎ আশ্রমের একটা খাম্বায় সজোরে ধাক্কা খেল গোভদ্র। এতেই সে পড়ে গেল এবং মরে গেল।
মৃত্যুর সময় গোভদ্রর মনে প্রচন্ড ক্রোধ ছিল বলে পরের জন্মেও সে ক্রোধী হয়েই জন্মাল। এবার সে এক কাঠুরের ঘরে জন্ম নিল। তার নাম হল কৌশিক। তবে, তার প্রচন্ড রাগের জন্য তাকে লোকে বলত, চণ্ডকৌশিক।
কৌশিকের একটি ফুলের বাগান ছিল। বাগানের ফুলের গাছগুলোকে সে খুবই ভালোবাসত। কেউ তার ফুল বা পাতা ছিঁড়বে, এটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারত না।
একদিন সে যখন বন থেকে কাঠ কেটে ফিরছে, তখন সে দেখতে পেল কয়েকটা বাচ্চা ছেলে তার বাগানে ফুল তোলার খেলা খেলছে। সেটা দেখেই তার মাথায় রাগ উঠে গেল। অমনি কাঠের বোঝা দুম করে ফেলে হাতের কুঠার বাগিয়ে সে ছেলেদের হুংকার ছেড়ে তাড়া করল। মাথায় চাপল, আজ সে তাদের মেরেই ফেলবে!
কিন্তু, ছেলেদের পেছনে ছুটতে গিয়ে হঠাতই একটা গর্তে পড়ে গেল কৌশিক, তার হাতের কুঠার ছিটকে নিজেরই মাথায় ভয়ঙ্কর আঘাত লাগল। আর তাতেই সে মারা গেল।
এবারও মৃত্যুর সময় তার মনে ছিল প্রচন্ড ক্রোধ। তাই সে জন্ম নিল প্রচন্ড বিষধর এক সাপ হয়ে এবং বাস করতে লাগল পূর্বজন্মের প্রিয় বাগানে। বিষদৃষ্টি দিয়ে সে যার দিকে তাকায় সে-ই ভস্ম হয়ে যায়।
তাই তার ভয়ে বাগানের সব পাখি ভয়ে পালিয়ে গেল দূরে। বাগানের কাছাকাছি যে-সব মানুষ বাস করত, তারাও বাস উঠিয়ে পালিয়ে গেল।
সেই সময় সংসারের বৈভব ছেড়ে বর্ধমান মহাবীর প্রব্রজ্যা নিয়ে পথে বেরিয়েছিলেন জীবকে মোক্ষপথের সন্ধান দিতে। চলতে চলতে তিনি একদিন এসে পৌঁছলেন সেই বাগানে। সেই বাগানে পাখি নেই, পশু নেই, মানুষ নেই; শুধু ফুলে ফুলে ভরা।
ফুলের শোভা দেখতে দেখতেই মহাবীর ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়লেন। তখনই হঠাৎ সাপটির চোখ পড়ল বাগানে আগন্তুক মহাবীরের দিকে। অমনি স্বভাবক্রোধে সে তেড়ে এল। বিষদৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইল মহাবীরকে।
কিন্তু কী আশ্চর্য, তার দৃষ্টিতে মহাবীরের কিছুই হল না। প্রসন্ন মগ্নতায় তিনি ধ্যান করতে লাগলেন। তাঁর ধ্যানও ভঙ্গ হল না। এতে সাপ আরও রেগে গেল, তার তীব্র বিষ দাঁত দিয়ে সে মহাবীরকে দংশন করে বসল। কিন্তু, সেই কাল দংশনেও মহাবীরের ধ্যান ভঙ্গ হল না, এমনকি ক্ষত থেকে রক্তপাতও হল না!
তখন সাপ অবাক হল। তার মনে হল, কে এই মানুষ, অমন বিষদংশনেও যার কিছু হয় না? একি সত্যিই মানুষ? না কি দেবতা?
ক্ষণিকের ভাবনা হারিয়ে গেল। তার মনে জেগে উঠল হত্যা না-করতে পারায় ব্যর্থতার প্রবল রাগ। সেই রাগের বশেই আবার ছোবল দিতে উদ্যত হল সে।
ঠিক তখনই মহাবীর চোখ খুললেন। প্রশান্ত কন্ঠে বললেন, শান্ত হও চণ্ডকৌশিক! শান্ত হও।
মহাবীরের মুখে পূর্বজন্মের নাম শুনে, প্রশান্তি দেখে সাপ থেমে গেল। মনে পড়ল তার জন্মান্তরের কথা।
মহাবীর বললেন, ওহে কৌশিক, সমস্ত জীবেরই সাধনা থাকে হীন থেকে মহাজীবনের পথে অগ্রসর হওয়ার। কিন্তু, তোমার নেই। তুমি একবার স্মরণ করে দেখ তোমার বিগত জন্মের কর্মের কথা; তোমার আলস্য, তোমার ক্রোধ, তোমার হিংসার জন্যই আজ তোমার এই অধোগতি হয়েছে। সাধক থেকে কাঠুরে, কাঠুরে থেকে সাপ হয়েছ। তুমি ক্রোধপ্রবৃত্তি ত্যাগ কর; তাহলেই তোমার অহং নির্মূল হবে, অহং গেলে প্রকৃত বৈরাগ্য আসবে, বৈরাগ্য এলে হিংসা যাবে, হিংসা গেলেই তোমার মুক্তি হবে।
মহাবীরের কথায় যেন সাপের বোধদয় হল। সত্যিই তো, প্রবৃত্তির বশে তার জন্ম-জন্মান্তর সব ব্যর্থ গেছে! এবার তার অনুশোচনা হল। সে মহাবীরের নির্দেশ মাথায় নিয়ে খুঁজতে চাইল মোক্ষপথের রেখা।
এতদিনে তার মনে যেন প্রশান্তি এল; জীবের অনিষ্টকারী বিষদৃষ্টির চোখ না-খোলার প্রতীজ্ঞা নিল সে। হিংসা ছেড়ে বাস করতে লাগল গর্তে। সকলে তার এই ভাবপরিবর্তন দেখে তাকে দেবতাজ্ঞানে ঘি-মধু মাখিয়ে পুজো করতে লাগল।
অচিরেই সেই ঘি-মধুর লোভে দলবেঁধে পিঁপড়েরা এল। অঙ্গে মাখা মধু খেতে গিয়ে পিঁপড়েরা খুঁটে খুঁটে সাপের দেহ বিক্ষত করে ফেলল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও সে মনে ক্রোধ আসতে দিল না, পিঁপড়েদের প্রত্যাঘাত করল না। বরং, নিরাসক্তভাবে মৃত্যুবরণ করে জন্মান্তরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে মোক্ষ লাভ করল।
আসলে, আত্মসুখ ত্যাগ করে, যাতনা সহ্য করেও অহিংসা, বৈরাগ্য ও নিরাসক্তির মধ্য দিয়েই জগতকে মোক্ষপথের সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন জৈনধর্মের শেষ তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীর; গল্পটি তারই উদাহরণমাত্র।