উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী : বঙ্গভঙ্গে ও বঙ্গ-সাহিত্যে

ব্রহ্মপুত্রের ধারে মসূয়া গ্রাম। সেখানে জন্ম হল শ্যামকান্তের দ্বিতীয় পুত্রের। বড় ছেলে সারদারঞ্জনের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হল, 'কামদারঞ্জন'। শ্যামকান্তের জ্ঞাতি হরিকিশোর। মসূয়ায় তাঁর জমিদারি ছিল, 'রায়চৌধুরী' পদবি ছিল, কিন্তু, পুত্রসন্তান ছিল না। দুই জ্ঞাতির কাছাকাছি বাড়ি। বছর পাঁচের চালাক-চতুর কামদাকে তাই জমিদার আর জমিদারগিন্নির ভারি সাধ দত্তক নেওয়ার। সরল মানুষ শ্যামকান্তর মত আদায় করে ছাড়লেন। বিধিমতে দত্তক নেওয়া হল। হল নতুন নাম। এবং, আবার মিল। হরিকিশোরের সঙ্গে মিলিয়ে, 'উপেন্দ্রকিশোর'। কিন্তু, উপেন্দ্রের মনখানার সঙ্গে কারও মন মিলল না। তিনি মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা, খেয়ালি, উদ্যমী; শ্যামকান্ত বা হরিকিশোরের মতো প্রাচীনপন্থী নন। তবে শ্যামকান্তের রক্তস্রোতের উত্তরাধিকারে তিনি যে জিনিসটি পেয়েছিলেন, তা হল, সঙ্গীত। রক্তসূত্রেই সঙ্গীতের কান তাঁর তৈরি হয়ে গিয়েছিল বাল্যেই। তাই ক্রমে তিনি বাঁশি বাজানো শিখলেন। বেহালা বাজানো শিখলেন। 'সখা', 'মুকুল' প্রভৃতি পত্রিকার পাতায় গানও লিখলেন। যখন নিজে 'সন্দেশ' (১৯১৩) পত্রিকা বার করলেন, তখন তাতে ভারতীয় ও ইওরোপীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন। তারপর, 'সঙ্গীত শিক্ষা' ও 'বেহালা শিক্ষা'--নামে দু'খানা বইও লিখে ফেললেন। শুধু যে তিনি বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলতেন তা নয়, তাঁর কণ্ঠেও ছিল অপূর্ব মাধুরী। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা পরে ছেলেমেয়েদের মধ্যেও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সত্যজিতের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতপ্রীতি সেই উত্তরাধিকারেরই বিস্তার।

বেহালা শুধু তাঁর ভালোবাসা ছিল না, অবসরের বিনোদন ছিল না; প্রতিবাদের হাতিয়ারও ছিল। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে রাখিবন্ধন উৎসব করলেন। গান লিখলেন। সুর দিলেন। দীনেন্দ্রনাথ কণ্ঠ দিলেন। ঠাকুর বাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বিরাট শোভাযাত্রা বেরোল। বেহালার সঙ্গত নিয়ে তাতে যোগ দিলেন সুকিয়া স্ট্রিটবাসী উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর বেহালায় বেজে উঠল ঐক্যের গান, প্রতিবাদের সুর, 'বাংলার মাটি, বাংলার জল'।

উপেন্দ্রকিশোর ছোটদের জন্য 'সন্দেশ' পত্রিকা প্রকাশ করে শুধু যে শিশুসাহিত্য ও শিশুমনের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছেন তাই নয়; পরবর্তীকালের বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুখলতা রাও, পুণ্যলতা চক্রবর্তী, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসুর আত্মপ্রকাশের পথটিও তৈরি করেছেন। বাংলা শিশুসাহিত্যের বিকাশ, তাঁর কীর্তি; সুমুদ্রিত সাহিত্য ও শিশুসাহিত্যের সঙ্গে সুন্দর অর্থপূর্ণ ও মানানসই অলংকরণ, তাঁর কীর্তি; হাফটোন ছবিছাপাইয়ের উন্নতি, তাঁর কীর্তি। এমনকি, পরিবারে ব্রাহ্মধর্মের প্রবেশ, সেও তাঁর কীর্তি। 

জন্মদাতা এবং অন্নদাতা--দুই পিতাই ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। কিন্তু, ছোট থেকেই উপেন্দ্রের মনে হিন্দুধর্ম বা মূর্তিপুজোর প্রতি আলাদা কোন আবেগ তৈরি হয়নি। গগনচন্দ্র সোম ছিলেন ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে। দুজনের গলায় গলায় ভাব। আসলে, গণনও খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন। সুর থেকে মিল হল মনে। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। আবাল্য গগনের কাছে ব্রাহ্মধর্মের নিরাকার, অনাড়ম্বর ও সঙ্গীতময় উপাসনার কথা শুনে শুনে এই ধর্মের প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল উপেন্দ্রের মনে। কলকাতায় পড়তে এসে তাই ব্রাহ্মধর্মের সবগুলোতে যোগ দিতে দিতে একদিন ধর্মেও যুক্ত হলেন। শ্যামকান্ত ততদিনে মারা গেছেন, কিন্তু, হরিকিশোর বেঁচে। তিনি এতে খুব আঘাত পেলেন। বেপরোয়া উপেন্দ্র এসব ঘরোয়া-আবেগ নিয়ে কোনদিনই খুব একটা ভাবেননি। আসলে, যা কিছু মুক্ত, যা কিছু উদার--তা গ্রহণ করতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। তখন মেয়েদের শিক্ষায়, স্ত্রী-স্বাধীনতায়, স্টাইলে-ফ্যাশানে সবেতেই ব্রাহ্মরা অনেক এগিয়ে। 

যা বলছিলাম, পারিবারিক সম্পর্ক ও আবেগের প্রতি উপেন্দ্রর কোনকালেই খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। হরিকিশোর কিন্তু দত্তক নিয়েও তাঁকে নিজের পুত্রের মতো ভালোবেসেছিলেন। মানুষ করেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে কোনদিন উপেন্দ্রকে অর্থের অভাব জানতে দেননি, ইচ্ছেপূরণে বাধা দেননি, আঘাত পেয়েও নিজের কষ্ট বুঝতে দেননি। উপেন্দ্র কিন্তু কোনদিনই তাঁর পুত্র হয়ে উঠতে পারেননি। চেষ্টাও করেননি। কলকাতা প্রবাসে চোখের আড়াল থেকে মনের আড়াল হতে হতে ক্রমশই দূরত্ব বেড়েছে। সম্পর্ক বজায় থাকলেও, হয়ে উঠেছে, দূর-সম্পর্ক। তাহলে, উপেন্দ্র কি স্বার্থপর ছিলেন? ঠিক তা না। এ-আসলে শিল্পীমনের এক ধরণের উদাসীনতা এবং পক্ষপাতিত্ব। তাই উপেন্দ্রের প্রতি হরিকিশোরের বাৎসল্য ও ভালোবাসা একতরফা হয়েই রয়ে গেল চিরটাকাল। যেমন, উপেন্দ্রের ভালোবাসা একতরফা ছিল সাহিত্য-শিল্পের ওপর। আর এই ভালোবাসার অবদানেই 'সেকালের কথা', 'টুনটুনির বই', 'মহাভারতের গল্প'-এ আমাদের চিরকালকে ধরে রেখে শিল্পী-সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী হয়ে রইলেন চিরস্মরণীয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...