পুতুল নেবে গো, পুতুল....। বাংলার প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শ্যামল মিত্রের গাওয়া এই গান আজ যেমন ইতিহাসের খাতায়, তেমনি বাংলার পুতুল...পুতুল নাচ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে টেকনোলজি, কিন্তু সময়ের নিরীখেই আজ কোনঠাসা হয়ে গিয়েছে সংস্কৃতির এই অংশবিশেষ।
অথচ এই পুতুল নাচের সঙ্গে জড়িয়ে কতশত মানুষের জীবনজীবিকা। পুতুল নাচিয়েদের জীবন জুড়ে থাকে কাঠ মাটি কাপড়ের চরিত্ররা। প্রাণহীন পুত্তলির অঙ্গ বিভঙ্গের তালেতালে চলতে থাকে ‘পুতুল নাচ’ শিল্পীদের সংসার।
পুতুল নাচিয়েরা নানান ধরনের পুতুল বানিয়ে বুনে চলেন এক রূপকথার গল্প। তাতে যেমন চরিত্র রয়েছে, ঠিক তেমনই রয়েছে জীবনগাথা । রয়েছে শিক্ষা, সঙ্গে মনোরঞ্জন ।
বেশ কয়েক ধরনের পুতুলের মধ্যে একটি ধরন হল- তারের পুতুল বা ‘স্ট্রিং পাপেট’। পুতুল নাচিয়ের দল এদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান উড়িষ্যা, অসম, ত্রিপুরা। হিন্দি বা ভোজপুরিতে গান বানান। যেমন দেশ তেমন বেশ। গ্রহণ যোগ্যতার খাতিরে পুতুলের ভাষা যায় বদলে।
তারের পুতুল বানানো হয় শোলা দিয়ে। প্রতিটি পুতুলকে ৬টি তারের সাহায্যে বেঁধে নাচানো হয়। এই পুতুলের মধ্যে প্রধান পুতুল, যাকে ডাকা হয় ‘ভানুমতি’ নামে, সে জুড়ে থাকে ১৮টি তারে। এই ভানুমতির খেলাতেই শুরু হয় আসর। এই পুতুলের মাথায়, হাতে, পায়ে, পিঠে দু’টি করে তার লাগানো থাকে। পুতুল নাচিয়েদের হাতের ইশারাতে শুরু হয় ভানুমতির কোমরের ঠমক। মূল শিল্পী পরিচালনা করেন মুখ্য পুতুলকে। আরেকজন তাঁকে সাহায্য করেন। তারের পুতুলের নাচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিখ্যাত যাত্রাপালায়, আবার কখনও কখনও দর্শক চাহিদা মেটাতে হিন্দি বা বাংলা সিনেমার কাহিনীও তুলে ধরা হয়।
ভানুমতী ছাড়াও তারের পুতুল নাচে থাকে আরও দুই চরিত্র। পারুল বালা ও কানন বালা। আর আছে আমাদের রাজ্যের দক্ষিণের মাটি-কাঠের তৈরি পুতুল। পোশাকি নাম ‘ডাঙ্গের পুতুল’। এই পুতুলের হাতে তির ধনুক দেওয়ার জন্য দুহাতে গর্ত করা হয়। একটি শরীরের অনেকগুলো মাথা রাখা হয়। তাই শুধু জামাকাপড়ের বদলেই বদলে যায় রুপ-চরিত্র। এই পুতুল নাচিয়েদের পায়ে পরানো থাকে ঘুঙুর। পুতুলের সঙ্গে নেচে ওঠে ঘুঙুর। তালে তালে। মুলত ধর্মীয় পালাগানে নাচানো হয় এই ডাঙ্গের পুতুল।
মনসামঙ্গলের বেহুলা-লখিন্দরের করুন গাথা বা আধুনিক কিছু প্রেম কাহিনি, সবই জীবন্ত হয়ে ওঠে এই পুতুলের নৃত্যভঙ্গিমায়। এই পুতুল নাচের প্রতিটি দলে থাকে ১৫ থেকে ১৮ জন সদস্য । পুতুলের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে তারাও নেচে ওঠেন, বেঁচে ওঠে পুতুল নাচের জীবন।
মেদিনীপুরের ‘গ্লাভস পাপেট’ বা দস্তানা পুতুলের বেশ কদর। পোশাকি নাম ‘বেনির পুতুল’। এই পুতুলের মাথা টেরাকোটার, হাত হয় কাঠের। শরীর তৈরি হয় বিভিন্ন রঙ বেরঙ্গের কাপড় দিয়ে। নাচিয়েদের পায়ে বাঁধা ঘুঙ্গুরের তালে তালে তাঁরা নিজের গলায় গান গেয়ে গেয়ে নাচ দেখান। এক্ষেত্রেও আশ্রয় নেওয়া হয় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর। বিভিন্ন শিক্ষামূলক , সচেতন মুলক বার্তা পৌঁছানোর জন্য এই বেনির পুতুলকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র যেমন- হারমনিয়াম, বেহালা, তবলা সহযোগে বসে বেনি পুতুল নাচের আসর।
সন্ধ্যার আলোতে শিল্পীর কল্পনাতে তৈরি হত এক রূপকথার দেশ। যে দেশে জাতপাতের উর্দ্ধে থেকে যেত আবেগ-প্রেম, জিতে যেত মানবতার গল্প। সে দেশ আজ সত্যিই ‘গল্প’, ‘ইতিহাস’।