হিন্দু ধর্মই বলুন বা সনাতন ধর্ম, এই ধর্মের উপাসক-সম্প্রদায় মূলত পাঁচটি মণ্ডলে বিভক্ত: শাক্ত, সৌর, শৈব, গাণপত্য ও বৈষ্ণব।
শাক্তরা দেবী শক্তি অর্থাৎ দুর্গা-কালীর বিভিন্ন রূপের উপাসনা করেন। সৌর-সম্প্রদায় উপাসনা করেন সূর্যের। শৈবরা শিবের উপাসনা করেন। গণেশের উপাসনা করেন গাণপত্য সম্প্রদায়। এবং, বিষ্ণুর উপাসনা করেন বৈষ্ণবেরা।
স্বভাবতই, এই সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছিল সূচনাপর্ব থেকেই। অনেক সময়ই পুরাণকাররা এই বিরোধ তৈরি হতে সাহায্য করেছেন, আবার অনেক সময়ই তাঁরা এবং ধর্মমূলক কাহিনির প্রচারক ঋষি-কবিরা চেষ্টা করেছেন তাঁদের কাহিনিতে এই বিরোধের মাঝখানে দেবতাদের এনে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে।
শৈব এবং বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী এই বিরোধ মিটিয়ে ফেলার একটি কাহিনি পাওয়া যায় 'রামায়ণ'-এ। সেই কাহিনিটিই আজ আপনাদের শোনাচ্ছি :
পঞ্চবটীর কুটিরের নিরাপদ গণ্ডি থেকে রাবণ অতিথির ছলনায় বাইরে আসতে বাধ্য করেছিলেন সীতাকে। সীতাও আজন্ম সংস্কারে ভুলে গিয়েছিলেন যে, সব অতিথি দেবতা হয় না।
ওদিকে সোনার হরিণরূপী মারীচের পিছু নিয়ে রাম-লক্ষ্মণ বুঝেছিলেন যে, সোনার হরিণ বলে কিছু হয় না। সোনার হরিণ আসলেই নেই। বুঝেছিলেন, সংসারে কিছুতেই সুখ যাপন করা যায় না, সে চকিত হরিণের মতোই চপল, সোনার হরিণের মতোই মায়া। তবু তার প্রতি অদম্য আকাঙ্ক্ষা থাকে, থাকে অদম্য ইপ্সা।
সেই ইপ্সার বশেই রাবণ বরণ করলেন, হরণ করলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুরূপী সীতাকে। আর সীতা বরণ করলেন দীর্ঘ বিচ্ছেদ, সতীত্বের পরিপ্রশ্ন। সেই প্রশ্নপর্ব বারবার অগ্নিপরীক্ষার পরও কোনদিন আর থামল না।
ফলে, মারীচ বধ করে রাম-লক্ষ্মণ যখন কুটিরে ফিরলেন, তখন কুটির শূন্য। সেখানে সীতা নেই। স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালবাসায় শ্রীরাম কোন-কিছু না-বুঝেই অলীকের পেছনে ছুটেছিলেন। ভ্রাতৃবধূর পিড়াপীড়িতে লক্ষ্মণও মিথ্যে ডাকে বিহ্বল হয়ে ছুটেছিলেন রামের সন্ধানে। অবতার হয়েও তাঁরা ভুল করেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষই ভুল করে। কারণ, তাঁদের এ-অবতার মানব অবতার।
যাই হোক, সীতাকে হারিয়ে বিলাপের কাল পেরিয়ে দুই ভাই তাঁকে খুঁজতে বেরোলেন। খুঁজতে খুঁজতে শেষে পঞ্চবটী ছেড়ে হাজির হলেন দণ্ডক অরণ্যে।
দণ্ডকারণ্যে একদিন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত-শ্রান্ত দুই ভাই বিশ্রাম নিতে বসলেন। তাঁরা পথ চলে ক্লান্ত, সীতা উদ্ধারের কোন উপায় না-দেখে হতাশায় শ্রান্ত। দু'জনেই বিষণ্ণ। এমন সময় সেই পথে শিব আর পার্বতীকে দেখা গেল। তাঁরা বেরিয়েছিলেন অরণ্য ভ্রমণে। শিবের হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল রাম-লক্ষণের দিকে।
দূরত্ব অনেকটা, তাই হঠাৎ চিনতে পারলেন না। তবে, অবাক হলেন। কারণ, দু'জনকেই দূর থেকে তাঁর দিব্যপুরুষ বলে মনে হল। ভাবলেন, এঁরা অরণ্যপথের ধারে অমন করে বসে আছেন কেন? এঁরা কারা? শিবের কপালে ভাঁজ পড়ল। জানার ইচ্ছে এতটাই প্রবল হল যে, সত্বর শিব সস্ত্রীক তাঁদের কাছে হাজির হলেন।
কাছে এসেই চিনতে পারলেন শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে। দুজনেই বসে আছেন আনমনা, গভীর কোন ভাবনায় মগ্ন, বাইরের প্রকৃতিতে কী ঘটছে, দুজনের সেদিকে কোন হুঁশই নেই যেন। তাঁদের এই অবস্থায় দেখে শিবের এক অনির্বচনীয় ভাবোদয় হল।
অন্তর্যামী শিব দিব্য চোখে দেখে দুই ভাইয়ের বিরসভাবের কারণসমূহ সমস্তই বুঝলেন। বসলেন শ্রীরামের পদতলে, উত্তরীয় দিয়ে মুছিয়ে দিলেন পায়ের ধুলো। বুনো ফুলে নিবেদন করলেন অর্ঘ্য, জানালেন প্রণতি। তখন যেন হুঁশ ফিরল রামের। চেয়ে দেখলেন পদতলে স্বয়ং স্বয়ম্ভূ শিব। তখন শিবকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। বললেন, পদপ্রান্তে কেন প্রভু, আপনার আসন যে আমার হৃদয় জুড়ে!
বক্ষলগ্ন শিবের মুখে ছড়াল তৃপ্ত ভক্তের স্মিত হাসি। শিব বললেন, হতাশ হবেন না প্রভু, নিরাশ হবেন না। হনুমানের অবতার নিয়ে এই ভক্ত তো আপনারই অপেক্ষা করছে আপনার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে বলে। জগতে যারা তুচ্ছ, যারা সকলের কাছে হেয়, সেই অন্ত্যজদের নিয়ে আপনারই প্রতীক্ষায় আছে। তাদের দিয়েই হবে সীতামায়ের উদ্ধার, তারাই হবে আপনার রামসেনা।
শিবের এমন আন্তরিকতা এবং দাস্যভক্তিতে রামের সীতা-বিচ্ছেদ জনিত বিরহ ও উচাটন কিছুটা প্রশমিত হল। সাহায্যের আশ্বাসে দিকভ্রান্ত অরণ্যে যেন হঠাৎ করে দিক-নির্দেশ পেলেন। এ-সমস্তই তাঁকে কিছুটা প্রশান্তি দিল।
শ্রীরামকে কিছুটা প্রশান্তি দিতে পেরে শিব নিজেও যেন খানিকটা শান্তি পেলেন। সেটুকু সম্বল করে লক্ষ্মণের সাথে নমস্কার ও প্রীতি বিনিময় করে শিব বিদায় নিলেন।
শিব যখন শ্রীরামের পদসেবা ও পুজো করছিলেন, তখন অত্যন্ত অবাক হয়েছিলেন পার্বতী। বুঝতে পারছিলেন না, সর্বদেবতার পূজ্য দেবাদিদেব মহাদেব সামান্য একজন মানবের পুজো করছেন কেন! তবে এটা বুঝতে পারছিলেন যে, এর মধ্যে প্রভুর নিশ্চয়ই কোন লীলা আছে। কিন্তু, লীলাটা ঠিক কী, সেটাই ধরতে পারছিলেন না। ফলে, অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর।
অস্বস্তিটা পার্বতীকে ক্রমাগত পীড়িত করছিল সেই তখন থেকে। এবার স্বামীকে একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন সংশয়ের কথা।
সব শুনে শিব হেসে বললেন, ওগো দেবী, মায়াদেবী তোমাকে প্রভাবিত করেছিলেন বলেই তুমি তাঁকে চিনতে পারনি। তিনি সামান্য মানবমাত্র নন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণু। আমি প্রলয় ঘটাতে পারি, তিনি করেন রক্ষা। আমি বিষ ধারণ করতে পারি, তিনি দান করেন অমৃত। তাই তিনি জগতের প্রণম্য তো বটেনই, আমারও প্রণম্য। তাই ভগবান রামের সেবার অধিকার লাভের জন্যই আমি এই যুগে নিয়েছি হনুমানের অবতার। অচিরেই ত্রিলোক দেখবে ভক্ত ও ভগবানের মিলন।
শিবের কথায় পার্বতী তুষ্ট হলেন, তৃপ্ত হলেন। দু'জনে এগিয়ে গেলেন কৈলাসের পথে। অলক্ষ্যে শিবের লীলা দর্শন করে মুচকি হাসলেন মহাকাল। হ্যাঁ, মহাকাল। মহাকাল তো আসলে স্বয়ং সেই স্বয়ম্ভু শিবই; যিনি নিজেই অবস্থান্তরে লীলা করেন, অবস্থান্তরে নিজেই নিজের লীলা উপভোগ করেন, মিলিয়ে দেন অমিলের বিরোধ...