১৯৬৭ সাল। ছুটির দিন। বাড়িতে টেলিভিশনের পর্দায় কুইজের অনুষ্ঠান দেখছিলেন এক তরুণ। পেশায় সাংবাদিক। কুইজের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এক ছাত্রকে কুইজ মাশ্তার প্রশ্ন করল গ্রীক মহাকাব্য নিয়ে। সে চমৎকার উত্তর দিল। কিন্তু আটকে গেল ভারতীয় মহাকাব্যে এসে। রামায়ণ থেকে করা এক সহজ প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারল না।
দেশিয় সাহিত্য বিশেষ করে ভারতীয় মহাকাব্য সম্বন্ধে নতুন প্রজন্মের ধারনার অভাব তরুণ সাংবাদিককে বেশ বেদনা দিয়েছিল।তবে বেদনা আর সমালোচনাতেই থেমে থাকল না। ভাবনা শুরু করল কীভাবে দেশিয় সাহিত্য বিশেষ করে রামায়ণ মহাভারতকে আধুনিক প্রজন্মের উপযোগী করে তোলা যায়। রাস্তাও পেয়ে গেল সে। বিদেশি কমিক স্ট্রিপের অনুকরণে রামায়নকে কমিকের রূপ দেওয়ার কথা খেয়াল এল মাথায়।
ভারতীয় মহাকাব্যের গল্প রেখায়-লেখায় শিশুদের উপযোগী হয়ে সামনে এল। একটা আস্ত কমিক সিরিজ। অমর চিত্রকথা। তরুণ সেই সাংবাদিকের নাম অনন্ত পাই।
শুধু মহাকাব্য নয়, লোক সাহিত্য, প্রচলিত গাথাও উঠে এসেছিল কমিকস আকারে। সমস্ত ভাবনার নেপত্যে একটাই নাম। অনন্ত পাই। শিশুদের কাছে তিনি খুব কাছের ‘আঙ্কেল পাই’।
তবে সাফল্য সহজ পথে আসেনি। ১৯৬৭ সালে সর্বভারতীয় দৈনিকে চাকরি ছেড়ে প্রথম বার তিনি যখন একটি প্রকাশনা সংস্থার কাছে তাঁর আইডিয়ার কথা জানান, তারা পত্রপাঠ নাকচ করে দেয় তাঁকে। কিন্তু নিজের ভাবনা এত সহজে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে রাজী ছিলেন না অনন্ত। তিনি চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত একটি সংস্থা রাজি হল ঝুঁকি নিতে। পৃথিবীর আলো দেখল ‘অমর চিত্র কথা’।
কিন্তু পাঠকের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে অনেক বাধা। কোনও স্কুল তাদের লাইব্রেরিতে এরকম কমিকস রাখতে রাজি নয়। কমিকস জনপ্রিয় করতে, মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে রেখা লেখা থেকে শুরু করে প্রচার সব দিকে নজর দেন অনন্ত। ভারতীয় শিশুদের দেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতেই প্রয়াস। যদিও শুরু হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়।
রাম ওয়াইরকরকে সঙ্গে নিয়ে পাই সম্পাদিত ‘অমর চিত্র কথা’ সিরিজ়ের প্রথম কপি ‘কৃষ্ণ’ জন্ম নিল (১৯৬৯)। প্রথম সিরিজের সব ছবি তাঁর আঁকা। সবুজ, নীল এবং হলুদ রঙের ব্যবহারে।
অনন্ত পাই-এর ছোটবেলার জীবন কঠিন।
১৯২৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কর্ণাটকের কেরকেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাত্র দু’বছর বয়সে বাবা-মা কে হারান। ম্যাঙ্গালোরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে মানুষ।
পরে কাজের সূত্রে মুম্বই-এর বাসিন্দা।
সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা ছিল ছোটবেলা থেকেই। বিভিন্ন ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ।
স্কুলের পড়া শেষ করার পর সাংবাদিকতার দিকে ঝোঁকেন। যদিও ইউনিভার্সিটি বোম্বাই এর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। যোগ দেন একটি সর্বভারতীয় দৈনিকে।
নিশ্চিত চাকরীর জীবন ছেড়ে তিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন। নিজের ভাবনার প্রতি বিশ্বাস হারাননি। তাই ভারতীয় ইতিহাসে ‘অমর চিত্র কথা’ আজ ইতিহাস।
বর্তমানে ২০ টি ভাষায় প্রায় ৪০০ টাইটেল কমিকস। প্রতি মাসে প্রায় ৩ লক্ষ সার্কুলেশন।
ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে অমর চিত্রকথা। সেই সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই অমর হয়ে আছেন অনন্ত পাই। ভারতীয় সাহিত্যে যাঁর পরিচিতি ‘ ফাদার অফ ইন্ডিয়ান কমিকস’ হিসেবে।