ডাকাত আর কালীর গল্প সুপ্রাচীন। তন্ত্রের মতে, বাংলার অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী কালিকা। এই কারণে, বহু প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গদেশে কালীর সাধনা শুরু হয়। বিখ্যাত কালী মন্দিরগুলি গড়ে ওঠে । ডাকাতে কালীর নাম শোনেনি এমন বাঙালি নেই। গল্প পড়ে বাঙালি জেনেছে, ডাকাতরা কালী সাধক হন। বঙ্গদেশে এমন কোনও ডাকাতের কাহিনী প্রচলিত নেই যিনি কালীপুজো করতেন না। তাঁরা নাকি কালীর খাঁড়া থেকে প্রসাদী সিঁদুর নিয়ে কপালে তিলক কেটে ডাকাতি করতে বের হতেন। সেইসব পুজোয় নরবলিও নাকি হত।
আজ এক ডাকাত কালীর গল্প বৈদ্যবাটী-তারকেশ্বর রোডের পাশে পুরুষোত্তমপুর এলাকায় অবস্থিত এই ডাকাতকালী মন্দির। এই মন্দিরের বয়স প্রায় পাঁচশো বছর। সিঙ্গুরের ডাকাত কালী মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কয়েক শতক আগে সরস্বতী নদী ছিল এই রাজ্যের প্রধান বানিজ্যিক নদী। সেই নদীর অববাহিকা জুড়ে ঘন বনজঙ্গলের সুযোগে দাপিয়ে বেড়াত ডাকাতের দলবল। তেমনই জানা যায়, সিঙ্গুরের সরস্বতী নদীর অববাহিকা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াত গগন সর্দারের দলবল। ঘন জঙ্গলে চলত ভীষণ কালী মায়ের আরাধনা। ডাকাতির আগে সেই কালী মূর্তির পুজো করে তবেই রওনা দিত গগন সর্দারের দল। পরবর্তীকালে সিঙ্গুরের চালকে বাটির মোড়লরা স্বপ্নাদেশ পেয়ে নতুন করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
সিঙ্গুরে ডাকাত কালীমন্দির এর প্রতিষ্ঠাকাল সম্বন্ধে জানা যায় না। হুগলির সিঙ্গুরে গগন ডাকাতের কালীকে সবাই একডাকে চেনে। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা ঘিরে বিভিন্ন কাাহিনি প্রচলিত। শোনা যায়,স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরোধিতা করতে বহু জমিদার বাড়িতেই পালন করা হত লেঠেল। গগন নাকি তেমনই এক লেঠেল ছিল প্রথম জীবনে তারপর সে ডাকাতিতে নামে ও এলাকার ত্রাস হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরাও গগন ডাকাতকে বেশ ভয় পেত। কিন্তু সিঙ্গুরের কালীপুজোর সঙ্গে কোথায় যেন মিশে রয়েছে হাড় হিম করা ডাকাতদের কাহিনী। সিঙ্গুরের ডাকাত কালীমন্দির সেরকমই একটি মিথ। স্থানীয়রা এই ডাকাত কালী কে এতটাই জাগ্রত বলে মনে করেন যে আশেপাশের তিনটি গ্রামে হয় না কোনও কালীপুজো। মূর্তি তো দূরের কথা গ্রামের কোন বাড়িতে মা কালীর ছবি লাগানো ক্যালেন্ডারও রাখা হয়না।
কথিত আছে প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় সিঙ্গুরের ডাকাত কালী মন্দিরের। এই প্রাচীন কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে বহু গল্প ছড়িয়ে আছে। রঘু অথবা গগন ডাকাত ঘট স্থাপন করে পুজো শুরু করে। তখন ঘট পুজোয় হত, মন্দির ছিল না। অতীতে সেই সময় এখানে এক গভীর জঙ্গল ছিল। রঘু ও গগন ডাকাত এই স্থানে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। বর্ধমানের মহারাজা মা কালীর স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পড়ে প্রতিমা ও মন্দির নির্মিত হয়। অতীতে এখানে নরবলি হত এমনটাই জনশ্রুতি আছে। রাতে মা সারদা কে খেতে দেওয়া হয় চাল ও কড়াই ভাজা। সেই থেকে মায়ের প্রসাদ হিসেবে চাল–কড়াই ভাজাই দেওয়া হয়।মন্দির কমিটির সম্পাদক মদন কোলে বলেন, ডাকাতি কালীমন্দির ছাড়া মল্লিকপুরে, জামিনবেড়িয়া ও পুরুষোত্তমপুর এই তিন গ্রামে হয়না কোন ও কালীপুজো। এমনকি গ্রামের কারোর বাড়িতে নেই কোন কালীর মূর্তি ও। মা কালীর ছবি লাগানো ক্যালেন্ডার লাগানেরেও সাহস পান না স্থানীয়রা। এতটাই জাগ্রত সিঙ্গুরের ডাকাত কালীমন্দির। এই প্রতিমার পুজো ছাড়া অন্য প্রতিমার পুজো করতে সাহস পায় না এলাকার মানুষজন।
জনশ্রুতি রয়েছে, অসুস্থ ঠাকুর রামকৃষ্ণকে দেখতে মা সারদা কামার পুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বর যাচ্ছিলেন, তখন পথে রঘু ডাকাত ও গগন ডাকাত মায়ের পথ আটকে দাঁড়ায়৷ ডাকাতি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য৷ সেই সময় রক্ত চক্ষু মা কালীর মুখ দেখতে পায় ডাকাতরা। ভুল বুঝতে পেরে মা সারদার কাছে তারা ক্ষমা চায়। ততক্ষণে সন্ধে নেমে আসায় সেই রাতে ডাকাত দের আস্তানায় মা সারদাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় ডাকাতরা। মা সারদাকে রাতে খেতে দেওয়া হয় চাল ভাজা ও কড়াই ভাজা। সেই থেকে কালীপুজোর দিনে মদ ও চাল কড়াই ভাজা দেওয়ার প্রচলন হয়। এছাড়াও পুজোর প্রসাদ হিসাবে লুচি ভোগ, ফল দেওয়া হয়। বংশ পরম্পরায় তাঁরা সাত পুরুষ ধরে মায়ের পূজা করে আসছেন। আগে কোনও মূর্তি ছিলনা, ঘটে পুজো হত। পরবর্তীকালে নিকটবর্তী চালকেপাটি বাঁকিপুর গ্রামের মোড়লরা বর্তমানের সুদৃশ্য আটচালা মন্দিরটির নির্মাণ করে দেন।
মন্দির গাত্রে টেরাকোটার কাজ লক্ষ্যণীয়। তিন খিলান যুক্ত এই মন্দিরের একটিই প্রবেশ দ্বার। মন্দির সম্মুখে চাঁদনী স্বরুপ একটি নাটমন্দির রয়েছে। দীপাবলি কালীপুজো হয় তন্ত্রমতে। চার প্রহরে চারবার মায়ের পুজো হয়। নয় রকম বলি দেয়া হয়। এক কালে যথেচ্ছ ছাগবলি চালু থাকলেও বর্তমানে তার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
মন্দিরের আরেক বিশেষত্ব হল, কালি পুজোর দিন শুদ্রদের আনা গঙ্গার জল মন্দিরের দরজা বন্ধ করে ঘটে দেওয়া হয়। সেই জল সারা বছর থাকে। চার প্রহরে চার বার পুজো ও ছাগ বলি হয়। রক্ত চক্ষু এই মুর্তি তৈরী করে ছিলেন রঘু ডাকাত ও গগন ডাকাত। পরে স্বপ্নাদেশে সিঙ্গুর থানার চালকেবাটি গ্রামের মোড়লরা এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন৷
প্রাচীনকালে সিঙ্গুর সরস্বতী নদী তীরে মহারাজা সিংহবাহুর রাজধানী সিংহপুর বলে প্রসিদ্ধ ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে মহারাজ সিংহবাহু সিংহপুরে রাজত্ব করতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বিজয়সিংহ পিতার অবাধ্য হওয়ায় পিতাকর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সাতশত যুদ্ধকুশল অনুচর নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করেন। তাম্রপর্ণি দ্বীপে অবতরণ করে সেখানকার অধিবাসীদের পরাস্ত করে লঙ্কাদ্বীপ অধিকার করেন। তিনি তাম্রপর্ণি বা লঙ্কাদ্বীপ অধিকার করে, রাজকন্যাকে বিয়ে করে সেখানকার রাজা হন। রাজা হওয়ার পর তিনি ওই দ্বীপের নাম রাখেন সিংহল।
এই মন্দির ডাকাত সনাতন বাগদী না গগন সদ্দার নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ডাকাত কালী মন্দিরটি দক্ষিণমুখী, আটচালা মন্দির। মন্দিরের দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, বিষ্ণুর দশাবতারের মূর্তি ও পোড়ামাটির লতাপাতা খোদিত রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রায় নয় ফুট উচ্চ বিগ্রহ অবস্থিত। গর্ভগৃহে ঢোকার একটিই প্রবেশদ্বার গর্ভগৃহের সামনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ত্রিখিলান যুক্ত প্রবেশ পথটি অবস্থিত। আগে মন্দিরের সামনের দিকটি টেরাকোটা অলংকরণে অলংকৃত ছিল। কিন্তু এখন সেই টেরাকোটার সামান্যই অবশিষ্ট আছে। মন্দিরের সামনে চাঁদনী আকৃতির নাটমন্দির আছে। মন্দির চত্বর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এই মন্দিরে কালি সিদ্ধেশ্বরী নামে বিখ্যাত। ডাকাত কালী মন্দিরের রাস্তার বিপরীত দিকে একটি শিবমন্দির আছে। শিবমন্দিরটি কালীমন্দিরের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান মন্দির থেকে মজে যাওয়া সরস্বতী নদী এখন প্রায় এক কিলোমিটার দূরে প্রবাহিত রয়েছে। মন্দির আজও বিরাজমান।