আজ কালীকথায় গঙ্গা তীরের জেলা হুগলি। হুগলির ঐতিহ্যমণ্ডিত জনপদ হল কোন্নগর। এখানেই বিরাজ করেন শ্রী শ্রী শকুন্তলা রক্ষাকালী মা। শতাব্দী প্রাচীন এই শকুন্তলা কালী মায়ের পুজো শুরু করে একদল ডাকাত। ঠগী ও ডাকাতে ভরপুর ছিল গঙ্গা তীরবর্তী এই জনপদ। মায়ের কাছে নরবলি দিয়েই ডাকাতি শুরু করতে বেরোত ডাকাতের দল। কথিত আছে, মায়ের থানটি অর্থাৎ ডাকাতদের ডেরা যে গাছের নীচে ছিল সেখানে থাকত শকুনের দল। সেই থেকে মায়ের নাম হয় শকুন্তলা। হুগলি জেলার অন্যতম জনপ্রিয় এই প্রাচীন কালীপুজো সেঞ্চুরি পার করে ফেলেছে।
সমগ্র কোন্নগরবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা মায়ের পুজোর জন্য। কোন্নগরের শকুন্তলা কালী বাড়ির পুজো বহু বছর পুরনো। আজ থেকে ১৩০-১৩২ বছর আগে কালীতলা এলাকায় এই পুজো শুরু হয়। হুগলি জেলার কোন্নগরের প্রাচীন পুজোরগুলির মধ্যে সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী পুজো হল শকুন্তলা রক্ষাকালী মায়ের পুজো। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়া বা তার ঠিক পরে যে শনিবার আসে, সেদিনই মায়ের বাৎসরিক পুজো হয়। শুধুমাত্র কোন্নগর বা হুগলিই নয় এই পুজো ব্যাপ্তি সারা পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, সেই সঙ্গেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্ত সমাগম ঘটে এখানে। পুজোর দিন হাজার হাজার মানুষের ভিড় করে, অনেক বড় উৎসবকেও হার মানায় এই পুজোর জনসমাগম। এই পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দিরে প্রাঙ্গণের দুই পাশের মাঠে বড় মেলা বসে। আগে এই মেলা ১ মাস ধরে হলেও বর্তমানে নানা কারণে তা ৪-৫ দিন ধরে হয়।
বহ প্রাচীন জনপদ এই শহর কোন্নগর। কথিত আছে ডানকুনির বিশাল জলার এক কোণে এই শহরের অবস্থান বলে। প্রথমে এই শহরের নাম রাখা হয় কোণের গড়। তারপর নাম পরিবর্তিত হয়ে তা হয়ে কোন্নগর। এই কোন্নগরের বিশালক্ষী সড়কের টোল বাড়িতে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিয়মিত সংস্কৃত পড়াতে আসতেন। এই কোন্নগরে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের একাধিকবার পদধূলি পড়েছে। অবন ঠাকুরের বাগানবাড়িও এখানে। এই কোন্নগরেই ঋষি অরবিন্দের মামারবাড়ি, এখানেই জন্মেছিলেন ডিরোজিওর নব্যবঙ্গের এক সদস্য শিবচন্দ্র দেব, পুরোনো ব্রহ্মসমাজ, ইতিহাসের উপাদান এই শহরের পরতে পরতে।
এই শহরের মা রক্ষাকালী হলেন দেবী দক্ষিণা কালিকার নাগরিক রূপ। প্রাচীনকাল থেকেই এই বাংলায় কোন নগর বা লোকালয়ের রক্ষার জন্য পাড়ার রাস্তার তিনমাথার মোড়ে মাকে পুজো করার রেওয়াজ। কোন লোকালয়ের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে দেবী দক্ষিণা কালীকেই রক্ষাকালী হিসাবে পুজো করা হয়।
ইতিহাস বলে ১৮৩৬-এর পর ইংরেজ সরকার যখন রেললাইন বসানো শুরু করে, তারপরেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত গোটা কোন্নগর নবগ্রাম অঞ্চল ছিল ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা, মাঝখান দিয়ে সরু পথ, জঙ্গলের মধ্যে এলাকা ভাগ-ভাগ করে ছিল বিভিন্ন ডাকাত আর ঠগীদের ডেরা। হুগলি তো ডাকাতের জন্য বিখ্যাত ছিলই। বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়া বা তার ঠিক পরের শনিবারের রাতে এই ডাকাতে কালীকে পুজো দিয়ে সারা বছরের মতো ডাকাতির ব্যবসা শুরু করত ডাকাত ও ঠগীর দল। মস্ত অশ্বত্থ গাছের নীচে মায়ের থান। পড়ে থাকে রক্তমাখা হাঁড়িকাঠ। গাছের ওপরে বাস করে দলে দলে শকুন, তাই এই থানের আরেক নাম শকুন্তলা মায়ের থান, সেই থেকে মায়ের নামও শকুন্তলা রক্ষাকালী মা। চন্দ্রভূক অমাবস্যার রাতে কেউ বা কারা এসে পুজো দিয়ে যেত, ছাগবলি, মহিষবলি, কখনও কখনও বা নরবলিও দিত মনস্কামনা পূরণের জন্য। পুজো শেষে গায়ে রেড়ীর তেল মেখে হাতে লাঠি অথবা কাটারি নিয়ে ডাকাতরা বেরিয়ে পড়ত ডাকাতিতে।
সেই কাল থেকেই কথিত মা সূর্যের মুখ দেখেননা। তাই নিয়মমত মূর্তি বানানো হয় সূর্যাস্তের পর, দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলে পুজো শুরু আর সূর্যোদয়ের আগেই মায়ের বিসর্জন দেওয়া হয়। এখানকার মানুষের বিশ্বাস মায়ের কাছে যে যা চান তাই পান। মা খুব জাগ্রত। মায়ের মূর্তি গঠনেও এক তারতম্য আছে, মাটিতে দুধ ও দেশী মদ মিশিয়ে মূর্তি তৈরী হয়। পূজোর আগের দিন রাত ১২ টার পর থেকেই অগণিত মানুষের ভিড় হয় জল ঢালা পর্বে। গঙ্গায় ডুব দিয়ে জল নিয়ে এসে বেদীতে জল ঢালা চলে সারা রাত জুড়ে। অনেক মনোষ্কামনা মতো দন্ডি কেটে মন্দিরের উদ্দেশ্যে যায়। পরেরদিন বিকাল ৫.৪৫ এর মধ্যে মায়ের সাজ শেষ করে শ্রী বাদল পালের গোলা থেকে মাকে মন্দিরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় বরণ করে বেদীতে বসিয়ে পূজা শুরু হয়। তারপর পশু বলি শুরু হয়। অনেকের মানত থাকে মায়ের কাছে আর সেই মানত পশুবলির মাধ্যমে পূর্ণ করেন। সারারাত কয়েকশ বলি হওয়ার পর শুরু হয় যজ্ঞ আহুতি। ভোর ৫ টায় সূর্য ওঠার আগে মায়ের প্রায় ১০০ ভরি সোনার গহনা খোলা হয়ে গেলে বিসর্জন দেওয়া হয়। আবার শুরু হয় এক বছরের প্রতীক্ষা।
এই পুজো সার্বজনীন হয়ে ওঠাও এক মস্ত কাহিনী। আধুনিক রূপে কোন্নগরের শকুন্তলা কালী মাতার পুজো শুরু হয় ১২৯৭ বঙ্গাব্দে। এখন যেখানে মায়ের মন্দির, সেইখানেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শনিবার দিন প্রথম পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন কোন্নগরের ওই স্থানের বাসিন্দারা যৌথভাবে একটি বারোয়ারী পুজো চালু করেছিলেন। আজ পর্যন্ত মায়ের পুজো ওই বারোয়ারীভাবেই হয়ে আসছে। মন্দির শকুন্তলা শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মাতা বারোয়ারী নামে ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে নথিভুক্ত হয়।
লোক মুখে শোনা যায়, একদিন বাঞ্চারাম মিত্র লেনের চক্রবর্তী বাড়ির দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পৌরহিত্যের কাজ সেরে উত্তর কোন্নগর থেকে গড়ের খানার ওপর দিয়ে তিনি হেঁটে আসছিলেন। এখন এই গড়ের খানা জায়গাটি হল কালিতলা ক্যাম্পের পাশের অরবিন্দ বিদ্যাপীঠ স্কুল। গড়ের খানার ওপর দিয়ে আসার সময়, তাঁর বাড়ির রাস্তা বাঞ্চারাম মিত্র লেনে ঢোকার আগে দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এলোকেশী শ্যামলা এক অপরূপা নারী মূর্তিকে হটাৎ দেখতে পান। ওই নারী তাঁর পথ আটকে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে তখনই তিনি ওই নারী মূর্তির অঙ্গ থেকে জ্যোতি নির্গত হতে দেখেন। চমকে ওঠেন। সাময়িক ঘোর কাটিয়ে উঠেই তিনি ওই নারীমূর্তিকে বলেন, "তুমি কে মা? কেন এইভাবে আমার পথ আটকে দাঁড়ালে কেন?" সেই অপরূপা নারী কোন উত্তর না দিয়ে রহস্যের হাসি হেসে কিছুটা দূরে গিয়ে মিলিয়ে যান। এরপরে আবার স্বপ্নে ওই নারীমূর্তিকে দেখেন তিনি এবং দেখেন সেই নারীমূর্তিকে ওই একই জায়গায় মিলিয়ে যেতে দেখেন। পরের দিন তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের ডেকে তাঁর স্বপ্নের কথা বললে, সবাই মিলে স্থির করে ওই নারী মূর্তি যে জায়গায় মিলিয়ে গিয়েছে। ওখানেই স্বপ্নে দেখা রূপের আদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করা হবে।
যদিও প্রথম বছর পুজো ঘটেই হয়েছিল। এখন যেখানে স্থায়ী মন্দির ওখানে আগে বট-অশ্বত্থ-পাকুড় গাছের জঙ্গল ছিল আর গাছে শকুন বসে থাকত। ওখানেই মায়ের অস্থায়ী মন্দির বানিয়ে প্রথম পুজো শুরু হয়েছিল বলেই মায়ের নাম শকুন্তলা রক্ষাকালী মাতা হয়েছিল আগেই বলেছিল।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই প্রচুর ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ায় মায়ের মাহাত্ম্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আজও কোন্নগরের মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন মা খুব জাগ্রত। মায়ের কারণেই কোন্নগর আজ পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
দেবীর মূর্তি গঠনেও একাধিক বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, মাটিতে দুধ ও দেশী মদ মিশিয়ে দেবী মূর্তি তৈরি হয়। আজও মন্দির চত্বরে হেঁটে গেলে রীতিমতো শিহরিত হতে হয়। আজও দূর-দূরান্ত থেকে বহু ভক্ত আসেন মায়ের পুজো দিতে। বৈশাখের বাৎসরিক পুজোয় মায়ের বেদিতে জল ঢালেন ভক্তরা। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভক্তদের কাঁধে চড়ে জয় মা জয় মা ধ্বনির মধ্যে দিয়ে মা মন্দিরে তাঁর বেদিতে এসে বসেন। কিন্তু আজও বৈশাখ মাসের বিশেষ তিথিতে হুগলী জেলার কোন্নগরে কেবলমাত্র এক রাতের জন্য আসেন শকুন্তলা রক্ষাকালী মা। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁর বিসর্জন হয়।