মহাপ্রভুর জীবন অবসানের পর কী হয়েছিল পরম ভক্ত সনাতন গোস্বামীর

বৈষ্ণব সাধক সনাতন গোস্বামীর জীবন যেন কাব্য উপন্যাসের নায়কের মতো। নবাবের প্রধানমন্ত্রী থেকে মোহ মায়া সমস্ত কিছু ত্যাগ করে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার জীবন কাহিনী মানুষকে ভক্তি রসে প্লাবিত করে। চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ পারিষদ সনাতন গোস্বামীর নাম সম্পর্কে সকলেই কমবেশি জানেন, কিন্তু যেটা জানা নেই সেটা হল কীভাবে একজন নবাবের প্রধানমন্ত্রী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, রাজ কার্যে মন উঠে যাওয়ায় কী বিপদ নেমে এসেছিল তাঁর ওপর? কী ভাবেই বা সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পান তিনি?

গৌড়ের মুকুন্দদেবের দুই পৌত্র অমর ও সন্তোষ নবদ্বীপে গিয়ে বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে শাস্ত্রের শিক্ষা নিতেন। পরবর্তীকালে রত্নাকর বিদ্যা বাচস্পতির টোল থেকে অমর ও সন্তোষ শাস্ত্রের একাধিক দুরূহ তত্ত্ব পড়াশোনা করেন। সপ্তগ্রামে পিতামহ মুকুন্দ দেবের বন্ধু ফকরুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে তারা ফারসি ভাষায় শিক্ষা অর্জন করেন। এত শিক্ষা লাভ করবার পরে অমর রায় বা সাকর মল্লিক গৌড়ের নবাব হুসেন শাহের দরবারে প্রধানমন্ত্রী হন, অন্যদিকে সন্তোষ রায় ‘দবীর খাস’ নামে নবাবের অর্থ সচিব পদে বহাল হন।

১৫৩৯ খ্রীস্টাব্দে উড়িষ্যা স্বাধীন দেশ ছিল, সেইসময় হুসেন শাহের সেনাপতি ইসমাইল গাজী উড়িষ্যা জয় করতে যান অমর রায়কে সঙ্গে নিয়ে। সেই সময় পাঠান সৈন্যরা বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ফেলে, অনেক বিগ্রহ ভেঙে ফেলে, চোখের সামনে এইভাবে মন্দির ও বিগ্রহের ধ্বংসলীলা দেখে অমর রায় ভীষণভাবে দুঃখে ভেঙে পড়েন , রাজ কার্যে তার আর মন বসে না, বিতৃষ্ণা চলে আসে। এই ঘটনার বহু আগে অমর রায় শুনেছিলেন, নবদ্বীপে একজন মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, লোকে তাকে ঈশ্বরের অবতার বলে পূজা করে।

sanatan-1

অমর রায় নিজের মনের যাবতীয় আকুলতা জানিয়ে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে একটি চিঠি লেখেন এই চিঠি পড়েই মহাপ্রভু বুঝতে পারেন যে অমর রায়ের মনের আগুন সহজে নিভবে না। এরপর মহাপ্রভু নিজেই একদিন গৌড়ের দিকে যাত্রা করছিলেন, পথে এত ভিড় হল যে নবাব ঘটনা বুঝতে না পেরে অমর রায়কে পাঠালেন বিষয় বুঝে আসার জন্য। অমর রায় ছদ্মবেশে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে গেলেন এবং তার মনের বাসনা পূর্ণ হল। ফিরে এসে অমর রায় নবাবকে বললেন , ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই, একজন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী এসেছেন, তাঁকে প্রণাম করবার জন্যই হাজার হাজার লোক পথে ভিড় করছেন। 

সেদিন রাত্রে অমর রায়ের চোখে ঘুম এলো না, দাদার হাবভাব দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন নবাবের অর্থ সচিব দবীর খাস বা সন্তোষ রায়। তিনি দাদাকে কারণ জিজ্ঞেস করলেন দাদা তাকে মহাপ্রভুর ঘটনা সব বললেন, শুনে সারারাত সন্তোষ রায়ের চোখেও ঘুম এল না। এরপর গভীর রাত্রে দুজনেই সাধারণ বেশে গিয়ে হাজির হলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে। মহাপ্রভু তখন রামকেলি গ্রামে গাছের তলায় বসে রাত্রি যাপন করছিলেন, দুই ভাই এসে মহাপ্রভুর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়েন, মহাপ্রভুকে তারা বলেন আমাদের মুক্তির পথ দেখাও প্রভু। মহাপ্রভু তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। 

মহাপ্রভু বলেন, তোমরা উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারী হয়েও এমন দীনতা যখন বরণ করতে পেরেছ, তখন পতিত পাবন ভগবান তোমাদের উদ্ধার করবে‌ন‌ই। অমর রায় ও সন্তোষ রায় তখন কান্নাকাটি করেন আর বলেন, 'আমরা ব্রাহ্মণ বংশে জন্মেছি কিন্তু অর্থ, নাম ও প্রতিপত্তির মোহে পড়ে নিজেদের ধর্ম পর্যন্ত বিসর্জন দিতে বসেছি। আমাদের বাঁচাও প্রভু।' শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তখন বলেন, 'তোমরা আজ থেকে নতুন জীবন লাভ করলে, তাই তোমাদের নতুন নামকরণ করলাম সনাতন আর রূপ, আজ তোমরা ফিরে যাও, সময় হলেই তোমাদের কাছে ডেকে নেব। '

মহাপ্রভু বললেন বটে, কিন্তু যে মন একবার খাঁটি হীরার সন্ধান পেয়ে যায় , তার মন কি নকল পাথরে বসে? গৌড়ে গিয়েও দুই ভাই রাজকার্যে মন দিতে পারলেন না তাদের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। দাদা সনাতনের চেয়ে ছোট ভাই রূপের মন যেন বেশি চঞ্চল হয়ে উঠল, সেই কথা সে দাদাকে বলে চাকরি ছেড়ে গৌড় ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে গৌড়ের একজন ধনী শেঠের কাছে রেখে গেলেন , ১০ হাজার টাকা কারণ তিনি জানতেন সনাতনের উপর বিপদ আসবে। তাই গৌড় ত্যাগ করার আগে তিনি শেঠকে বলে গেলেন, সময় বুঝে যেন টাকাটা সে সনাতনকে দেয়।

গৌড়ের নবাব কিছুদিন পর বুঝতে পারলেন অর্থ সচিব সন্তোষ রায় নিখোঁজ, প্রধানমন্ত্রীও কয়েক দিন ধরে দরবারে আসেন না। নবাবের মনে হল তাদের মনে কোন গুপ্ত অভিসন্ধি আছে। তাই নবাব সনাতনকে বন্দী করলেন এবং বিচারে তার কারাদণ্ড হল কিন্তু একদিন রাত্রে বেলায় সনাতন দেখলেন কারাগারের দরজা খুলে গিয়েছে। আসলে যে শেঠকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল সেই টাকায় কারাগারের প্রহরীদের বশ করা হয়েছে। সেই সময় বিভ্রান্ত সনাতন কী করবেন বুঝতে না পেরে পথে বেরিয়ে পড়লেন, তবে কোথায় যাবেন? কিছু ঠিক নেই। শেষমেষ তিনি কাশীর পথে ধরলেন। কাশীতে যখন তিনি পৌছলেন তারা কিছুদিন আগেই সেখানে চৈতন্যদেব এসেছেন, চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা হল সনাতনের, চৈতন্যদেবে আবেগে জড়িয়ে ধরলেন সনাতনকে। 

sanatan-2

যমুনার তীরে একটি ছোট্ট কুঁড়ে বেঁধে সনাতন থাকতেন। যমুনার নীল জল দেখে তার মনে পড়ত কৃষ্ণের কথা। সব সময় কৃষ্ণ নাম জপ করতেন। শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলা অবলম্বনে নানা স্তব করতেন ভক্তি রসে প্লাবিত হয়ে, তাঁর রচিত এই স্তবগুলোই হয়ে ওঠে দশম চরিত বা লীলা স্তব। বৃন্দাবনে যমুনার তীরে সনাতন বহুদিন যোগমগ্ন হয়ে সাধনা করেন। দৈবক্রমে একদিন তিনি একটি পরশপাথর পেলেন সেটা ছোঁয়াতে সমস্ত কিছু সোনা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার কাছে সেই পাথরের কোনও মূল্য নেই। একবার এক গরীব ব্রাহ্মণ সাহায্য প্রার্থী হয়ে এলেন তাঁর কাছে, সনাতন তাকে সেই পরশপাথর দান করলেন।

এতে ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে ভাবলেন এমনকি অমূল্য ধন আছে সনাতন গোস্বামীর কাছে? যার কাছে মহামূল্য পরশ পাথর‌ও তুচ্ছ। তিনি তখন সনাতনের পায়ে পড়ে বললেন, আমাকেও সেই ধন দান করুন। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আদেশে সনাতন গোস্বামী বৈষ্ণব দর্শন ও সাধন ভজনের গ্রন্থ প্রচারে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তার নিজের লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে থেকে বৃহৎ ভাগবতামৃত ও বৃহৎ বৈষ্ণবতোষণী টীকা উল্লেখযোগ্য। 

বৃন্দাবনে যত কাল সনাতন গোস্বামী ছিলেন, ততকাল তিনি ব্রজ পরিক্রমায় বের হতেন। তবে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের দেহ রক্ষার পর তিনি অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন, শেষের দিকে একটি বৃক্ষতলে কুটিরে বেঁধে থাকতেন। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দের আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনে মহাসাধক সনাতন গোস্বামী দেহ রক্ষা করেন। তাঁর প্রয়াণে বৈষ্ণব ভক্ত সমাজে আর‌ও একবার হাহাকার সৃষ্টি হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...