সনাতন গোস্বামী ও রূপ গোস্বামী দুই ভাইয়ের একজন ছিলেন নবাবের প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন ছিলেন নবাবের অর্থ সচিব- ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে তারা অর্থ, নাম ও প্রতিপত্তির মোহে নিজেদের ধর্ম ভুলতে বসেছিলেন, নবাবের কার্যকলাপের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তারা আর নিজেদের চোখের সামনে অন্য রাজ্য জয় করতে প্রচুর হিন্দু মন্দির ধ্বংস হতে দেখেছিলেন- কিন্তু এতকিছুর পরেও যখন এই দুই ভাইয়ের মন উদ্বেল হয়ে উঠল! তাদের মনের মধ্যে অনুশোচনা ও দুঃখের সৃষ্টি হল, তখন এই দুই ভাই ঠাঁই পেলেন মহাপ্রভুর শ্রী চরণে! ভাবান্তর হল তাদের এবং পরিবর্তন হল জীবন দর্শন।
মহাপ্রভু অবশ্য তাদের বলেছিলেন, তোমরা রাজকার্য কর, সময় হলে আমি ডেকে নেব। কিন্তু রাজকার্যে মন বসল না রূপ, সনাতনের। সনাতনের চাইতে রূপের অর্থাৎ সন্তোষ রায়ের মন যেন আরও বেশি চঞ্চল হয়ে উঠল। দাদার কাছে সেই কথা স্বীকার করে, সে চাকরি ছেড়ে গৌড়ে চলে গেল, কিন্তু এই চলে যাওয়ার আগের প্রেক্ষাপট রচনা হয়েছিল বহু আগেই। শ্রাবণের বর্ষণমুখর এক রাতে অন্ধকারের মধ্যে গৌড়ের রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আরোহী দবীর খাস অর্থাৎ গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের অর্থ সচিব সন্তোষ রায়! এক হঠাৎ জরুরি তলবে নবাব তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন দেখা করার জন্য।
রাস্তায় এক হাঁটু জল ভেঙে বাহকরা যখন যাচ্ছেন তখন একটা কুটিরের মধ্যে থেকে এক দম্পতির কথোপকথন ভেসে এল," এই দুর্যোগে এত জল ঠেলে কে যাচ্ছে গো? চোর না কুকুর? নাকি কোনও হতভাগ্য গোলাম রাজার হুকুম পেয়ে চলেছে দেখা করতে! "- এই শ্লেষোক্তি শুনে দবীর খাস চমকে উঠলেন! নিজের প্রতি ধিক্কার হল তার! সত্যি তো চোর বা কুকুরের থেকেও অধম তিনি! সারা জীবন ধরে তিনি শুধু অর্থ উপার্জন করে গিয়েছেন কিন্তু ইষ্ট চিন্তা করবার সময় পেলেন কোথায়?
নবাবের গোলামী করেই জীবন কেটেছে রূপ গোস্বামীর! জীবনের উপর বীতস্পৃহ হয়ে উঠলেন তিনি ঠিক এই সময় থেকে! মন উতলা হয়ে উঠল তার! একবার গৌড়ে চৈতন্যদেব পদার্পণ করেন, তখন তাকে দেখতে ছোটেন সন্তোষ রায়, তার সাথে যায় তার পাঁচ ছয় বছরের বড় দাদা অমর রায়। মহাপ্রভু সন্তোষ রায় নতুন নামকরণ করেন রূপ গোস্বামী ও অমর রায়ের নতুন নামকরণ করেন সনাতন গোস্বামী।
এরপর রূপ যখন সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে যায় তখন তার সঙ্গী হয় তার ছোট ভাই বল্লভ বা অনুপম! হরিনাম গাইতে গাইতে দুজনে পথ দিয়ে চলতে থাকে ও তারা দুজনে এসে উপস্থিত হয় প্রয়াগে। সেখানে তারা দেখে হরিনাম সংকীর্তনে চারিদিক মুখরিত হয়ে আছে, কৃষ্ণ প্রেমের বন্যায় চৈতন্যদেব সকলকে ভাসিয়ে দিয়েছেন, চৈতন্যদেবকে দর্শন করে রূপ আর অনুপম জগত সংসার ভুলে গেলেন আর প্রভুও তাদের দেখে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে বললেন, " কৃষ্ণের কী অপার করুণা তোমাদের ওপর! তোমাদের এবার বিষয়কূপ থেকে উদ্ধার করলেন! মহা ভাগ্যবান তোমরা!"
রূপ বললেন," প্রভু, আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চল। তোমার সঙ্গে থেকে তোমার সেবা করব। " মহাপ্রভু বললেন, " তোমার এ দুর্বলতা ত্যাগ করতে হবে। তোমার কাজ যে এখনও বাকি। তোমাকে লিখতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে। " রূপ বললেন,"রচনা করবার শক্তি যা ছিল, নিরস রাজকার্যের মধ্যে পড়ে তা শুকিয়ে গেছে, আমার দ্বারা কি সৃষ্টি হবে?" মহাপ্রভু বললেন, " সর্ব রসের আকর শ্রীকৃষ্ণকে সর্বদা স্মরণ কর। ভক্তির রস আপনি উথলে উঠবে। তুমি বৃন্দাবনে যাও। যত কষ্টই হোক বৃন্দাবনেই তুমি থাকবে।"
এরপর রূপের মাথায় হাত দিয়ে তার মধ্যে শক্তি সঞ্চার করলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। তারপর তাকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি নিজে চললেন কাশীর পথে। রূপ ছোট ভাইকে নিয়ে বৃন্দাবনের পথে গেলেন, ভোগ বিলাসের সমস্ত বাসনা ত্যাগ করে তারা বৃন্দাবনে থাকতে শুরু করলেন। একইসাথে মনে মনে রূপ দাদা সনাতনের খবর জানবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল, তিনি খুব ভালো করেই জানতেন তিনি যেভাবে নবাবের দরবার থেকে পালিয়ে এসেছেন তাতে বিপদ একটা নেমে আসবে তার দাদার ওপর!
দাদার সন্ধান করতে তাই তিনি তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন, কিন্তু বৃন্দাবন, কাশী ইত্যাদি তীর্থস্থান ঘুরেও তিনি সনাতনের কোথাও কোনও সন্ধান পেলেন না। এরপর একসময় অনুপমকে নিয়ে রূপ গোস্বামী গৌড়ের রামকেলিতে যাত্রা করলেন বিষয় সম্পত্তির ব্যবস্থা করবার জন্য! সেখানে অনুপমের মৃত্যু হল! শোকে অধীর হয়ে রূপ চিরদিনের জন্য গৌড় ত্যাগ করলেন ও শ্রীচৈতন্য নীলাচলে আছেন জেনে নীলাচলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে রূপ বললেন- " এই নিঃসঙ্গ জীবন আর কেমন করে কাটাব? বাকি জীবনটা তোমার সেবা করার অনুমতি দাও।"
মহাপ্রভু বললেন, "তোমার জীবন তো আমার চরণ সেবার জন্য নয় রূপ। তোমার কাজ কাব্য রচনা।" মহাপ্রভুর আদেশ পেয়ে রূপ এবার আরও উৎসাহে কাব্য সাধনা করতে শুরু করলেন। গৌড়ে থাকতেই তিনি হংসদূত ও উদ্ধব সন্দেশ নামে দুখানি কাব্য লেখেন। এইবার চৈতন্যদেবের নির্দেশে 'বিদগ্ধ মাধব' ও 'ললিত মাধব' নামের নাটক রচনা করেন। তবে তাঁর লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল 'হরিভক্তি - রসামৃত সিন্ধু' ও 'উজ্জ্বল নীলমণি'। দশ মাস পুরীতে কাটানোর পর যখন বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন রূপ গোস্বামী। তখন সেখানে সনাতনের সঙ্গে তার দেখা হয় ও তারপর দুজনের কঠোর সাধনা শুরু হয়।
রূপ প্রাচীন শাস্ত্র পাঠ করে জানতে পারেন যে বৃন্দাবনে যোগীপীঠ নামক স্থানে গোবিন্দদেবের বিগ্রহ রয়েছে, যোগমগ্ন হয়ে তিনি গোমাটিলা স্তূপে সেই বিগ্রহের সন্ধান পান, এরপর গোমাটিলা একটি তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। এই খবর মুহূর্তের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বৈষ্ণবগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে আসেন সেখানে। মহাপ্রভু এই খবর পেয়ে খুশিতে স্থির হতে না পেরে বৃন্দাবনে এক ভক্তকে তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেন। সেখানে তৎক্ষণাৎ মন্দির বানানো হল, কুটির থেকে মন্দিরে অধিষ্ঠিত হলেন গোবিন্দ দেব, পরে রূপ গোস্বামীর জীবিত কালেই গোবিন্দ মূতির পাশেই শ্রী রাধিকা মূর্তি স্থাপিত হয়। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে সনাতন গোস্বামীর দেহ রক্ষার কয়েক মাস পরেই ইহলীলা ত্যাগ করে বৈকুন্ঠ ধামের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন রূপ গোস্বামী।
রূপ গোস্বামীর জীবন আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে কীভাবে গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের অর্থ সচিব তার যাবতীয় মোহ ত্যাগ করে হয়ে উঠেছিলেন পরম বৈষ্ণব সাধক! তাঁর জীবন তাই সব সময় অনুকরণীয় হয়ে থাকবে বৈষ্ণব সাধকগণের কাছে।