রাক্ষসরাজ রাবণের শিব তপস্যা ও বরলাভের কাহিনী

শিব পুরাণের 'জ্ঞান সংহিতার' অষ্টবিংশতি অধ্যায়ে রয়েছে রাবণ কীভাবে শিবের তপস্যা করেছিলেন ও বরলাভ করেছিলেন আজকে সেই কাহিনি বলব। অষ্টবিংশতি অধ্যায়ের শুরুতে সূত ঋষিদেরকে বৈদ্যনাথেশ্বর লিঙ্গের কথা বলছিলেন, কীভাবে সেই জ্যোতির্লিঙ্গের আবির্ভাব হল এবং এই আবির্ভাবের সঙ্গে লঙ্কেশ্বর রাক্ষসরাজ রাবণের যোগসূত্র।

সূত বললেন, এইবার আমি বৈদ্যনাথেশ্বরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করছি। একদিন ঐশ্বর্য গর্বিত রাক্ষসরাজ রাবণ কৈলাস পর্বতে মহাদেবের আরাধনা করেছিলেন, কিছুকাল আরাধনা করবার পর শিবকে প্রসন্ন করতে পারলেন না তিনি, তখন তিনি বৃক্ষ খন্ডক নামে হিমালয়ের দক্ষিণভাগের এক জায়গায় মাটিতে গর্ত খনন করে এক অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করলেন এবং তাঁর নিকট শিব মূর্তি স্থাপন করতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও যখন ভগবান শিব প্রসন্ন হলেন না তখন রাবণ তার দশটি মাথার মধ্যে থেকে পরপর নয়টি মাথা ছেদন করতে লাগলেন এবং নয়টি মাথা দেওয়ার পর তার শুধুমাত্র আর একটিমাত্র মাথায় অবশিষ্ট থাকল।

দশটি মাথার মধ্যে যখন তার নয়টি মাথা ছেদন করা হয়ে গিয়েছে আরেকটি মাথা বাকি আছে তখন দেবাদিদেব মহাদেব রাক্ষসরাজ রাবণের এই কঠিন তপস্যায়  তুষ্ট হয়ে দর্শন দিলেন এবং বললেন, হে রাক্ষসরাজ তোমার কী অভিষ্ঠ সিদ্ধ করতে হবে বলো?

রাক্ষসরাজ রাবণ তখন বললেন, “হে প্রভু যদি আপনি আমার ওপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে অতুল বল দান করুন আর আমার ছিন্ন মস্তকগুলি আবার দেহ সংলগ্ন করে সেগুলিকে আগের মত করে দিন।”

দেবাদিদেব মহাদেব তখন রাবণের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন তাই তিনি রাবণকে অতুল বল প্রদান করলেন এবং তার নয়টি মস্তক আবার আগের মত তার দেহের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। এরপর রাবণ আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন, রাবণকে আবার নিজের নয়টি মস্তক ফিরে পেতে দেখে দেবতা এবং ঋষিগণ দুঃখিত হয়ে গেলেন। তারা ভাবতে লাগলেন যে, রাক্ষসরাজ রাবণ মহাদেবকে প্রসন্ন করে অতুল বল লাভ করেছে, তখন তার কাছে  আর অসাধ্য কিছুই থাকবে না। এইবার সে আবার আমাদের ওপর অত্যাচার করবে।

দুঃখিত মনে দেবগন এরপর দেব ঋষি নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে দেবর্ষি দয়া করে বলুন দুরাত্মা রাবণ আমাদের উপর পীড়ন করলে আমরা কোথায় যাব?” এই কথা শুনে চিন্তিত নারদ বললেন, দেবগণ আপনারা দুঃখ ত্যাগ করুন, আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।- এই বলে নারদ সেই পথে চলে গেলেন যে পথে রাবণ যাচ্ছিল। নারদ তার বিনা বাজাতে-বাজাতে রাবণের অনুসরণ করে সেই পথে চলে গেলেন এবং রাবণকে দেখে বললেন, হে রাক্ষসরাজ তোমাকে দেখে আমি এক অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করছি! তুমি কোথায় গিয়েছিলে এখন কোথায় বা তুমি  আনন্দিত মনে এত দ্রুত গমন করছ?

বলো এই কথা শুনতে আমার প্রচন্ড কৌতুহল হচ্ছে।

রাক্ষসরাজ রাবণ তখন বললেন, পূর্বে শিবের তপস্যার জন্য কৈলাসে গিয়েছিলাম সেখানে বহুকাল তপস্যা করেছিলাম। কিন্তু যখন তাতে কোনও ফল হল না এবং ভোলেনাথ প্রসন্ন হলেন না, তখন আমি বৃক্ষ খন্ডে গিয়ে তপস্যা করতে শুরু করলাম। গ্রীষ্মকালে অগ্নি মধ্যে, বর্ষায় স্থলভাগে ও শীতকালে জলের মধ্যে থেকে তিন প্রকার তপস্যা করলাম এতেও দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন হলেন না। তখন আমি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে অগ্নি স্থাপন করে একটি পার্থিব শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলাম এবং সেই শিবলিঙ্গ যথাবিধি পুজো করতে লাগলাম এরপরেও ভগবান প্রসন্ন হলেন না দেখে আমি অত্যন্ত দুঃখিত হলাম। তখন আমার নিজের শরীর, বল ও তপস্যার প্রতি ঘেন্না জন্মে গেল তখন আমি সেই স্থাপিত অগ্নিকুন্ডে হোম করলাম।

কিন্তু এত কিছুর পরও দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন হলেন না দেখে আমি অগ্নিতে দেহত্যাগ করবার সংকল্প করলাম। এরপর চন্দন দিয়ে মাথা গুলি শোধন করে আমার নয়টি মাথা পর পর কেটে দিলাম, আমি যখন দশম মাথাটি কাটতে উদ্যত হয়েছি তখনই দেবাদিদেব মহাদেব জ্যোতি স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে আমাকে বর দিতে চাইলেন, আমি তখন তার কাছে অতুল বল  বর হিসেবে প্রার্থনা করলাম। তিনি তখন আমাকে আমার প্রার্থিত বর প্রদান করে আমার ছিন্ন মস্তক গুলি আবার আগের মত আমার শরীরের সঙ্গে জুড়ে দিলেন। আমি তখন আবার আগের মত হয়ে গেলাম এবং একইসাথে দেবাদিদেব মহাদেবের বর লাভ করলাম। দেবাদিদেব মহাদেব আমাকে বর দান করে সেই স্থানে অবস্থান করলেন। এই দেবাদিদেব মহাদেব বৈদ্যনাথেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ।

রাক্ষসরাজ রাবণের এই কথা শুনে দেবতাদের হিতসাধনের জন্য নারদ তখন বললেন, রাক্ষসরাজ তোমায় একটা কথা বলছি শোনো। তুমি একথা কখনই ভেব না যে মহাদেব তোমার হিতসাধন করেছেন। কারণ শিব হচ্ছে উন্মত্ত। উন্মত্ত কি না বলে তার কথা কখনও বিশ্বাস যোগ্য হতে পারে না। তুমি এখন ত্রিভুবন জয়ের ইচ্ছা ত্যাগ করে কৈলাসে ফিরে যাও। নিজের হিতের জন্য কৈলাস পর্বতকে তোলার চেষ্টা করো। সব কিছু সমেত সমগ্র পর্বতটিকে তুলে আবার সেটিকে সেখানে স্থাপন করো। আমার কথা বিশ্বাস করো, তা হলে তোমার অতুল বলের পরীক্ষা হবে এবং তোমার হিত হবে।

নারদের কথা সরল মনে বিশ্বাস করেছিলেন রাবণ। তিনি তখন কৈলাসে গিয়ে সমগ্র পর্বত তুলে ধরার চেষ্টা করতে থাকলেন। এর ফলে সমগ্র কৈলাস পর্বত কম্পিত হল। কৈলাস পর্বতের উপরে যে সমস্ত গাছ পালা ছিল সেগুলো পর্যন্ত বিপর্যস্ত হলো। কৈলাসপতি শিবের আসন টলে উঠল তখন দেবাদিদেব মহাদেব পার্বতীকে জিজ্ঞেস করলেন একি হল! পার্বতী তখন বললেন, এ তোমার ভক্তের কাজ তার কাছ থেকে উপযুক্ত ফল পেয়েছ তো?

শিব তখন রাবণের উপর রেগে গিয়ে তাকে শাপ দিলেন," তোমার বল দর্পহারী পুরুষ শীঘ্রই আবির্ভূত হবেন।" নারদ এইশাপ বাক্য শুনে আশ্বস্ত হলেন। অন্যদিকে রাবণ সমগ্র কৈলাস পর্বত নিজে হাতে তুলতে পেরে নিজের অতুল বল সম্পর্কে নিঃসংশয় হল এবং সে কৈলাস পর্বতটিকে আবার আগের মতো যথাযথ স্থানে রেখে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। রাক্ষসরাজ রাবণ সারা বিশ্বের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করতে থাকলেন এরপর কিন্তু দেবতারা নিশ্চিন্ত হলেন কারণ তার বল দর্পহারী পুরুষ শীঘ্রই আবির্ভূত হবেন বলে শাপ দিয়েছেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব এবং তার শাপ  বাক্য কখনই মিথ্যা হবে না। এরপরের কাহিনি তো সকলেরই জানা শ্রী রামচন্দ্রের জন্ম এবং তার বনবাস। রাবণ কর্তৃক দেবী সীতার হরণ ও দেবী সীতাকে উদ্ধার করবার জন্য  শ্রী রামচন্দ্রের হাতে  রাক্ষসরাজ রাবণের পরাজয় ও মৃত্যু বরণ!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...