দেবাদিদেব মহাদেবের যতগুলি জ্যোতির্লিঙ্গ আছে তার মধ্যে অন্যতম রামেশ্বর লিঙ্গ। কথিত আছে যে, এই দেবাদিদেব মহাদেবের এই লিঙ্গ দর্শন করলে সকল পাপ দূর হয়। এই জ্যোতির্লিঙ্গের উৎপত্তির সঙ্গে সত্য যুগের দেবতা শ্রী রামচন্দ্রের নাম জড়িয়ে আছে। শ্রী রামচন্দ্রের ওপর কৃপা পরবশ হয়েই ভোলেনাথ এখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। শিব পুরাণেও এই কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। শিব পুরাণের ভারতীয় জীবনধারায় শিব চেতনার ‘জ্ঞান সংহিতা’র ত্রিংশ অধ্যায়ে রামেশ্বর লিঙ্গের উৎপত্তি কথা বর্ণিত আছে।
সূত ঋষিদের নাগেশ্বর দেবের আবির্ভাব কাহিনী বলবার পর বললেন- "হে মুনিগণ এবার আমি রামেশ্বর লিঙ্গের উৎপত্তির কথা বলব।"
এই উৎপত্তি কথার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রামচন্দ্র সীতা হরণের কাহিনী, সত্য যুগের কাহিনী। সত্যযুগে রামচন্দ্র পিতৃসত্য রক্ষা করার জন্য ১৪ বছর স্ত্রী সীতাকে নিয়ে বনবাসে যান, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গেও যান লক্ষণ। রাবণ মায়া হরিণ সৃষ্টি করেছিলেন, দেবী সীতা স্বর্ণ হরিণ দেখে সেটিকে নিজের কাছে রাখবার বায়না করলে রামচন্দ্র স্বর্ণ হরিণের পিছন পিছন যায় এবং লক্ষণকে দেবী সীতার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিযুক্ত করে যান। কিন্তু সেই স্বর্ণ হরিণ হুবহু রামচন্দ্রের গলা নকল করে ‘ভাই লক্ষণ বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করতে থাকেন।
দেবী সীতা স্বামীর বিপদ আশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে দেবর লক্ষণকে স্বামীর সন্ধানে যাওয়ার জন্য কাতর অনুরোধ করতে থাকেন। প্রথমদিকে লক্ষণ যেতে রাজি না হলেও সীতার অনুনয়ে রাজি হন, যাওয়ার আগে লক্ষণ গন্ডি কেটে দিয়ে দেবী সীতাকে বারবার সতর্ক করে যান যে, কোনও অবস্থাতেই তিনি যেন লক্ষণের কাটা এই গণ্ডি লঙ্ঘন না করেন। এরপর লক্ষণ বেরিয়ে যান রামের খোঁজে। এই সময় বোন সূর্পনখার নাখ কাটার প্রতিশোধ নিতে লঙ্কেশ্বর রাবণ সন্ন্যাসী ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে সীতার দুয়ারে এসে হাজির হন। সীতা সন্ন্যাসী ভিক্ষুক দেখে লক্ষণের কাটা গণ্ডি লঙ্ঘন করতেই রাক্ষসরাজ রাবণ নিজস্ব রূপ প্রকাশ করেন ও দেবী সীতাকে হরণ করেন। এরপর যথাসময়ে দুই ভাই ফিরে এসে শূন্য কুটির দেখে সীতার খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। পরবর্তী কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রামেশ্বর লিঙ্গের উৎপত্তি কথা।
সূত বললেন, "একদিন শ্রীরামচন্দ্র লক্ষণ, সুগ্রীব ও কিছু সংখ্যক বানরসহ সমুদ্রতীরে গমন করলেন। দক্ষিণে যে লবণযুক্ত সমুদ্র আছে তার তীরে বানরগণের দ্বারা পরিবৃত ও সেবিত হয়ে তাঁরা অবস্থান করতে লাগলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, তাঁর পত্নী জানকী কোথায় গেল? কবেই বা আসবে? সামনে অগাধ অতলস্পর্শী সমুদ্র, ওপারে দুর্জয় রাক্ষসকূল। এপারে কতিপয় বানর। লক্ষণ, সুগ্রীব ও বালিপুত্র অঙ্গদের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্র এইসব বিচার করতে লাগলেন, এ অবস্থায় কী উপায় হবে কিছুই ভেবে পেলেন না।"
সীতার চিন্তায় বিভোর হয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। এই সময় রাম বললেন, "হে লক্ষণ , আমি পিপাসিত জল আনো।" এই কথা শুনে বানরগণ জল কোথায় আছে তা খোঁজ করার জন্য দশ দিকে ছুটে গেল। তারপর তারা জল এনে শ্রীরামচন্দ্রকে বলল,"হে প্রভু জল এনেছি গ্রহণ করুন।" রাম জল পান করতে উদ্যত হয়ে সহসা ভাবলেন,"তিনি শিব দর্শন করেননি , কী রূপে জল পান করবেন?"
তখন জলপানের ইচ্ছা ত্যাগ করে রামচন্দ্র পার্থিব শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে গন্ধপুষ্প দিয়ে পূজা ও দেবাদিদেবের স্তব করে বর প্রার্থনা করলেন। রামচন্দ্র বললেন," প্রভু এই সমুদ্রের জল অগাধ। রাক্ষস অতি বলবান। বানর সৈন্যগণ আমার একমাত্র সম্বল। তারা অতি চপলমতি। হে শম্ভু, এই কারণে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আপনার ভক্ত রাবণ সর্বদা মানবগণের অজেয়। তথাপি আপনি ধর্মের পক্ষপাতী থাকবেন এই আমার প্রার্থনা।" এই বলে রাম সেই পার্থিব শিবমূর্তিকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে ‘জয় জয় শংকর’ উচ্চস্বরে এই ধ্বনি দিতে লাগলেন।
তারপর আবার শিবের ধ্যান করতে লাগলেন। তখন ভগবান শিব রামের স্তব-স্তুতিতে প্রসন্ন হয়ে জ্যোতির্ময় লিঙ্গ রূপ ধারণ করে পার্বতী সহ রামের সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ‘তোমার মঙ্গল হোক’।
পরমভক্ত রাম সেই শিব রূপ দর্শন করে তাঁকে প্রণাম করে আবার উপাচারসহ পূজা করলেন ও নিজের জয় প্রার্থনা করলেন। তখন শিব বললেন তোমার জয় হোক। এই বলে শিব পিপাসিত রামকে জল দান করলেন। তখন শিবদত্ত জল পান করে রাম তাঁরই উদ্দেশ্যে পুনরায় প্রার্থনা করলেন হে প্রভু আপনি দয়াময়। লোকদের মঙ্গলের জন্য, জগৎ পবিত্র করার জন্য আপনি এই স্থানে অবস্থান করুন। মহাদেব রামের প্রার্থনা অনুসারে লিঙ্গরূপ ধারণ করে সেই স্থানে অবস্থান করলেন এবং জগতে রামেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ হলেন।
অনন্য ভক্তি সহকারে এই কাহিনি পাঠ করলে অশেষ পূণ্যফল লাভ হয় এবং দেবাদিদেব মহাদেব ও রামচন্দ্রের প্রতি ভক্তি বৃদ্ধি হয়।