কাঁটা তার পেরোনো মিষ্টির গল্প: দ্বিতীয় পর্ব

দেশভাগ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল বাংলাকে। দুই বাংলার খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে, উৎসব, পালা পার্বণ সবের মধ্যেই রয়েছে মিল। তাই তো ওই বঙ্গের মিষ্টির কাঁটা তার পেরিয়ে এ বঙ্গের বড় আপন হয়ে গিয়েছে। এমনই কয়েকটি কাঁটা তার পেরোনো মিষ্টি গল্প।

মন্ডা: মন্ডা, তার আপন মহিমায় দুই বাংলা জুড়েই জনপ্রিয়। কড়াপাকের এই মিষ্টিটি বাংলাদেশের মক্তাগাছা অঞ্চলে রামগোপাল পাল নামে, জনৈক এক ব্যাক্তি প্রথম ১৮২৪ সালে তৈরী করেন। রামগোপাল মিষ্টি তৈরী করে, মুক্তাগাছার বড় জমিদারদের মধ্যে একজন মহারাজ সূর্য্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর নিকট প্রেরন করেন। নিজস্ব স্বাদে স্বভাবতই মন্ডা জয় করে রাজার মন। অতিথি আপ্যায়নের জন্য নিয়মিত মন্ডার প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে ময়মনসিংহ-এর মুক্তাগাছায় রামগোপালের পঞ্চম বংশধরেরা এখন দোকান চালাচ্ছেন। মন্ডা দেখতে অনেকটা প্যারার মতো। চিনির সঙ্গে ক্ষীর মিশিয়ে গরম এবং নরম অবস্থায় গোল পাকিয়ে একটি শক্ত তালের উপর বিছানো কাপড়ের উপর চ্যাপ্টা করার জন্যে হাত দিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে আছাড় মারা হয়। কিছুক্ষন পর ঠান্ডা এবং নরম হয়ে কাপড় থেকে ছেড়ে আসে। ক্ষীরের বর্ণের উপর নির্ভর করে মন্ডার বর্ণ সাদা থেকে ঈষৎ হলদে হয়ে থাকে। মন্ডা একদিকে সমতল হয় এবং অপর প্রান্তটি উত্তল ও এবড়ো খেবড়ো হয়।

 

banglassweets1

এপার বাংলায়, বাঁকুড়া মন্ডার কারনে বিখ্যাত। শীতকালে ক্ষীরের সাথে চিনির পরিবর্তে গুড় মিশিয়ে মন্ডা প্রস্তুত করা হয় যা বড়িমন্ডা নামে জনপ্রিয়। এই বড়িমন্ডার জন্ম বাঁকুড়ার সোনামুখী অঞ্চলে। কড়াপাকের এই মিষ্টি মন্ডা ২০০ বছরের যাত্রা অতিক্রম করে আজ ও দু বাংলার বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে চলেছে। স্বাদে মন্ডা অত্যন্ত মিষ্টি, ভোজন বিলাসীর ক্ষেত্রে মন্ডা পরমায়ু বর্ধক।

মন্ডার ওপারের গপ্পো:
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার একটি উপজেলা হলো মুক্তগাছা, জমিদার আচার্য চৌধুরী পরিবার মুক্তগাছা শহরের পত্তন করেছিলেন। জায়গাটির আগের নাম ছিল বিনোদবাড়ি। জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর চার ছেলে সেখানে বসতি স্থাপনের জন্য গেলে গ্রামের প্রজারা সাধ্যমত উপঢৌকন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সেগুলির মধ্যে মুক্তারাম কর্মকারের দেওয়া একটি গাছা অর্থাৎ পিতলের দীপাধার ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। মুক্তারামের 'মুক্তা' এবং তাঁর দেওয়া 'গাছা' একত্রে, জমিদারেরা বিনোদবাড়ির নতুন নামকরণ করলেন মুক্তাগাছা। মুক্তাগাছা ছিল মন্ডার জন্যে বিখ্যাত। সারা পৃথিবী জুড়ে এই মিষ্টির খ্যাতি আকাশছোঁয়া।

মুক্তাগাছার মন্ডা প্রথম তৈরি করেছিলেন গোপালচন্দ্র পাল। শোনা যায়, ১২০৬ বঙ্গাব্দে তিনি মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। নবাব সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর ১২৩০ বঙ্গাব্দ নাগাদ পর তিনি মুক্তাগাছা চলে যান। সেখানেই প্রথম মন্ডা তৈরি হয় বাংলা ১২৩১ সন বা ইংরেজি ১৮২৪ সালে।

গোপাল পালের প্রথম মন্ডা তৈরি নিয়ে একটি গপ্পো প্রচলিত রয়েছে। তিনি নাকি এক রাতে স্বপ্ন দেখেন, এক সন্ন্যাসী তাঁকে মন্ডা তৈরি করতে আদেশ দিচ্ছেন। তারপর কয়েক রাতের স্বপ্নে সন্ন্যাসী তাঁকে মন্ডা বানানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। শেষ নিয়মটি শেখানোর পর আশীর্বাদ করেন, "তুই এই মন্ডার জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করবি। তোর মন্ডার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।"

গোপাল তাঁর বানানো নতুন মিষ্টি, একদিন পরিবেশন করলেন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর দরবারে। খেয়ে তো জমিদার এক্কেবারে খুশ! প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল গোপাল পালের মন্ডা। এখনও সেই গোপালের পরবর্তী বংশধরেরা মন্ডা তৈরি করেন। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অধীনে ছিল, সে সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তাগাছার এক সভায় মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন। মন্ডার দোকানের মালিক কেদারনাথ পালকে বলেছিলেন, "পাল মশাই দেশ ছেড়ে যাবেন না, দেশ ভালো হবে।"

কানসাট:
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কানসাট নামে একটি জনপদ রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির কারিগর ছিলেন মহেন্দ্রনাথ সাহা। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের শিবগঞ্জ থেকে মালদহ অঞ্চলে, এই মিষ্টির কারিগরেরা দলে দলে আসতে শুরু করে। এদেশে এসে বিজয় কুমার সাহা  বাবার শিখানো এই বিশেষ ধরনের মিষ্টিটির নামকরন করেন, পৈত্রিক ভূমির নামেই। তাদের দোকানটির নামও এই মিষ্টির নামেই রাখা হয়। বর্তমানে বিজয় কুমার সাহার দুই পুত্র বিশ্বজিৎ সাহা এবং জয়দেব সাহা, এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বাবার শেখানো মিষ্টি তৈরির কৌশলে বিজয় কুমারের হাত ধরে মালদহে কানসাটের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, কালক্রমে উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

banglassweets2

 

বাঙালির রসনায় আমের জন্য মালদহ বরাবরই বিখ্যাত ছিল। কনসাট হল বঙ্গখাদ্য মানচিত্রের নতুন সংযোজন। মূলতঃ ছানা এবং ক্ষীর দিয়ে এই মিষ্টি প্রস্তুত করা হয়। মিষ্টির প্রকৃত স্বাদ নির্ভর করে ছানার গুনমানের উপর। কানসাটের গুনমান আর একটি জিনিসের উপর নির্ভর করে, সেটি হল কোন আঁচে এবং কত সময় ধরে এটিকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ছানা ভালো করে জ্বাল দিয়ে, তার উপরে ভাজা ক্ষীর অথবা খোয়াক্ষীর ছাড়িয়ে দেওয়া হয় এরপর সেটিকে ক্রমাগত জ্বাল দেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট আঁচে ছানা এবং ক্ষীর মিশে মৌমাছির মৌচাকের মতো চাক সৃষ্টি করে, এই আঁচের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় সাহাদের বিখ্যাত কানসাট। এর বর্ণ ঈষৎ হলদেটে বাদামী। মালদহের প্রসিদ্ধ এই মিষ্টি বহন করছে দেশভাগের ঐতিহ্য। প্রায় সাতদশক ধরে বাঙালির রসনা তৃপ্তি করে চলেছে এই কানসাট।


কাঁচাগোল্লা:
নাটরের শুধুমাত্র বনলতা সেন নয়, কাঁচাগোল্লাও সমানভাবে জনপ্রিয়। ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তী রানীভবানির রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সমকালীন সময়ে রাজশাহী গেজেট এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে কাঁচাগোল্লা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে। কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির অন্তরালে এক চমৎকার কাহিনী রয়েছে। নাটরের লালবাজার অঞ্চলে মধুসূদন পালের এক চমৎকার মিষ্টির দোকান ছিল। শোনা যায় তার দোকানে কয়েকটি বড়ো বড়ো উনুন ও ১০-১৫ জন কারিগর ছিল। প্রতিদিন প্রায় দুমন ছানার মিষ্টি এখানে তৈরী হত। একদিন সমস্ত কারিগর না আসায়, তিনি  চিন্তিত হয়ে পড়েন। ঘন চিনির রসে শুধু ছানাকে জাল দিয়ে রেখে দেন। ঠান্ডা হওয়ার পর খেয়ে দেখা যায়, এই স্বাদ অন্য যে কোনো মিষ্টিকে পরাজিত করতে পারে। এইভাবেই জন্ম হয় কাঁচাগোল্লার। যেহেতু চিনিরসে ফেলার আগে ছানাকে কিছুই করা হয়নি এবং কেবল কাঁচা ছানাকেই জ্বাল দেওয়া হয়েছে, তাই এর নাম যোগ হয় কাঁচা শব্দটি।

 

banglassweets3

এই মিষ্টি প্রস্তুতির পর গোল্লা আকারে পরিবেশন করা হয়, তাই দুয়ে মিলে এর নাম হয় কাঁচাগোল্লা। এর আর একটি প্রচলিত নাম হল মাখা সন্দেশ।  উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় জলপদ্মের পাতায় কাঁচাগোল্লা পরিবেশন করার প্রচলন ছিল। এর বর্ণ সাদা কিন্তু শীতকালে গুড়ের আগমনে কাঁচাগোল্লা যেন লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। মফস্বল এবং শহরতলীতে এই মিষ্টির জনপ্রিয়তা থাকলেও, ক্রমশঃ শহর থেকে কাঁচাগোল্লা হারিয়ে যাচ্ছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...