দেশভাগ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল বাংলাকে। দুই বাংলার খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে উৎসব,পালা-পার্বণ সবের মধ্যেই রয়েছে মিল। তাই তো ওই বঙ্গের মিষ্টিরা কাঁটা তার পেরিয়ে এ বঙ্গের বড় আপন হয়ে গিয়েছে। এমনই একটি মিষ্টি হল চমচম।
দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয় রসালো নরম চ্যাপ্টা ছানার মিষ্টি হল চমচম। নবাবী আমল থেকে চমচম তৈরি করা হয়ে আসছে যা আদি চমচম নামে পরিচিত। এই চমচমের বর্ণ ছিল সাদা। অবিভক্ত গৌড় বাংলার মালদহ জেলার সদর ছিল শিবগঞ্জ। এই স্থানেই আদি চমচমের জন্ম। এই অঞ্চলে ছিল বহু ময়রার বসবাস। ৪৭-এর দেশভাগের পর তারা কেউ কেউ এপার বাংলায় চলে আসেন, যার ফলে চমচমের দুটি ভিন্ন রূপ পাওয়া যায়। একটির বর্ণ লালচে এবং অপর একটি সাদা। স্বল্প রসের চমচমের উপর গুড়ো ক্ষীরের উপস্থিতি লক্ষনীয়। উনবিংশ শতকের শুরুতে ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহুকুমার অন্তর্গত ধলেশ্বরী নদীর তীরে, পোড়াবাড়ির অঞ্চলের চমচমের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই চমচমই পোড়াবাড়ি চমচম নামে ওপার বাংলায় জনপ্রিয়তা পায়।
দেশভাগের পর ধলেশ্বরী নদী তীরের বসতি ছেড়ে পশ্চিমবাংলার জলপাইগুড়ির বেলাকোবায় চলে আসেন দুই বন্ধু ধীরেন সরকার ও কালীদাস দত্ত। সঙ্গে নিয়ে আসেন চমচম তৈরির প্রনালী। তারপর ক্রমশ চিরাচরিত ঘরানা ভেঙে আত্মপ্রকাশ করে বেলাকোবার চমচম। রেললাইন বেলাকোবাকে আড়াআড়িভাবে দুভাগে ভাগ করেছে। লাইনের দুপাশে দুই প্রবাদপ্রতীম চমচম শিল্পীর দুটি দোকান আজও বাঙালির রসনার তৃপ্তি ঘটাচ্ছে। দুই চমচমের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পোড়াপড়ির চমচমের বৈশিষ্ট্য হল কড়াপাক কিন্তু বেলাকোবায় চমচমের কড়াপাকের সাথে যুক্ত হয় অধিক পরিমানে ক্ষীর। পেল্লাই আকারের গোলাপী চমচমে বরফের কুচির মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্ষীরের দানা। গত দুদশকে বাঙালি নরম ক্ষীরের মধ্যে লম্বাটে চমচম দিয়ে স্বাদবদলের জন্য বানিয়ে ফেলেচে লর্ড চমচম। যার বর্ণ ধবধবে সাদা।
চমচমের ওপারের গপ্পো করতে টাঙ্গাইলের কথা বলতে হয়। টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল পোড়াবাড়ি। ঐতিহ্যের পোড়াবাড়ির চমচম বয়সে প্রায় ডবল সেঞ্চুরি পেরিয়ে গিয়েছে। একদা পোড়াবাড়ি 'চমচমের রাজধানী' হিসেবেও পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, আসাম থেকে যশোরথ হালই নামের এক মুনি এসেছিলেন পোড়াবাড়িতে। তিনিই প্রথম গোরুর খাঁটি দুধ, চিনি আর ধলেশ্বরী নদীর জল দিয়ে বিশেষ উপায়ে চমচম তৈরি করেন। এখনও এখানকার মিষ্টি প্রস্তুতকারকেরা চমচম বানিয়ে থাকেন।
এখানকার ঘোষ এবং পালে প্রমুখ প্রসিদ্ধ মিষ্টি নির্মাতারা বংশানুক্রমিকভাবে চমচম তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পোড়াবাড়ির চমচমের মূল উপাদান ছানা এবং চিনি। লালচে পোড়া ইটের মতো রং এই মিষ্টির। যার উপরে দুধের তৈরি ক্ষীরের আবরণ থাকে। এই মিষ্টির ভিতরে মৌচাকের মতো ফাঁপা নরম রসালো অংশের স্বাদ সবথেকে বেশি।
একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, পোড়াবাড়ির কোন কারিগর অন্য কোথাও গিয়ে এতটা সুস্বাদু চমচম বানাতে পারবে না। খানিকটা হাস্যকর হলেও এ ঘটনার সত্যতার প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একবার বলেছিলেন, "ব্রিটিশ আমলে সন্তোষের জমিদার পরিবারের এক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতায়। পোড়াবাড়ি থেকে কয়েকজন দক্ষ কারিগর সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা এখানকার মতো উন্নত মানের চমচম বানাতে পারেননি। সেই কারিগরেরাই বলেছিলেন, টাঙ্গাইল দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা এবং বিশেষ করে পোড়াবাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া তার শাখা ধলেশ্বরী নদীর জল ছাড়া এমন সুস্বাদু চমচম বানানো সম্ভব নয়। এখানকার মাটির কারণে জলে এক বিশেষ গুণ আসে বলে তাঁদের বিশ্বাস ছিল।"
এই ধলেশ্বরী নদীতেই ছিল, পোড়াবাড়ির বাজারে স্টিমার ঘাট ছিল। তাতে স্টিমার, লঞ্চ এবং বড়ো বড়ো নৌকো ভিড়ত। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকায়,পরিবহণের সঙ্গেই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে চমচমের নাম। কিন্তু কালের নিয়মে ধলেশ্বরী নদীর নাব্যতা কমে যায়, এখন আর লঞ্চ, স্টিমার কিছুই ভিড়তে পারে না ধলেশ্বরী নদীতে। বলাই বাহুল্য ব্যবসায়ীদের যাতায়াতও কমে যায়।
পোড়াবাড়ি এবং পাশের গ্রাম চারাবাড়িতে কয়েকটি চমচমের দোকান আজও টিকে আছে কোনোমতে। পোড়াবাড়ির ব্যবসায় মন্দা আসলে ব্যবসায়ীরা টাঙ্গাইল শহরে চলে যান। সেখানে পাঁচআনি বাজার এখন চমচমের অন্যতম সেরা প্রাপ্তিস্থল। এখন পাঁচআনিতে লোকে গিয়ে 'আসল পোড়াবাড়ির চমচম'-এর খোঁজ করেন। ৩০-৩৫টির মতো মিষ্টির দোকান রয়েছে এখানেই। তার মধ্যে জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এবং গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার অন্যতম প্রাচীন ও বহুল প্রচলিত।