নীলাবতীর কাহিনী

নীল পুজো মূলত একটি লোক উৎসব হলেও এটি আসলে নীল নীলাবতীর অর্থাৎ শিব-দুর্গার বিবাহ উৎসব। লৌকিক মত অনুসারে, ‌নীল বলা হয় দেবাদিদেব মহাদেবকে  আর নীলাবতী বা নীলচণ্ডিকা বলা হয় দেবী পার্বতীকে। নীল-নীলাবতীর বিয়ে উপলক্ষে নানানরকম লৌকিক আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয় এই দিনে। নীলাবতীর কাহিনী অনুসারে, শিবের বারণ সত্ত্বেও পিতা দক্ষের যজ্ঞে উপস্থিত হয়েছিলেন শিবজায়া সতী। এরপর বিনা নিমন্ত্রণে সতীর আগমনকে কেন্দ্র করে শিববিদ্বেষী দক্ষ সকল দেবতাদের সামনে শিবের নামে কু-কথা বলতে শুরু করেন। সকলের সামনে স্বামীর  নামে নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেবী সতী নিজের দেহত্যাগ করেন। এরপর তিনি পুনরায় দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য নীলধ্বজ রাজার সুন্দরী কন্যা রূপে আবির্ভূতা হন রাজা তাকে নিজের কন্যারূপে লালন পালন করেন। পরবর্তীকালে এই নীলাবতীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবের বিয়ে হয়। বাসর রাতে নীলাবতী শিবকে মোহিত করেন এবং পরে মক্ষিকা রূপ ধরে ফুলের সঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। রাজা রানীও এই শোকে তাদের নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেন।

নীল পুজোর দিন সন্তানবতী হিন্দু মহিলারা নীল ষষ্ঠী পালন করেন। মূলত সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্য, সন্তানের নীরোগ সুস্থ দেহ ও দীর্ঘায়ু কামনা করে তারা এই পুজো করেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক উৎসবের আগের দিন নীল সন্ন্যাসীরা নীলকে সুসজ্জিত করেন ও নীলকে সঙ্গে নিয়ে গান-বাজনা করতে করতে যান ও বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়ে ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নিম বা বেল কাঠ দিয়ে নীলের মূর্তি তৈরি করা হয় ও চৈত্রসংক্রান্তির কিছু আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নামানো হয়। এরপর নীল পুজোর আগের দিন অধিবাস হয়, গভীর রাত্রে হাজরা পুজো পালিত হয়। হাজরা পুজো অর্থাৎ শিবের বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা হয়। এই হাজরা পুজোর আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল এই যে, এখানে শিবের চ্যালা চামুন্ডারা অর্থাৎ ভূত-প্রেতদের পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। এরপর নীল পুজোর দিন নীল দেবকে গঙ্গা জলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়ী নীলকে নিয়ে ঘোরানো হয়। নীল সন্ন্যাসীরাও তাদের ইষ্টদেব নীলের মতো একইরকমভাবে সাজেন। তারাও গায়ে লাল কাপড় পরেন,  মাথায় বাঁধেন পাগড়ি, গলায় ধারণ করেন রুদ্রাক্ষের মালা। এরপর হাতে ত্রিশূল নিয়ে তারা নীলকে সঙ্গে করে মিছিলে বের হন। যাদের গৃহে তারা নীলকে নিয়ে পৌঁছোন, সেই সব গৃহস্থ মহিলারা উঠোনে আলপনা এঁকে নীলকে আহ্বান করে বর আসনে বসিয়ে তার মাথায় তেল সিঁদুর পরিয়ে দেন। এই সময় নীল সন্ন্যাসীরা নীলের যে গান গেয়ে থাকেন তাকে অষ্টক গান বলা হয়।

এই অষ্টক গানের প্রথম অংশ ধরেন নীল সন্ন্যাসীদের দলপতি, যাদের বালা বলা হয় ও পরবর্তী অংশ অন্যান্য নীল সন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন। অষ্টক গানের শুরুটা হয় এইরকম-

"শুন সবে মন দিয়ে, হইবে শিবের বিয়ে

কৈলাসেতে হবে অধিবাস।

তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা

বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।

নারদ চলল গিরিরাজের গৃহেতে..."

এরপর বিয়ের নানাবিধ ঘটনা ও শিবের দিগম্বর হওয়ার ঘটনার কথা গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। তবে অষ্টক গানের বিষয়বস্তু শুধুই শিব পার্বতীর বিবাহের ঘটনা নয়, এর সঙ্গে তাদের বিবাহোত্তর জীবনের নানা ঘটনা‌ও পরিবেশিত হয়। বিবাহের পর তাদের দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল, শ্মশানবাসী শিবকে বিবাহ করার পর পার্বতীর সংসার কেমন ভাবে চলত, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরার ঘটনা, হরগৌরীর কলহ, গৌরীর কৈলাস ত্যাগ ও অন্নপূর্ণা রূপ ধারণ, ভিখারি রূপী শিবের অন্নপূর্ণার কাছে গমন ও ভিক্ষাপাত্র তুলে ধরা- ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনাও গানের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয়। অষ্টক গান শেষ হলে গৃহস্থরা খুশি মনে সন্ন্যাসীদের চাল, পয়সা, ফল প্রভৃতি দেয় ও সন্ন্যাসীরা তা গ্রহণ করে ফিরে আসেন।

নীল পূজার দিন মায়েরা সারাদিন উপবাস রাখেন এবং সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে শিব পুজো করে জল গ্রহণ করেন এবং নিজেদের উপবাস ভঙ্গ করেন।

দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করতে এইদিন শিব পুরাণের যে কোনো একটি অধ্যায় পাঠ করতে পারেন এবং একই সঙ্গে দেবাদিদেবের সামনে হরিনাম করতে পারেন। হরিনাম করার কথা এই কারণেই,  শিব তত্ত্ব অনুযায়ী শিব হলেন ঈশ্বর আর হরি তার একনিষ্ঠ ভক্ত অন্যদিকে বিষ্ণু তত্ত্ব অনুযায়ী বিষ্ণুই হলেন ভগবান আর দেবাদিদেব মহাদেব হলেন পরম বৈষ্ণব, হরির একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই আপনি শিব তত্ত্বে বিশ্বাস রাখুন অথবা বিষ্ণু তত্ত্বে আপনি দেবাদিদেবকে প্রসন্ন করতে তার সামনে হরিনাম করতেই পারেন। কারণ দুই মতেই  স্বীকার করা হয়  হরি ও হরের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা এবং একে অন্যকে অনুক্ষণ ধ্যানের মাধ্যমে স্মরণ করার কথাও বলা হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...