‘অগ্নি পুরাণ’-এ বলা হয়েছে যে, ‘শেষাদিনাং ফণীশানাং পঞ্চম্যাং পূজনং ভবেত।’ অর্থাৎ, ‘শেষনাগ প্রভৃতি সর্পরাজের পূজা পঞ্চমী তিথিতেই করা বিধেয়’। তাই গেরস্ত-বাড়িতে শ্রাবণ মাসের শুক্লা পঞ্চমী এবং কৃষ্ণ পঞ্চমী-দুই তিথিতেই নাগ ও নাগদেবী মনসার পুজো করে ‘নাগপঞ্চমী ব্রত’ পালন করতে দেখা যায়।
‘স্কন্দ পুরাণ’-এ স্বয়ং শিব নাগপঞ্চমী ব্রত পালনের বিধি বর্ণনা করেছেন। তবে, এই ব্রতের পৌরাণিক কোন কাহিনি তিনি শোনাননি। আসলে, এই ব্রতের কোন পৌরাণিক কাহিনিই নেই। একটি লৌকিক কাহিনি বঙ্গদেশের লোকপুরাণ-এ পাওয়া যায়, সেটিই এখন আপনাদের শোনাবঃ
এক ছিল বামনি। তার ছিল তিন ছেলে। আর তিন ছেলের ছিল তিন বউ। বামনি ভারি কিপ্টে, বউমাদের ভালোমন্দ রেঁধে-বেড়ে তেমন খেতেটেতে দিত না। তাই নিয়ে তিন বউয়ের আপসোসের শেষ ছিল না।
তখন শ্রাবণ মাস। রিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি কিছুতেই থামছে না দেখে, ভিজতে ভিজতেই তিন বউ গেল পুকুর ঘাটে। চান করতে।
বৃষ্টিতে ভিজে বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। তাই চান করতে করতে বড় বউ বলল, আহা রে, এমন বাদল দিনে বাপের ঘরে থাকলে মনের মতো করে খিচুড়ি রেঁধে কেমন গরম গরম বেড়ে খেতাম! তারপর দুঃখ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এখানে তো আর সাধ মিটিয়ে খাবার জো নেই!
মেজ বউ বলল, আমি তো বাপের বাড়িতে থাকলে গাওয়া ঘিয়ে গরম গরম লুচি ভেজে খেতাম! কিন্তু, যদির কথা নদীতে, সাধ করে দুঃখ্যুই সার!
বাপের বাড়ির কথা উঠতেই ছোট বউ লুকিয়ে চোখের জল ফেলল। তার বাপের বাড়িতে কেউ নেই। বাপ নেই, মা নেই, কেউ নেই। সোদর দুই ভাই ছিল, ক’বছর আগে তাদেরও আলপ্পেয়ে সাপে খেয়েছে!
সে চোখের জল মুছে বলল, দিদিরা দুঃখ করো না। খিচুড়ি-লুচি না পারি, আজ তোমাদের গরম গরম ভাত আর শোল মাছের ঝোল খাওয়াব। এই পুকুরে এক হাত- দেড় হাতের শোল পাওয়া যায় শুনেছি। এমনি এমনি ধরে নিয়ে গেলে শাশুড়িঠাকরুণ রাঁধতে দিতে আপত্তি করবেন না।
কথা শেষ হতে-না-হতেই দু’খানা শোল জলের ওপর হুশ হুশ করে ভেসে উঠল। অমনি ছোট বউ তাদের ঝটপটিয়ে ধরে ফেলল। তাই দেখে আশ মিটিয়ে খাবার আশায় বড়-মেজোর মুখে হাসি ফুটল।
বাড়ি ফিরে ছোট বউ মাছ দু’খানা হেঁশেলঘরে ঝুড়ি ঢেকে রাখল। তারপর খানিক কাজকম্মো সেরে বঁটি নিয়ে মাছ কাটতে এল। কিন্তু ঝুড়ি তুলতেই সে যা দেখল, তাতে দুই চোখ কপালে উঠে আঁতকে একেবারে ভিরমি খাবার জোগাড়! মাছ কোথায়, এ যে দুই দুইখান নাগ!
ছোট বউকে আঁতকে উঠতে দেখে নাগেরা সাহস জুগিয়ে মিষ্টি করে বলল, ভয় পেও না দিদি। পুকুরঘাটে তোমার দুঃখ দেখে আমাদের কষ্ট হয়েছে। তাই মাছের রূপ ধরে ধরা দিয়ে তোমার সঙ্গে এসেছি। নাগেদের দংশনে তোমার ভাই মরেছে, তাদের তো আর ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি নেই। তবে তোমার বাপের বাড়ি না-থাকার যে দুঃখ, সে আমরা ঘোচাতে পারি। আজ থেকে আমরা তোমার ভাই, আর আমাদের বাড়িই তোমার বাপের বাড়ি। চলো দিদি, আমাদের সঙ্গে বাপের বাড়ি চলো।
নাগেদের অমন আন্তরিক মিষ্টি কথায়, বাপের বাড়ির কথায় ছোট বউ যেন কৃতার্থ হয়ে গেল। তার মনের মধ্যে এমন ভাব এল যে, এক কথায় সে নাগেদের বাড়ি যেতে রাজি হয়ে গেল।
নাগেদের বাড়ি স্বর্গপুরে। সেই যেখানে দেবী বিষহরির বাস। নাগভাইরা ছোট বউকে সেই স্বর্গে নিয়ে এল।
সেখানে মা মনসাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ছোট বউয়ের আহ্লাদের আর সীমা রইল না। গলায় কাপড় দিয়ে সে মা মনসাকে গড় করল। মা তার ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বললেন, বাছা, তুমি এসেছ, এতে আমি খুশি হয়েছি, যদ্দিন ইচ্ছে হয় এখানে থাকো।
ভাইদের পেয়ে, মনসা মাকে পেয়ে ছোট বউয়ের আনন্দের সীমা রইল না। মা নিজের হাতে রেঁধে-বেড়ে নাগ সন্তানদের খাওয়ান, ছোট বউকে খেতে দেন, নিজে খান। এমনি সুখে দিন যায়।
একদিন মা মনসা ছোট বউকে ডেকে বললেন, মর্তে পুজো নিতে যাচ্ছি মা। ভাইদের খেতে দিয়ো, নিজে খেয়ো, কেমন?
ছোট বউ ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা!
মা মনসা চলে গেলেন। খানিক পরে নাগভাইদের দুধ খাবার সময় হল। পাত্রে বেশ খানিকটা ঠাণ্ডা দুধ ছিল। ছোট বউ ভাবল, গরম গরম দুধ খেতেই বেশি ভালো লাগে। তাই এটুকু গরম করেই ভাইদের খেতে দিই।
দুধ গরম হল। কিন্তু নাগেদের সেটা খেতে দিতেই মহা বিপদ ঘটে গেল। গরম দুধ খেতে গিয়ে নাগেদের কার জিভ পুড়ে গেল, কার ঠোঁট পুড়ে গেল, কার মুখ পুড়ে গেল, কেলেঙ্কারির একশেষ হল। আর তাতেই ছোট বউয়ের উপর সব নাগভাইরা ভয়ানক রেগে গেল। রাগে হিশ হিশ শব্দ করতে করতে তারা ছোট বউকে কামড়ে একেবারে মেরে ফেলল।
মা মনসা পুজো নিয়ে ফিরে এসে ছোট বউকে মরে থাকতে দেখে 'হায় হায়' করে উঠলেন। তারপর নাগেদের জিজ্ঞেস করে আসল ঘটনা জানতে পারলেন।
সব শুনে স্মিত হেসে মনসা বললেন, বাছারা, তোমরা স্বভাবদোষে রাগ করেছ। সব দিক ভেবে দেখলে তোমরা রাগ করতে পারতে না। দুধ খেয়ে যাতে তোমরা স্বাদ পাও, তার জন্যই তো তোমাদের বোন দুধ গরম করে দিয়েছিল। ওতে তো তোমাদের প্রতি বোনের ভালোবাসাই আমি দেখতে পাচ্ছি। অথচ তোমরা দেখতে পেলে না! স্বভাবের ক্রোধ যদি বশে না-থাকে তাহলে অপরিনামদর্শিতা আসে, অপরিনামদর্শিতা থেকেই সংসারে অনর্থ ঘটে।
মনসার সস্নেহ মৃদু ভর্ৎসনায় নাগেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। ভুল বুঝতে পেরে তাদের দারুণ অনুশোচনা হতে লাগল। মায়ের পায়ে পড়ে তখন তারা ছোট বউকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য কাকুতিমিনতি শুরু করল।
তাদের এই ভাবান্তরে দেবী খুশি হলেন। ছোট বউকেও বাঁচিয়ে দিলেন। তাকে অপার কৃপায় ধন্য করলেন।
দেবীর কৃপায় ছোট বউয়ের সোনার সংসার হল, কোল ভরে ছেলে এল, নাগভাইদের সঙ্গে আর কোনদিন ভুল বোঝাবুঝি হল না।
ছোট বউ যে-দিন নতুন জীবন পেল, দেবীর পূর্ণ কৃপা পেল; সে-দিনটা ছিল শ্রাবণের পঞ্চমী তিথি। সেই কৃপার কথা মাথায় রেখে মর্তে ফিরে ছোট বউ এই দিনটিতেই দেবী এবং নাগভাইদের বন্দনা করতে 'নাগপঞ্চমী ব্রত' শুরু করল। তার কাছ থেকে ব্রতের কথা ও দেবীর মাহত্ম্যের কথা শুনে ধীরে ধীরে ব্রতটি একসময় ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।