যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল,সহদেব এবং কুন্তীকে মারার জন্য এক ষড়যন্ত্র রচিত হয়। এই ষড়যন্ত্র করে তাঁদেরই নিকটাত্মীয় দুর্যোধন। মন্ত্রী পুরচোন তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন। তৈরি হয়েছিল "জতুগৃহ"। মহাভারতের "জতুগৃহ"- এর ঘটনা আমাদের কম-বেশি সকলেরই জানা।
"জতু" অর্থ "গালা"। এর থেকে বোঝা যায় মহাভারতের সময়েও সাধারণ মানুষের কাছে গালা পরিচিত ছিল। গালা দাহ্য পদার্থ হিসেবে যেমন ব্যবহার করা যায় তেমনি গালা দিয়ে বিভিন্ন শিল্প সামগ্রীও প্রস্তুত করা হয়।
গবেষকদের মতে আনুমানিক ১৫০০ শতকে রাজা মানসিংহের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্ত থেকে "গালা শিল্প" বাংলায় প্রবেশ করে।
নবাবী আমলে বাংলায় গালার তৈরি বাসনের বিশেষ সমাদর ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাব হারামে ও অন্যান্য রাজ দরবারে ষড়যন্ত্রীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য গালার তৈরি বাসন ব্যবহার করা হতো। গালার তৈরি বাসনে বিষ মেশানো খাবার পরিবেশন করলে তা ফেটে যায়। তাই নবাবী আমলে গালার বাসন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
আলতা, রঙিন চুড়ি, খেলনার পুতুল এবং শৌখিন দ্রব্য গালা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। গালার পুতুলের জন্য একসময় বীরভূমের "ইলামবাজার" বিখ্যাত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলায় গালা উৎপন্ন হলেও কারুশিল্পে তার ব্যবহার হয় সাধারণত হয় নি।
পূর্বভারতে একমাত্র "ইলামবাজার"ই ছিল গালার নানা প্রকারের ব্যবহার। ইলামবাজারে যে পুতুল তৈরি হয় তা এককথায় লোকশিল্পের অসামান্য উদাহরণ। গ্রামীণ সরলতা এবং গ্রামীণ শিল্পী মন ফুটে উঠত এই পুতুলগুলির অবয়বে।
আঙুল দিয়ে টিপে তৈরি করা হয় এই পুতুলগুলো। এই পুতুলগুলি নির্মাণ কৌশল হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়োর প্রাচীন টেরাকোটা পুতুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই ধারার নিরবিচ্ছিন্ন স্রোত হয়তো প্রবাহিত হয়েছিল এই গালার পুতুলের মধ্যে।
"গালা" নামক এই দাহ্য পদার্থটি কোথায় থেকে পাওয়া যায় জানেন? অনেকে জানেন, অনেকে হয়তো জানেন না। এটি "লাক্ষা" নামক একটি ক্ষুদ্র আকৃতির পোকা থেকে পাওয়া যায়। কুসুম, পলাশ, কুল, বট, অশ্বত্থ, শিরিষ, পিপুল, অরহড়, বাবলা গাছে এই পোকা চাষ করা হয়। এইসব গাছের রস এই পোকার প্রাধন খাদ্য।
বছরে দু'বার লাক্ষার চাষ হয়। সাধারণত আষাঢ় এবং কার্ত্তিক মাস লাক্ষা চাষের উপযুক্ত সময়। প্রথমবারের চাষকে "বোশেখী" এবং দ্বিতীয়বারের চাষকে "কাতকে" বলা হয়। "কাতকে" বা "কার্ত্তিক" মাসেই লাক্ষা চাষ বেশি হত। "বোশেখী" চাষ বর্ষার জলে নষ্ট হত বেশি।
লাহা বা লাক্ষা থেকে লাক্ষাবীজ পাওয়া যায়। এই বীজগুলিকে ঠান্ডা ঘরে ৭-৮ দিন রাখতে হয়। তারপর ঐ বীজ থেকে দু-একটি লাল রঙের পোকা বের হলে ডালে ঘাস কিংবা কলার পেটোর সঙ্গে ভালো করে বেঁধে দিতে হয়। পোকাগুলি ১৫-১৬ দিনের মধ্যে গাছে ছড়িয়ে পড়লে লাক্ষা-কাঠি নামিয়ে গালা চেঁছে নিতে হয়।
পোকাগুলির মলদ্বার থেকে একরকমের রক্তাভ রস বের হয়। তা বাতাসের সংস্পর্শে এসে জমে গিয়ে লাহা বা লাক্ষায় রূপান্তরিত হয়। এক জায়গায় অনেক পোকা একসঙ্গে থাকায় লাহা জমে লাক্ষা কাঠিতে পরিণত হয়। এক- একটি গাছ থেকে প্রায় ১৯ কেজি থেকে ৩৭ কেজির মতো লাক্ষা পাওয়া যায়।
লাক্ষা চাঁছার কাজ সাধারণত পুরুষরা করে থাকে। আর মেয়েরা সেগুলিকে নোড়া দিয়ে ভেঙে চালুনি দিয়ে চেলে কাঠের কুচো আলাদা করে। জলে প্রায় তিনদিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভেজা লাক্ষা জল থেকে তুলে ধামার মধ্যে রেখে ঘষতে হয়।
এভাবে বার তিনেক করতে হয়। তবে গোলাকৃতি গালা তৈরি করতে হলে সাজি মাটির সঙ্গে একবার শোধন করতে হয়। এইভাবে প্রস্তুত গালার নাম "জৌ"। এরপর তিনবার শোধন করে তৈরি করা হয় "পাত গালা"।
শোধন কাজ শেষ হলে সেগুলিকে ৭-৮ লম্বা শক্ত কাপড়ের থলের মধ্যে রেখে চুল্লির উপর সেঁক দিতে হয়। গরমে গলিয়ে মাটির লম্বা খোলে ফেলা হয়। এভাবে তৈরি গালাকে বলে "পাঁচ গালা"। এই গালা দেখতে হলদেটে।
লোহার সঙ্গে লাহা বা লাক্ষা মিশিয়ে যে গালা হয় তাকে বলে "রং বেড়ী"। "পাতগালা" গলিয়ে তার সঙ্গে ধুনো, ইঁটের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করা হয় "কড়ার গালা"।
গালা বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। পুরনো দিনের গানের রেকর্ড এই গালা দিয়েই তৈরি হত। জাহাজের তলদেশ নির্মাণ, কাঠ, বার্ণিশ, শীলমোহর, শঙ্খের উপর প্রলেপ দিতে গালার বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কড়ার গালা স্বর্ণকারেরা সোনার নক্সা তৈরিতে এবং চুড়ি প্রস্তুত করতে ব্যবহার করে। গালা দিয়েদোয়াত, কলম, রুল, পেপার-ওয়েট এবং বিভিন্ন ধরণের খেলনার দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো।
বীরভূমের "ইলামবাজার"-এর গালার পুতুলের মতো পুরুলিয়ার "বলরামপুর"-এর গালার চুড়ি বিখ্যাত। এখানে বংশ পরম্পরায় শিল্পটি চলে আসছে। পূর্ব-পুরুষদের হাত ধরে রাজস্থানের জয়পুর থেকে গালা এখানে এসেছিল। তারপর নিজেদের চেষ্টায় তাঁরা এই শিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
"বাটালি" রূপে এঁরা লোকাল বাজার থেকে গালা কেনেন। লোহার সরু রিং-এর উপর গালা বসিয়ে বিভিন্ন ধরণের চুড়ি তৈরি করা হয়।
পোড়ামাটির বালা, প্রদীপ বা আর পাঁচটা ঘর সাজানোর জিনিস মেলায় বা বিভিন্ন শিল্পসামগ্রীর দোকানে সহজেই চোখে পড়বে। পোড়া মাটির উপর গালার প্রলেপ দেওয়া রং- বেরংয়ের নকশা করা পুতুল সেভাবে চোখে পড়ে না। পড়লেও তার সংখ্যা খুবই কম।
বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম অঙ্গ এই গালার পুতুল। যা হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে অনেক সংস্থা এই হারিয়ে যাওয়া শিল্পের সঙ্গে মূলধারার শিল্পের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য নানান পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারকেও এই শিল্পের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে এই প্রাচীন লোকশিল্প কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে