কার্তিক সংক্রান্তিতে কার্তিকের আরাধনা

চলতি কথায় বলে, 'কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, একবার আসে মায়ের সাথে, একবার আসে একলা'! সত্যিই তাই, এই আশ্বিন ঘুরে গেল, আবার কার্তিক মাসের শেষেই হাজির।

 

সৌম্য সুপুরুষ মানেই কার্তিক, সুদর্শন মানুষদের সঙ্গে কার্তিক ঠাকুরের তুলনা করা হয়। কার্তিক দেব সেনাপতি, বীরত্বের প্রতীক। বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে কার্তিক পুজো হয়ে আসছে। সন্তান কামনায় দম্পতিরা কার্তিক পুজোয় ব্রতী হন।

 

আবার কার্তিক ফেলা মজার এক লৌকিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নববিবাহিত দম্পতিদের সঙ্গে নিছক মজা করতে, কার্তিক পুজোর আগের দিন রাতে বাড়িতে কার্তিক ফেলে আসে পাড়ায় ছেলে ছোকরারা। সঙ্গে দেওয়া হয় খাবারের তালিকা। এ এক মজার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে আজ। আজ কার্তিক মাসের সংক্রান্তি, আজকেই কার্তিক পুজোর তিথি।

 

KartikPuja1

 

দেবী দুর্গা এবং মহাদেবের পুত্র হলেন দেব সেনাপতি কার্তিক। কার্তিক পৌরাণিক দেবতা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, দেব সেনাপতি কার্তিকের আরাধনায় পুত্র সন্তান লাভ হয়। কার্তিকের আরাধনায় যে শুধু পুত্র সন্তান লাভ হয়, তা কিন্তু নয়। কার্তিক পুজো করলে সংসারে সমৃদ্ধি আসে এবং শ্রীবৃদ্ধি হয়। যশ লাভ হয়।

 

কথিত আছে, কৃত্তিকা নক্ষত্রে কার্তিক ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল। ছয় কৃত্তিকার দ্বারা তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম কার্তিকেয় বা কার্তিক। কার্তিকের একাধিক নাম রয়েছে যেমন গুহ, পাবকি, মহাসেন, ষন্মুখ,কুমার, কুমারেশ, গাঙ্গেয়, বিশাখ, মহাসেন, কুক্কুটধ্বজ, নৈগমেয়।

 

অন্য একটি মতানুযায়ী, ব্রহ্মার বরে মহাতেজস্বী তারকাসুরকে নিধনের জন্যই, পরাক্রমশালী যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। তারকাসুর প্রবল পরাক্রমী বীর, দেবতার পক্ষে তাকে বধ করা সম্ভব ছিল না।

 

তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতাকুল অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। দৈববলে প্রাপ্ত অজেয় শক্তির অধিকারী এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেন। এই তারকাসুর নিধন করেই দেব সেনাপতি হলেন কার্তিক। কার্তিকের পুজো হয় মহাআড়ম্বরে, নানান উপাচারসহ।

 

KartikPuja2

 

স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের উল্লেখ পাওয়া যায়, মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে ও কার্তিকের মাহাত্ম্যের কথা বর্ণনা করা রয়েছে। কার্তিক ঠাকুর দক্ষিণ ভারতে খুবই জনপ্রিয়। তামিল ভাষাভাষীদের কাছে কার্তিকের রূপ হল ‘মুরুগন', তাঁদের অন্যতম প্রধান আরাধ্য দেবতা। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে যেখানে তামিল জনজাতির অধিবাসীদের সংখ্যা এবং প্রভাব বেশি, সেখানেই কার্তিক পুজোর প্রচলন হয়েছে। এশিয়া মহাদেশের একাধিক দেশে কার্তিক পুজোর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস ইত্যাদি স্থানে মুরুগন সুপরিচিত। সাড়ম্বরে মুরুগন পূজিত হন।

 

পুরাণ অনুসারে, কার্তিকের গাত্রবর্ণ হলুদ। তিনি চিরকুমার, তবে পুরাণ মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বিবাহের উল্লেখও পাওয়া গেছে। কার্তিকের বাহন ময়ূর। কার্তিকের ছয়টি মাথা, তাই তিনি ষড়ানন। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন।

 

তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক, পুজোতেও তাঁকে তীর ধনুক দেওয়া হয়। ষড়রিপুকে জয় করে কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন।

 

পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে।

 

KartikPuja3

 

কার্তিক চিরকুমার, তবে এই নিয়ে নানা লোককথা প্রচলিত রয়েছে, একদিন দানবদের সংহার করে কার্তিক বাড়ি ফিরছিলেন৷ তখন এক দেবকন্যার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেই দেবকন্যার নাম ছিল উষা। কার্তিক তাঁকে বিয়ে করতে চান৷ উষাও কার্তিকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। উষাকে সঙ্গে নিয়েই কৈলাশের কাছাকাছি পৌঁছান কার্তিক৷ কিন্তু আচমকাই তাঁর মনে হয়, বাড়িতে বউ নিয়ে যাওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলা উচিত৷ উষাকে ধানখেতে দাঁড় করিয়ে রেখেই দুর্গার কাছে যান কার্তিক৷ মায়ের অনুমতি নেন। মা মন থেকে অনুমতি দিলেন কিনা এই নিয়ে দ্বন্ধে পড়ে যান কার্তিক৷ দ্বন্ধ কাটিয়ে, বর সেজে ধানখেতের দিকে রওনা দেন তিনি৷ কিন্তু হঠাৎই মনে পড়ে মাকে প্রণাম করা হয়নি৷ ফিরে যান কার্তিক, কিন্তু মাকে খুঁজে না পেয়ে অবাক হন৷ খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে পৌঁছান কার্তিক৷ দেখেন, দুর্গা সদ্য নিহত একটি মহিষ খাচ্ছেন, এই দৃশ্য দেখে কার্তিক অবাক হয়ে পড়েন! কিন্তু কেন এমন তাড়াহুড়ো করে মা মহিষ খাচ্ছেন, প্রশ্ন করেন কার্তিক৷ পুত্রবধূ এসে যদি তাঁকে খেতে না দেয়, এই আশঙ্কার দুর্গা খাওয়াদাওয়া শুরু করেছিলেন। মায়ের কথা শুনে দুঃখ পান কার্তিক৷ ঠিক করেন, এভাবে উষাকে বিয়ে করবেন না। এদিকে, তখনও ধানখেতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন উষা৷ কার্তিক আর ফিরে আসেনি৷ অবশেষে তিনি জানতে পারেন কার্তিকের প্রতিজ্ঞার কথা৷ প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত বদল করেন উষাও৷ লজ্জায় ধানখেতেই লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন উষা৷ কার্তিক মাসে আমন ধানের শিষ বের হয়৷ অনেকেই বলেন ওই ধানের শিষই হল উষা৷ সেই কারণেই কার্তিক পুজোতে নতুন ধানের শিষ দেওয়া হয়।

 

গোটা বাংলা জুড়েই কার্তিক পুজো হয়। বাংলায় কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে কার্তিক পুজো করা হয়। তবে গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলির চুঁচুড়া, বাঁশবেড়িয়াতে বারোয়ারী সর্বজনীন কার্তিক পুজো হয়। বিশাল বিশাল আকারের অতিকায় কার্তিক প্রতিমার পুজো হয়।

 

আবার কাটোয়ার সুঠাম কার্তিকের লড়াই বাংলায় খুবই বিখ্যাত। এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কার্তিক লড়াই বলা হয়। কার ঠাকুর আগে যাবে এ বিষয় নিয়ে লড়াই হয়। এই অভিনব লড়াই বা যুদ্ধ রীতিমতো লাঠিসোটা, এমনকী তরোয়াল নিয়েও চলতে থাকে। এই লড়াই দেখতে মানুষ ভিড় জমায়। এছাড়াও হালিশহরের ’জ্যাংড়া কার্তিক’ ও ‘ধুমো কার্তিক’ পুজোও খুব বিখ্যাত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...