দেবী আদ্যাশক্তি কালীগঞ্জে বুড়ো মা রূপে পূজিত হন, পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে, বিপুল সংখ্যক লোক সমাগম হয়। কালীগঞ্জের হরিনাথপুরের ভট্টাচার্য পরিবার বুড়ো মার পুজোর প্রচলন করে। যা আজও চলে আসছে। ঐ পরিবারের এক সাধক সন্তান, রাজারামের অগ্রজ নৃসিংহের পুত্র দিননাথ তর্কালঙ্কার প্রথম আদ্যাশক্তির পুজো প্রচলন করেন।
দিননাথ মায়ের দর্শন পাওয়ার জন্য দীর্ঘ ও কঠোর সাধনা করেছিলেন। দিননাথের কাকা সাধক রাজারাম সিদ্ধান্ত কঠোর সাধনার মধ্যে দিয়ে শক্তিরূপিণী মাকে পেয়েছিলেন, তাই দিননাথেরও স্থির বিশ্বাস ছিল তিনিও সাধনার মাধ্যমে মাকে পাবেন। তাঁর এই বিশ্বাস সত্যি হয়েছিল। কঠিন মাতৃ আরাধনার শেষে, একদিন ঘুমের মধ্যে দিননাথ জগন্মাতার দর্শন পান এবং জগন্মাতাই তাঁকে নিজের পুজো প্রচলনের আদেশ দেন। সেই থেকেই মায়ের পুজো শুরু হয়।
নদিয়ার তথা ভারতের বিখ্যাত তন্ত্র সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতানুযায়ী, এখানে দক্ষিণাকালী রূপেই দেবী পূজিত হন। বিজয়া দশমীর দিনে শুদ্ধাচারে বোধন হয়, প্রতি বছর ঐদিন থেকেই খড় বাঁধার কাজ শুরু হয়। কালী পুজোর দিন দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে, দেবীর আরাধনা করা হয়। সারারাত্রি ব্যাপী পুজো চলে। বিখ্যাত ভট্টাচার্য পরিবারের উত্তরপুরুষেরাই আজও এই পুজোয় পৌরোহিত্য করেন। ভট্টাচার্য পরিবারের বৌমা বা মেয়েরাই আজও দেবীর ভোগ রান্না করেন। এই পুজোয় বিশেষ এক নিয়ম রয়েছে, বুড়ো মার পুজোয় যিনি পৌরোহিত্য করেন, তিনি ছাড়া অন্য কেউ পুজোয় অঞ্জলি দিতে পারেন না। দিননাথ তর্কালঙ্কারের সময় থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে।
তবে এই পুজো প্রচলনে সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক কাহিনী। গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই কাহিনী জানতে হলে, আমাদের ইতিহাসে পাড়ি দিতে হয়। সময়টা ছিল সতেরো শতকের একেবারে শেষভাগ, অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার মাঝের গ্রামে দেবীদাস ভট্টাচার্য নামে এক সাধক প্রকৃতির মানুষ বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন সাংসারিক বিষয়ে উদাসীন। বিষয়-আশয়, পৈতৃক সম্পত্তির প্রতি কোনদিনই তাঁর কোনও লোভ ছিল না। নিজের বাড়ি ছেড়ে একদিন তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন। চলে এসেছিলেন নদিয়ার কালীগঞ্জের জুরানপুর গ্রামের নিকটবর্তী শ্রীরামপুরে।
এই জুরানপুরে দেবী দুর্গার ধাতব মূর্তি, পঞ্চমুণ্ডির আসন ও ক্রোধীশ ভৈরবের মন্দির রয়েছে। প্রাচীনকালে এই জুরানপুরের নাম ছিল বারবাকপুর। শ্রীরামপুর গ্রামে বসবাস করার জন্য দেবীদাসকে কিছু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন অর্ধ বঙ্গেশ্বরী নাটোরের রানি ভবানী। দেবীদাসের সঙ্গে থাকতেন তাঁর স্ত্রী ও বড়ছেলে নৃসিংহ। নৃসিংহের জন্মের প্রায় ১২ বছর পরে দেবীদাসের কনিষ্ঠপুত্র রাজারাম সিদ্ধান্তের জন্ম হয়। রাজারামের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মাতৃবিয়োগ হয়, আট বছর বয়সে বাবাকেও হারান তিনি। শোনা যায়, দেবীদাসের ছোট ছেলে রাজারাম শ্রীরামপুরে এক বটগাছের নীচে বসে মাতৃসাধনা করেছিলেন। জগন্মাতাকে তিনি তাঁর স্ত্রীরূপে লাভ করতে সাধনা করেছিলেন।
তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী আদ্যাশক্তি রাজারামকে বলেছিলেন, তিনি দেবীকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার পরে বিস্ময়কর কোনও কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু তা দেখে যদি রাজারামের মনে কোনও রকম সংশয়ের উদয় হয়, তাহলে দেবী অ্যাদাশক্তি সঙ্গে সঙ্গেই রাজারামকে ত্যাগ করবেন। রাজারাম দেবীর প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল। রাজারাম মাতৃ আদেশ পেয়েছিলেন যে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের কাছাকাছি ভাবতা-মহুলা গ্রামে বিবাহযোগ্যা এক কন্যা রয়েছে। তার নাম শচীদেবী, এই শচীদেবীর সঙ্গেই রাজারামের বিয়ে হয়েছিল। বৌভাতের দিন অতিথিদের পঞ্চব্যঞ্জন পরিবেশন করছিলেন নববধূ শচীদেবী। সেই সময়ে হঠাৎই নববধূর মাথার ঘোমটা সরে যায়, তখন লজ্জা নিবারণের জন্য শচীদেবীর পিঠের দিক থেকে আরও দুটি হাত বেরিয়ে এসে মাথার উপর ঘোমটা তুলে দিল।
আশ্চর্যজনক এই ঘটনায় আমন্ত্রিত অতিথিরা সকলেই হতবাক হয়ে পড়েন, অনুষ্ঠানবাড়িতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ দেখা যায় যাকে নিয়ে এত কাণ্ড সেই শচীদেবীই বাড়িতে নেই! তাঁকে আশেপাশেও কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বাড়িতে স্ত্রীকে না পেয়ে, খুঁজতে বেরিয়েছেন রাজারাম। কোথায় কোথায় শচীদেবী যেতে পারেন সেই পথ অনুমান করে স্ত্রীর একরকম পিছুই নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। শচীরূপী দেবী আদ্যাশাক্তি তা বুঝতেও পেরেছিলেন। তাই পথে এক মৎস্যবিক্রেতা মহিলার সঙ্গে দেখা হতেই, তিনি ওই মহিলাকে তিনি বলেন, 'তুমি যে এ পথে আমাকে দেখেছ এ কথা অন্য কাউকে বলবে না।' মৎস্যবিক্রেতা অবাক হলেন। অন্যদিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই পথে এসে পড়েন রাজারাম।
ওই মৎস্য বিক্রেতা মহিলার সঙ্গে দেখা হতেই, তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, এই পথে এর আগে কোনও স্ত্রীলোককে যেতে দেখেছেন কিনা। মৎস্যবিক্রেতা মহিলা শচীদেবীর নির্দেশ অমান্য করেই রাজারামকে সব বলে দেন। বলা মাত্রই ওই মহিলার রক্ত বমি শুরু হয়, বমি করতে করতে রাজারামের চোখের সামনেই তিনি মারা গেলেন। এর পরের ঘটনা আর জানা যায় না। হয়ত এরপরে রাজারাম আর তাঁর স্ত্রীর খোঁজ করেনি। এরপর থেকেই বুড়ো মার পুজোর প্রচলন হয়।