"হরিণ নয়না শুন কাদম্বিনী বালা,
শুন ওগো চন্দ্রমুখী কৌমুদীর মালা।
... ... ... ... ... ...
বেঁচে থাক, সুখে থাক চিরসুখে আর।
কে বলে রে বাঙ্গালীর জীবন অসার?"--কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮২ সাল নাগাদ এভাবেই আশীর্বাদ ও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বাংলার দুই কন্যা কাদম্বিনী বসু এবং চন্দ্রমুখী বসুকে। কেন? কেননা, এই দুই মেয়ে একইসঙ্গে বাংলা তো অবশ্যই, ভারতবর্ষ তো বটেই, এমনকি সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট' হলেন এ-বছর। ইতিহাস তৈরি হল।
উনিশ শতক বাংলার নারীদের নবজাগরণের শরিক করে তোলার কাল, শরিক হয়ে ওঠার কাল। আর তার জন্য সমাজসংস্কারকেরা শিক্ষাকে মধ্যযুগীয় পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন শতকসূচনা থেকেই। যথারীতি গড়ে উঠেছিল, প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল--দুই পক্ষ। প্রতিক্রিয়াশীলদের কু-যুক্তির বহর ছিল দেখার মতো। এই যেমন ধরুন, ভূধর চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বেদব্যাস' পত্রিকার কথাই। সেখানে ১২৯৬ বাংলা সনের বৈশাখ মাসে লেখা হল--'প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষাও নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা ইহার দ্বারা নারীর পুত্র প্রসবোপযোগিনী শক্তিগুলির হ্রাস হয়। বিদুষী নারীগণের বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায়, এবং তাঁহাদের স্তনে প্রায়ই স্তন্যের সঞ্চার হয় না, এতদ্ভিন্ন তাঁহাদের জরায়ু প্রভৃতি বিকৃত হইয়া যায়। ... বিদ্যা নানারূপে আমাদের মঙ্গলের কারণ হইলেও নারীগণের পরম শত্রু।' চক্রান্তটা বুঝলেন! এরসঙ্গে ব্যঙ্গ-কবিতা ও ব্যঙ্গ-নাটকের চটুল অথচ ওস্তাদী ধোঁয়া তো ছিলই। ছোটবড় মেয়েমদ্দ সব্বাই সে ধোঁয়ার মৌজে মজবার বিস্তর রসদ পেত। কারণ, একালের মতো সেকালেও চটুল জিনিসের কদর সমানতালেই ছিল। ফলে, প্রগতিশীলদের পথটা সামাজিকভাবে কতটা কণ্টকিত ছিল, সেটা অনুমান করাই যায়। বিদ্যাসাগর, প্যারীচরণ সরকার, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, কালীকৃষ্ণ মিত্র, নবকুমার মিত্র, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতো প্রগতিশীল পণ্ডিতেরা এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই নারীশিক্ষার পথ প্রস্তুত করেছেন, মেয়েদের জন্য একের পর এক বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপন করেছেন। আর কাদম্বিনী, চন্দ্রমুখী, অবলা বসুদের মতো সাহসিনীরা সমাজের বাধা ও বাঁকাচোখ উপেক্ষা করে নিরবধি সেই পথকে অলঙ্কৃত করেছেন।
মোকাম কলিকাতার তখন সবেতেই হুজ্জুতি। পান থেকে চুন খসলেই হুলুস্থূল। পরের বছর কাদম্বিনী বিয়ে করলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে। ভদ্রলোক কাদম্বিনীর থেকে সতেরো বছরের বড়। তায় প্রথম স্ত্রী একটি মেয়ে এবং একটি মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে রেখে মারা গেছেন। তায় আবার কাদম্বিনীর প্রাক্তন শিক্ষক। সম্পর্কটায় একদল বেশ রগরগে প্রেমের গন্ধ পেয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে নর্দমা করে তুলল। আর একদল তরুণ-বাবু কাদম্বিনীর মতো বিদূষীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আশা মনে মনে পোষণ করেও না-পেয়ে হতাশ হল কিংবা সেই খেউড়ে যোগ দিল। তবে হ্যাঁ, সম্পর্কটা প্রেম থেকেই পূর্ণতা পেয়েছিল। দু'জন দু'জনকে ঠিকই চিনেছিলেন। কাদম্বিনী যেমন সমাজের সংকীর্ণতাকে তোয়াক্কা করেননি; তেমনি পুরুষ হিসেবে দ্বারকানাথও ছিলেন একদম সোজা মেরুদণ্ডের লোক। স্ত্রী-শিক্ষা প্রসার, বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন, নীলকর ও চা-কর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং অধিকার রক্ষার লড়াই--সবেতেই তিনি ছিলেন প্রথমসারিতে এগিয়ে। ফলে, শাস্ত্রমতে রাজযোটক। তাঁরা ব্রাহ্ম। সুতরাং, তাঁদের বিয়ে হল ব্রাহ্ম মতে। যদিও বয়সজনিত বাধা ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ব্রাহ্মসমাজ এবং সংস্কারপথের বন্ধুদের মধ্যে আনন্দমোহন বসু, উমেশচন্দ্র দত্ত ও শিবনাথ শাস্ত্রী এই বিয়েতে মত দেননি। তাই তাঁরা বিয়েতে যোগও দেননি। কিন্তু, ব্যক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তে কাদম্বিনী বা দ্বারকানাথ কাউকে নাক গলাবার সুযোগ দিতে চাননি। মানভঞ্জনেরও চেষ্টা করেননি। উল্টে বন্ধুদের উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছিলেন যে, তাঁরা কতটা অনধিকার চর্চা করছিলেন!
বিয়ের পর কাদম্বিনী ডাক্তারি পড়তে চাইলেন মেডিকেল কলেজে। তাতেও এলো বাধা। তখন গ্রাজুয়েট হলেই ডাক্তারি পড়া যেত। কিন্তু, মেডিকেল কাউন্সিল তাঁর ভর্তির ব্যাপারে সটান 'না' বলে দিল। তাদের যুক্তি, মেডিকেল কলেজ তো মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট কলেজ নয়। এতদিন কোন মেয়ে মেডিকেল নিয়ে পড়েওনি। আজ হঠাৎ অনেক ছেলের মাঝে একটা মেয়ে কী করে সামাজিক বিধিনিষেধ শালীনতা বজায় রেখে দিনের পর দিন ক্লাস করবে! এসব তো আর ছেলেখেলা নয়। আর তাছাড়া এনাটমি শিক্ষার সময় মানুষের বিভিন্ন গোপন অঙ্গ সম্পর্কে আলোচনায় একটি মেয়ের সামনে পুরুষ অধ্যাপকেরা কী করে স্বচ্ছন্দ হবেন! কিন্তু, কাদম্বিনী শেখার ইচ্ছেয় এবং দ্বারকানাথ শেখানোর উৎসাহে অনড়। মেডিকেল কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গড়ে তুললেন প্রবল আন্দোলন। তাতে ব্রিটিশ অধ্যাপকরা কাদম্বিনীর ব্যাপারে খানিক নরম হলেও এক বাঙালি অধ্যাপক ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কিছুতেই এমন সৃষ্টিছাড়া দাবি মানতে চাইলেন না। শেষমেশ দ্বারকানাথের আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতাদের সক্রিয় সমর্থন আসতেই বাংলার ছোটলাট রিভার্স অগস্টস টমসন নড়েচড়ে বসলেন। তিনি নিজে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে কাদম্বিনীকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বিশেষ ক্ষমতার আশ্রয়ে ভর্তি তো হলেন, কিন্তু তা যে বাঙালি অধ্যাপক এন্ড কোম্পানির আঁতে লাগল--এটা ক'দিন ক্লাস করতে না করতেই বেশ বুঝতে পারলেন কাদম্বিনী। ওই হাবেভাবে ব্যবহারের সামান্য রকমফেরে যেটুকু বোঝা যায় আর কী! সে-সব গায়ে না মেখে পুরুষ সান্নিধ্যের প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে পরম নিষ্ঠায় তিনি শিখতে লাগলেন চিকিৎসাশাস্ত্র। এম বি-র পাঁচ বছরের কোর্সে তিন বছরে মাথায় প্রথম পরীক্ষাটি হল। তাতে মেটিরিয়া মেডিকা ও এনাটমিতে ফেল করলেন কাদম্বিনী। এবার বুঝলেন, ব্রিটিশ ছোটলাটের আনুকূল্যে এখানে ঢুকে না-হয় পড়েছেন; কিন্তু, বাঙালির ব্যূহভেদ করে বেরোনো তাঁর পক্ষে কঠিন! হয়তো বা অসম্ভব। তবে, ব্রিটিশ অধ্যাপকরা দয়া-পরবশ হয়ে তাঁর পাঠনিষ্ঠার কথা মাথায় রেখে গ্রেস দিয়ে তাঁকে পাশ করানোর আর্জি জানালেন। আর্জি মঞ্জুর হল। কাদম্বিনী পাশ করলেন। কিন্তু, পাঁচ বছরের মাথায়, শেষ পরীক্ষায় আবার ফেল করলেন। এবার, মেডিসিনে। এবার আর কোন আর্জিতে কিছু হল না। সার্টিফিকেট কোর্স করিয়ে তাঁকে অবশ্য প্র্যাকটিস করার অধিকার দেওয়া হল। তিনি যোগ দিলেন ইডেন হসপিটালে। তিনশো টাকার চাকরি। কিন্তু, সেখানে তাঁকে ডাক্তারের মর্যাদা দেওয়া হল না, তাঁকে দিয়ে নিয়মিত ধাত্রীর কাজ করানো হতে লাগল। এইসব অপমান মুখ বুজে সইবার মানুষ কাদম্বিনী বা দ্বারকানাথ নন। উপযুক্ত জবাব দিতেই হবে। সাফল্য দিয়ে। তাই দ্বারকানাথ কাদম্বিনীকে ১৮৯২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত পাঠালেন। মাত্র এক বছরেই কাদম্বিনী এডিনবরা থেকে এল.আর.সি.পি ও এল.আর.সি.এস এবং গ্লাসগো থেকে এল.এফ.পি.এস ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন। সব বাধা জয় করে প্রতিক্রিয়াশীল ঈর্ষাকাতর নিন্দুকদের মুখে ঝামা ঘষে হয়ে উঠলেন 'ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক' থেকে 'ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসা-শিক্ষক'।
তথ্য ঋণ : অনন্যা কাদম্বিনী--সুবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়।