বস্ত্রহরণ করলেন কৃষ্ণ। গোপিনীদের বস্ত্র।
বৃন্দাবনের কাননের মাঝে সরোবর, সেখানে গোপিনীরা সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে স্নান করছিলেন। এমনিভাবেই রোজ তাঁরা স্নান করেন। সরোবরের পাড়ে কদম গাছ, তারই নীচে খুলে রাখেন পরনের কাপড়।
বৃন্দাবনের পুরুষেরা এই সরোবরে আসেন না। তাই গোপিনীরা খুব নিশ্চিন্ত হয়ে স্নান করছিলেন। কিন্তু কিশোর কৃষ্ণ সেই অবসরে তাঁদের খুলে রাখা বস্ত্রগুলো চুরি করলেন। তারপর চুপি চুপি উঠে বসলেন কদম গাছের এমন এক ডালে, যেখান থেকে সরোবর দেখা যায়, সরোবর থেকে তাঁকে দেখা যায়।
গোপিনীরা তাঁকে দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন, কৃষ্ণের কীর্তির কথা। বিপদ বুঝে তাঁরা কৃষ্ণের কাছে খুব কাকুতিমিনতি করলেন বস্ত্রগুলো ফেরত পাবার জন্য।
কিন্তু কৃষ্ণের এক কথা, তিনি বস্ত্র ফেরত দেবেন না, গোপিনীদের নিরাবরণ দেখবেন। জল থেকে নিরাবরণ উঠে এসে তাঁর কাছ থেকে বস্ত্র নিয়ে যেতে হবে, তবেই তিনি বস্ত্র ফেরত দেবেন।
গোপিনীরা প্রথমে কাকুতি মিনতি করলেন। তারপর নন্দরাজ আর মা যশোদাকে সব বলে তাঁকে মার খাওয়াবেন বলে ভয়ও দেখালেন। কিন্তু তাতে কৃষ্ণ মোটেই ভয় পেলেন না, বরং হেসে বললেন, যাও না যাও, এই নিরাবরণ অবস্থায় গিয়ে যদি তাঁদের কাছে নালিশ জানাতে পারো, যাও না গিয়ে নালিশ জানাও, আমি ভয় পাই নাকি!
এ-কথার ওপর আর কথা চলে না। জলে সারাদিন বসেও থাকা যায় না। কাজেই নিরাবরণ হয়েই একে একে গোপিনীরা উঠে এলেন তীরে, কৃষ্ণের কাছে থেকে ফিরিয়ে নিলেন তাঁদের বস্ত্র। কৃষ্ণ তাঁদের নিরবারণ দেখলেন। যেমন স্ত্রীকে দেখেন স্বামী, তেমনি করে।
বস্ত্রহরণের এই ঘটনাটিকে স্থূলভাবে দেখলে তা থেকে অশ্লীলতা আর ব্যাভিচারিতার গন্ধ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। ভাগবতের প্রতিটি ঘটনারই মধ্যে আছে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা। এগুলোকে সেভাবেই দেখতে হবে। এই ঘটনারও আছে দুটি কার্যকারণঃ
প্রথমত, দেবী অম্বিকা গোপিনীদের পুজোয় একবার তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে গোপিনীরা কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পেতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে নিরাবরণ সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ তাই তাঁদের সে ইচ্ছে পূর্ণ করলেন।
দ্বিতীয়ত, কাপড় যেমন আমাদের শরীর ঢেকে রাখে, তাকে মুক্তি দেয় না; তেমনি ‘আমি’র অহং আমাদের অন্তর ঢেকে রাখে, তাকে মুক্ত করে না। বস্ত্রহরণের রূপকে কৃষ্ণ তাঁর প্রিয়ভক্ত গোপিনীদের সেই ‘অহং’ হরণ করে তাঁদের মোক্ষপথের সন্ধান দিয়েছিলেন।
এখানে যেটা লক্ষ করার, সেটা হল, বস্ত্রহরণের সময় গোপিনীদের মধ্যে একমাত্র রাধা ছিলেন না। যদিও তাঁর মতো প্রেমিকভক্ত আর কেউ ছিলেন না, কৃষ্ণই ছিলেন তাঁর ধ্যান, কৃষ্ণই ছিলেন তাঁর জ্ঞান। তবুও তাঁর মধ্যেও ছিল ‘আমি’র বেড়া। সেই বেড়া ভাঙতে কৃষ্ণ আয়োজন করেছিলেন ঝুলন লীলার।
ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথির ঘোর বর্ষায় যখন প্রাকৃত প্রাণীরা কামলীলায় মত্ত; তখন আয়োজন শুরু হল রাধাকৃষ্ণের ঝুলন লীলার।
যমুনাতীরের যে কদম গাছটি ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল তার ডালে দোলনা বাঁধা হল, দোলনা সাজানো হল নানা রঙের ফুল দিয়ে। এমনকি কৃষ্ণ ও গোপিনীরাও ফুলে-মালায় সেজে উঠলেন।
ফুলমালায় সেজে সেখানে রাধারও আসার কথা। কিন্তু অনেক বাধা কাটিয়ে আসতে রাধার খানিক দেরি হল। পথে তিনি ভাবতে ভাবতে আসছিলেন যে, কৃষ্ণ হয়তো তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন।
কিন্তু এসে দেখলেন কোথায় কী! কৃষ্ণ এরই মধ্যে গোপিনীদের সঙ্গে মেতে উঠেছেন ঝুলন খেলায়! তাই দেখে বড় অভিমান হল তাঁর। আমার চেয়ে তারা বড় হল! তাদের প্রেম কি আমার চেয়েও বড়? আমাকে উপেক্ষা করলেন কৃষ্ণ? বেরিয়ে এল ‘আমি’র অহং। বুকফাটা অভিমান কান্না হয়ে নেমে এল চোখ বেয়ে।
ঠিক তখনই কৃষ্ণ তাঁর কাছে এলেন, চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিলেন, রাধার এই যে অভিমান, এর কারণ আসলে ‘আমির আবরণ’। অন্তরে কৃষ্ণকে বসিয়েও রাধা তাই তাঁকে যেন পুরোপুরি পেয়েও পাচ্ছেন না। এই যে দেহটা এর মধ্যেই কি শুধু রাধা আছেন? তা তো না। তিনি তো সমস্ত চরাচরে, সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে রয়েছেন। এমনকি এই যে গোপিনীরা, এঁদের মধ্যেও রয়েছেন। রাধা বিরহের বেলায় কালো মেঘের মধ্যে যেমন শ্যামকে দেখেন, তেমনি কৃষ্ণও পুরুষ হয়ে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে রাধাকে খোঁজেন।
রাধা কৃষ্ণের কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। এসে বসলেন দোলনায়, প্রিয় কৃষ্ণের পাশে। গোপিনীরা দোলনায় দোল দিতে লাগলেন পরম আনন্দে। ‘আমি’র অহং চূর্ণ হয়ে মিলন হল বাইরের রাধার সঙ্গে অন্তরের কৃষ্ণের। পূর্ণরূপে ইষ্টকে পাবার তখন আর কোন বাধা রইল না।
এই পথে অহং-এর আবরণ খুলে নিরাবরণ-প্রকৃতি হয়ে চৈতন্যদেব ও রামকৃষ্ণদেব রাধাভাবে ইষ্টের সাধনা করেছেন, ইষ্টকে পেয়েওছেন। আসলে, এই পথ দেখানোতেই ঝুলন লীলার সার্থকতা।