আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, ব্রহ্মার আদেশে দক্ষ ও অন্যান্য আদি প্রজাপতিরা প্রজাসৃষ্টির জন্য দেবী আদ্যাশক্তির স্তব করতে গেলেন। দক্ষের তপে দেবী তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন যে, তিনি দক্ষের কন্যা ‘সতী’রূপে জন্ম নেবেন। কিন্তু দক্ষ যদি তাঁর প্রতি কোন অন্যায় ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি দেহত্যাগ করবেন। তারপর দেবী দক্ষকে আদেশ দিলেন বীরণের কন্যা অসিক্লীকে বিবাহ করতে।
এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…
আদি দশজন ছাড়াও ব্রহ্মদেব আরও অনেক প্রজাপতিরই জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, ‘বীরণ’। এই বীরণের একটি কন্যা ছিল, তাঁর নাম, ‘অসিক্লী’। প্রদত্ত নামের পাশাপাশি সেই সময়ের প্রথা অনুযায়ী বাবা বা মায়ের নামে অর্থাৎ ‘অমুকের পুত্র’ বলে সন্তানকে ডাকা হত। যেমন, সুমিত্রার পুত্র লক্ষ্মণকে বলা হত, ‘সৌমিত্রি’; তেমনি বীরণের কন্যা অসিক্লীকে সবাই ডাকতেন ‘বৈরণী’ বলে।
সুন্দরী, যৌবনবতী ও অতি সুলক্ষণা কন্যা অসিক্লী। সুতরাং বিবাহযোগ্যা। তাই কন্যার পিতা বীরণ বসে ছিলেন না। বেশ কিছুকাল ধরেই উচাটন হয়ে সৎপাত্রে কন্যাকে সম্প্রদান করার কথাই ভাবছিলেন। শুধু ভাবছিলেনই না, দেবর্ষি নারদকে সেই ব্যাপারে খানিক খোঁজ নিতেও বলেছিলেন। কিন্তু কই, তিনি তো এখনও কোন খোঁজ দিলেন না!—এই কথাটিই যখন ভাবছিলেন বীরণ, ঠিক তখনই ‘নারায়ণ, নারায়ণ…’ বলতে বলতে বীণা কাঁধে ঢেঁকিবাহন নারদ তাঁর কাছেই হাজির হলেন।
নারদকে দেখে বীরণ বেশ খুশি হলেন। কেননা, দেবর্ষি এমনি এমনি কোথাও আসা-যাওয়ার লোক নন, তাঁর গমনাগমনে নিশ্চিত একটি উদ্দেশ্য থাকে। এক্ষেত্রে নির্ঘাত বীরণের আকাঙ্ক্ষাও নিহিত আছে।
হ্যাঁ, বীরণ যা ভেবেছিলেন তাই। কেননা, সাদর সম্ভাষণের পরই নারদ একগাল হেসে বললেন, পেয়েছি বুঝলে হে বীরণ, পেয়েছি! তোমার কন্যার উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেয়েছি। দেবী আদ্যাশক্তির একান্ত ইচ্ছা তাঁর সঙ্গেই তোমার কন্যার বিবাহ হোক।
নারদের কথা শুনে বীরণের আহ্লাদের সীমা রইল না। ব্যগ্র হয়ে বললেন, তা বেশ, তা বেশ। পাত্রটি কে?
নারদ হেসে বললেন, প্রজাপতিশ্রেষ্ঠ দক্ষ! দেবীর আদেশে তোমার কন্যার পাণিগ্রহণের জন্য তিনিও অধীর।
দক্ষের নাম শুনে বীরণ যার পর নাই আনন্দিত হলেন। বললেন, অহো কী সৌভাগ্য আমার! হে দেবর্ষি, তাহলে শুভকর্মে আর বিলম্ব কীসের! আপনি আমার সাদর সম্মতিবার্তা তাঁকে গিয়ে জ্ঞাপন করুন। আর বলুন সত্ত্বর বিবাহ-অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হতে।
অমনি বিদায় নিয়ে নারদ সানন্দে ‘নারায়ণ, নারায়ণ’ ধ্বনি তুলে দক্ষ-ভবনের দিকে যাত্রা করলেন।
তারপর…
তারপর আর কী, দারুণ ধুমধামের সঙ্গে দক্ষ ও অসিক্লীর বিবাহ হয়ে গেল। বিবাহের মাস দুয়েক যেতে-না-যেতেই অসিক্লীর গর্ভলক্ষণ দেখা দিল। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে অসিক্লী একটি অপূর্ব লাবণ্যশালিনী কন্যার জন্ম দিলেন।
সেই লাবণ্যময়ী কন্যাকে দেখলেই বোঝা যায় যে, তিনি মোটেই সাধারণ নন। তাঁর অঙ্গের চারিপাশে আলোকময়ী এক বলয়। মুখে সদ্যোজাতের কান্নার বদলে বিনিন্দিত হাসি। তিনি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গগনমণ্ডল হতে বহুবর্ণের সুগন্ধী পুষ্পসমূহ বর্ষিত হতে শুরু করল, মেঘমালা হতে ঝরে পড়তে শুরু করল মন্দ মধুর বারিধারা। জ্বলে উঠল নির্বাপিত দীপসকল। শঙ্খের শুভনাদে ভরে উঠল আকাশ-বাতাস।
দক্ষ তো জানতেনই যে, দেবী আদ্যাশক্তি তাঁর কন্যারূপে জন্ম নিচ্ছেন। সেই অপেক্ষাতেই তিনি দিন গুণছিলেন। তাই জন্মমুহূর্তের ঐ সব শুভ লক্ষ্মণসমূহ তাঁকে একেবারে বিহ্বল করে তুলল। অমনি তিনি কন্যাকে দেবীরূপে স্তব করে প্রণাম-বন্দনা করতে শুরু করলেন। সন্তানের জন্ম দিয়ে ক্লান্তি ও অবসন্নতায় প্রায় অচেতন থাকায় অসিক্লী অবশ্য এসব কথা জানতেও পারলেন না।
দক্ষের এই বিহ্বলতা দেখে দেবী আদ্যাশক্তি প্রসন্ন হলেন। কিন্তু তাঁর এই নব লীলা যে এতে বিঘ্নিত হবে, এটা ভেবে শঙ্কিতও হলেন। এ-কথা মনে হতেই ভাসমানবাণীতে দক্ষের কানে কানে মৃদুভাষে দেবী বললেন, হে দক্ষ, তুমি যে-কারণে আমার আরাধনা করেছিলে, তা এখন সিদ্ধ হয়েছে। এবার লীলার বশবর্তী হও! বিহ্বলতার কারণ বিস্মৃত হও! কন্যার প্রতি পার্থিব পিতার মতো আচরণ কর!
দেবীর কণ্ঠ স্তব্ধ হতেই দেবীর মায়ায় দক্ষ বিহ্বলতার কারণ বিস্মৃত হলেন। দেবীও শয্যায় কন্যারূপে রোদন করতে শুরু করলেন। তাঁর এই কান্নায় অসিক্লীর চেতনা ফিরে এল। তিনি অমনি কন্যাকে বুকে টেনে নিয়ে আপন স্তন পান করাতে শুরু করলেন। ভরিয়ে দিতে লাগলেন বাৎসল্যের আদরে। আর তখন কন্যার অঙ্গে সত্ত্বগুণপনার চিহ্ন দেখে দেবীর মায়ায় দক্ষ সদ্যোজাতের নাম রাখলেন, ‘সতী’।
পিতামাতার আদরে-যত্নে-বাৎসল্যে দিনে দিনে চন্দ্রকলার মতোই বেড়ে উঠতে লাগলেন সতী। তাঁর এই ছোট থেকে বড় হওয়ার পরতে পরতে দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতি অমোঘ এক আকর্ষণ দেখা যেতে লাগল। তাঁর সকল কাজে সকল খেলায় জড়িয়ে থাকতে দেখা যেতে লাগল মহাদেবকে। সখীদের সঙ্গে খেলার মুহূর্তে পুতুল গড়ার সময় অন্যেরা নিছক পুতুল বানালেও তিনি বানাতে লাগলেন শিবের মূর্তি। তাঁর অবসর বিনোদনের গানও হয়ে উঠতে লাগল শিব-শতনামের মন্ত্রগান। এইভাবে তিনি ক্রমে হয়ে উঠতে লাগলেন শিবময়, শিবই হয়ে উঠতে লাগলেন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।
এমনি করে সতী একদিন বাল্য ও কৈশোরের উপবন পেরিয়ে যৌবনে পা রাখলেন। হয়ে উঠলেন পিতামাতার আরও আদরের। শিবের জন্যও হলেন আরও আরও ব্যাকুল। এ-ব্যাকুলতা তাঁকে স্বামী হিসেবে পাবার ব্যাকুলতা।
তারই মধ্যে একদিন উদ্যানে সতী যখন পরমানন্দে পিতার পাশে বসে অবসরযাপন করছিলেন, তখনই তাঁদের সম্মুখে সাক্ষাৎ অভিলাষী হয়ে হাজির হলেন ব্রহ্মা ও নারদ। পিতা ও প্রজাপতি-ভ্রাতার দর্শন পেয়ে দক্ষ অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়ে তাঁদের প্রণাম করে আসন দিলেন। করলেন আপ্যায়নের আয়োজন। সতীও ভক্তি ও বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের পদবন্দনা করে প্রণাম করলেন।
সতীর ভক্তি ও শ্রদ্ধায় প্রীত হয়ে স্মিত হেসে নারদ ধীরে ধীরে বললেন, হে কল্যাণী, আশীর্বাদ করি, তুমি যাঁকে পতিরূপে কামনা করো, সেই জগদীশ্বর তোমার পতি হউন! এও জেনো, তিনি তোমার জন্যই অপেক্ষা করে আছেন, তুমি ছাড়া তাঁর দ্বিতীয় কোন পত্নী নেই…’।
দেবর্ষির এই কথায় সতী লজ্জানতা হলেন। মনে মনে বললেন, আমি যাঁকে পতিরূপে কামনা করি, সেই মহাদেব ছাড়া জন্মান্তরেও আমার কোন পতি নেই। জন্ম-জন্মান্তরে তিনিই আমার একমাত্র আশ্রয়। আমার সেই আশ্রয়কে এখন কেমন করেই বা পাব! কে জানে…
দীর্ঘশ্বাস হয়ে ব্যাকুলতা বেরিয়ে আসে সতীর অন্তর হতে। তাই দেখে নারদ ও ব্রহ্মার দৃষ্টি বিনিময় হয়। নতুন এক লীলার ইঙ্গিতে তাঁদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে স্মিত রহস্যের হাসি…
[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]
কাহিনিসূত্রঃ
দেবী ভাগবত পুরাণ
কালিকা পুরাণ