একান্ন সতীপীঠের পথে পথে : পর্ব-৫: দেবী সতীর কাহিনি

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, ব্রহ্মার মানসপুত্র ‘হলাহল’ নামের এক অসুর ব্রহ্মার কাছে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়ে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল অধিকার করে প্রবল অত্যাচার শুরু করেছে। দেবতারা তার অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে ব্রহ্মার শরণ নিয়েছেন। ব্রহ্মা আবার নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছেন। বিষ্ণু ও মহেশ্বর দেবতাদের আর্তিতে আবির্ভূত হয়ে হলাহলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু তার আগে ব্রহ্মার উপর একটি শর্ত আরোপ করতে চেয়েছেন। তাতে ব্রহ্মা যুগপৎ ভীত ও বিস্মিত হয়েছেন।

এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…

বিস্মিত ও ভীত ব্রহ্মার সামনে এই মুহূর্তে শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তা সে যে-শর্তই হোক না কেন! কেননা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ‘হলাহল’ নামের যে বিপদটি তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছে, সেটি যে তাঁরই সৃষ্টি! তাই তিনি আশঙ্কা আড়াল করতে করতে কোনরকমে বললেন, হে দেবশ্রেষ্ঠ, বলুন আপনাদের কী শর্ত?

ব্রহ্মার ত্রস্ত মানসিক অবস্থার কথা অন্তর্যামী বিষ্ণু ও মহেশ্বর দু’জনের কারও কাছেই অবিদিত ছিল না। তাছাড়া তাঁর মুখমণ্ডলের রক্তিম আভায় সেই মানসিকতার প্রতিফলনও ঘটছিল।

তাই বিষ্ণু বা মহেশ্বর ব্রহ্মার সঙ্গে কোন হেঁয়ালি না-করে সরাসরি বললেন, হে ব্রহ্মদেব, ভয় পেয়ো না। আমাদের শর্তে ভয় নেই, দায়িত্ব আছে। আপনার বরে হলাহল শুধু আপরাজেয় নয়, আমাদেরও অবধ্য। জগতে ধর্মস্থাপনের জন্য আমরা যুদ্ধ করব বটে, তবে তা কখন শেষ হবে আমরা কেউ জানি না। কখন সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। স্বর্গ অধিকার করে সে স্বহস্তে  পূর্বনিশ্চয়ের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাই এ হে ব্রহ্মা, আপনি যদি আমাদের ওপরে জগতের স্থিতি-লয়ের যে দায়ভার দেবী আদ্যাশক্তি দিয়েছিলেন, যুদ্ধকালে আপনি যদি তা নিজের দায়িত্বে রাখেন, তাহলে নিশ্চিন্তে আমরা সেই অনির্দিষ্টকালের যুদ্ধে অংশ নিতে পারি। এটাই আমাদের শর্ত। এবার বলুন, আপনি নেবেন সেই দায়িত্ব?

বিষ্ণু ও মহাদেবের কথা শুনে ব্রহ্মা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি সানন্দেই রাজি হয়ে গেলেন দায়িত্ব নিতে। তখন দেবতাদের মধ্যে আনন্দের স্রোত বইল। ঘোর নাদে তাঁরা ত্রিদেবের নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন।

সমবেত দেবতাদের কণ্ঠে উচ্চারিত সেই তুমুল জয়ধ্বনি অমনি আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হল, সবেগে ত্রিলোকে ব্যাপ্ত হয়ে গেল। সেই পুণ্য ও প্রবল জয়ধ্বনিতে কেঁপে উঠল হলাহলের আসন। সেই জয়ধ্বনি তার কাছে বিষের মতো অসহ্য মনে হল।

হলাহল এখন ত্রিলোকের অধিপতি। তাই যদি জয়ধ্বনি ওঠে, তাহলে তা কেবলমাত্র তার নামেই উঠবে। অন্য কারও নামে নয়। তাই দেবতাদের মুখে ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’-এর নামে জয়ধ্বনি শুনে সে দারুণ ক্রুদ্ধ হল। জয়ধ্বনি যত অনুরণিত হতে লাগল। তার ক্রোধের পরিমাণ ততই বাড়তে লাগল। অবশেষে দেবতাদের জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে এক সময় সে প্রচণ্ড ক্রোধে কাঁপতে লাগল। তখন জগতকাঁপানো নিদারুণ হুঙ্কার ছেড়ে সমস্ত অসুর সৈন্য নিয়ে সে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে একযোগে ব্রহ্ম লোক, শিব লোক ও বৈকুণ্ঠ লোক আক্রমণ করতে বিদ্যুৎগতিতে অগ্রসর হল।

অযুত-অর্বুদ অসুর সেনাদের রণ-উন্মত্ত হয়ে ধেয়ে আসতে দেখে দেবতারা আরও জোরে জোরে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন। বেগতিক দেখে বিষ্ণু-মহেশ্বরও দ্রুত অবতীর্ণ হলেন রণরঙ্গে। অগ্রসর হয়ে আটকে দাঁড়ালেন হলাহল সহ সমস্ত অসুর সৈন্যের পথ। শুরু হল ভয়ানক যুদ্ধ।

বিরামহীন বিশ্রামহীন সেই যুদ্ধ চলতে লাগল দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। বলবীর্যে কেউ আর কম যান না। সমানে সমানে ধর্ম ও অধর্মের সেই যুদ্ধে ক্রমান্বয়ে কেটে গেল কয়েক হাজার বছর। কিন্তু তখনো পর্যন্ত যুদ্ধের নিষ্পত্তি ঘটার সামান্যতম সূত্রও দেখা গেল না।

ওদিকে ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে ফিরে তাঁর সাধের কমলাসনে বসে অপরাপর অসংখ্য মানসপুত্র ও মানসকন্যাদের সৃজনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির কাজ তো করছিলেনই, সেই সঙ্গে পালনের কাজ এবং নিধনের কাজও একা হাতে করে চলেছিলেন।

সুদীর্ঘকাল এই তিন কাজ সামলাতে সামলাতে ব্রহ্মা কোন অবসরই আর পাচ্ছিলেন না। এমনকি সামান্য সময়ের জন্যও তপস্যায় মগ্ন হওয়ার সুযোগটুকুও পাচ্ছিলেন না। অথচ তপ ব্যতীত দিনে দিনে তিনি ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়ছিলেন। এইভাবে কয়েক সহস্র বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন যুদ্ধের অবসান হল না, তখন তিনি আর পারলেন না। মন বিদ্রোহ করে উঠতে চাইল, অথচ হঠাৎ করে বুঝে উঠতেও পারলেন না যে, এই মুহূর্তে কী করবেন!

ভারি চিন্তায় কাল কাটাতে কাটাতে একটা উপায় অবশ্য তাঁর মাথায় এল। সেই উপায় অবলম্বন করতে পারলে খানিকটা ভার অবশ্যই তাতে লাঘব হবে। নিত্য কিছুটা সময় তিনি নিশ্চিন্তে তপস্যায় ব্যয় করতে পারবেন। কী সেই উপায়?

আসলে, শর্ত মোতাবেক বিষ্ণু ও মহাদেবের দায়িত্ব তাঁকে পালন করতেই হবে। কিন্তু তাঁর নিজের দায়িত্ব তো তিনি আদি দশজন প্রজাপতি মানসপুত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেই পারেন! তিনি নিজে তো অনেক জীব সৃষ্টি করলেন, এবার তাঁরাই না-হয় জীববৃদ্ধি করুন। আর মানসপুত্র বা মানসকন্যা নয়; এবার স্ত্রী-পুরুষের মিলনেই না-হয় প্রসার ঘটুক সৃষ্টি!

ভাবনাটি যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত মনে হতেই ব্রহ্মা তক্ষুনি তাঁর প্রজাপতি দশ পুত্রকে আহ্বান করলেন। তারপর আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন তাঁদের কাছে। কঠিন তপস্যার মধ্য দিয়ে দেবী আদ্যাশক্তির আরাধনা করতে বললেন। বললেন, দেবীকে তুষ্ট করে সৃষ্টিকর্মে নিরত হতে। পুত্রদের এইভাবে উপদেশ ও আদেশ দিয়েই ব্রহ্মা নিজে তপস্যায় লীন হলেন।

অপরাপর প্রজাপতিরা পিতার আদেশ মাথা পেতে নিয়ে নিজ নিজ সাধনক্ষেত্রে গিয়ে সাধনা শুরু করলেন; কিন্তু দক্ষের কোন সাধনক্ষেত্র ছিল না।

তাই প্রজাপতি দক্ষ গেলেন এক নির্জন অরণ্যে। অনন্ত নির্জনতার মাঝে লীন হলেন তপস্যায়। ঋতুচক্রের বর্ষা-শীত-গ্রীষ্ম দারুণ প্রাবল্য নিয়ে তাঁর তপের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইল। কিন্তু দক্ষের কৃচ্ছ্রসাধনার কাছে তারা ব্যর্থ হল। সহস্র বছরের প্রচেষ্টাময় পরিক্রমণেও তারা দক্ষের সাধনার সম্মুখে সফল হতে পারল না।

প্রকৃতিকে এইভাবে স্ববশ করে অবশেষে ক্ষুধা-তৃষ্ণার মতো শারীরিক চাহিদাকেও দক্ষ জয় করে ফেললেন। তখন তাঁর অঙ্গ থেকে নির্গত হতে লাগল এক দিব্য জ্যোতি। শরীর হয়ে উঠল ক্ষীণকায় কিন্তু ত্যাগ-তিতিক্ষায় সমুজ্জ্বল।

দক্ষ সাধনার এই স্তরে উন্নীত হতেই দেবী আদ্যাশক্তি প্রসন্ন হলেন। উৎসুক হলেন তাঁকে কৃপা করতে। দক্ষের সম্মুখে পাশ, অঙ্কুশ, বর ও বরাভয় নিয়ে আলোকপুঞ্জের মাঝে আবির্ভূতা হলেন চতুর্ভুজা দেবী আদ্যাশক্তি। দেবীর সর্বাঙ্গে অপরূপ সৌম্য বিভা। ত্রিনয়নে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের প্রজ্ঞা। মুখে স্মিত হাসি।

দেবী বললেন, হে বৎস দক্ষ, তোমার সাধনায় আমি তুষ্ট হয়েছি। এখন বল কী তোমার অভিপ্রায়? কী তোমার অভিলাষ?

দীর্ঘ তপস্যাক্লিষ্ট দক্ষ দেবীর আহ্বানে চোখ খুলেই সম্মুখে দীপ্তিময়ী করুণাময়ী দেবীকে দেখে ধন্য হয়ে গেলেন। সমস্ত সৃষ্টির কার্যকারণকে সম্মুখে অপূর্ব মূর্তিতে অবলোকন করে আবেগে আপ্লুত হলেন। তাঁর দু’নয়নে ঝরতে লাগল আনন্দের অশ্রুধারা। দেবীর চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন।

তারপর গদগদ স্বরে বললেন, হে দেবীমাতা, তুমি তো সর্বজ্ঞা, তুমি তো সকলই জানো। পিতা ব্রহ্মা আদেশ দিয়েছেন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অপত্য জন্মদানের মাধ্যমে সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। পিতার আদেশ শিরোধার্য। তবে হে দেবী, আমার একান্ত অভিলাষ, তুমি আমার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করো। যিনি সমস্ত সৃষ্টির আধার, তাঁকে জন্মদানের মধ্য দিয়েই হোক আমার সৃষ্টিকাজের সূচনা…

দক্ষের এরূপ উদার ও নিবেদিত ভাবনায় দেবী অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। বললেন, হে প্রিয় দক্ষ, তোমার এ অভিলাষ অবশ্যই পূর্ণ হবে। কেননা, তাতে সৃষ্টির বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত আছে। সময়ান্তরে সেই উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে। হে দক্ষ, যাও, বনভূমি ছেড়ে বীরণের কন্যা অশেষ পুণ্যবতী অসিক্লীকে বিবাহ কর। আমি তার গর্ভেই কন্যারূপে জন্ম নেব। তুমি আমার নাম রেখো ‘সতী’। তবে একটা কথা মনে রেখো, তোমার ঘরে আমার যদি কোনদিন অবহেলা হয়, আমার প্রতি যদি কোনদিন তুমি অন্যায় করো, আমায় যদি তুমি অপমান করো; তাহলে আমি সেই মুহূর্তেই দেহত্যাগ করব। আর আমার মৃত্যুর প্রতিফল ভোগ করতে হবে তোমাকেই! মনে রেখো!

দেবী কথা শেষ করেই অন্তর্হিত হলেন। দক্ষ করজোড়ে বসে রইলেন—বসেই রইলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। দেবী তাঁর কন্যা হয়ে আসবেন, অভিলাষ পূর্ণ করবেন—এ তো তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতি। কিন্তু শেষ কথায় এ কী বলে গেলেন দেবী! তাতে দুর্বিষহ ভবিতব্যের কি কোন ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন! কে জানে! আনন্দের মাঝেও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন দক্ষ; অন্তর থেকে বেরিয়ে এল এক স্বগত দীর্ঘশ্বাস…

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]

কাহিনিসূত্রঃ

দেবী ভাগবত পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...