আগের পর্বেই আপনারা দেখেছেন যে, ভগবান বিষ্ণু দেবী আদ্যাশক্তির কৃপায় দুই করাল অসুর মধু ও কৈটভকে বধ করেছেন। দেখেছেন যে, দেবীই মধু ও কৈটভকে সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে লীলাময় করে তুলতে; সৃষ্টির দুই প্রতিভূ ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে নাটকীয়ভাবে মিলিয়ে দিয়ে সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করতে।
তাই মধু ও কৈটভকে বধ করার পর ব্রহ্মা ও বিষ্ণু যুগলে দেবীকে আবাহন করলেন। তাঁদের প্রার্থনায় প্রীত দেবী প্রসন্নবদনে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হলেন।
তারপর ব্রহ্মা ও বিষ্ণু করজোড়ে তাঁকে বন্দনা করতেই তিনি বললেন, হে ব্রহ্মা, তুমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে যে, কীভাবে সৃষ্টি কর্ম করবে, কীসের আদলে করবে, কীভাবে তাদের রক্ষা করবে? দেখো ব্রহ্মদেব, আমি যে মধু-কৈটভকে সৃজন করেছিলাম, তারা ছিল অশুভশক্তি। শুভশক্তি বিষ্ণু তাদের বধ করে তোমাকে রক্ষা করেছেন। আমার এই লীলায় তোমরা দেখলে যে, শুভ ও অশুভের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি রক্ষিত হয়। এ হচ্ছে সৃষ্টির খেলা, নিরন্তর চলতেই থাকবে। তুমি সৃজন করবে, বিষ্ণু তাদের অভয় দিয়ে পালন করবেন। আর ঐ দেখ, কৈলাস শিখরে ধ্যানে মগ্ন মহেশ্বর-মহাদেব, উনি কল্পান্তে নতুন সৃষ্টির উন্মেষ ঘটাতে সমস্ত লয় করবেন। কত সহস্র কল্প ধরে তাই-ই হয়ে এসেছে। যুগে যুগেই তোমরা ভক্তের জিহ্বায় উচ্চারিত হয়েছ ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’ নামে একত্রে, স্রষ্টার অখণ্ড প্রতিমূর্তিরূপে।
দেবীর অনুগ্রহে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর দূরদৃষ্টি উন্মোচিত হল। তাঁরা দেখলেন, কৈলাস শিখরে কৃচ্ছ্রপথের সেই আদি দেবতা মহাদেবকে। তাঁর শরীরে রুদ্রের দ্যুতি, ত্যাগের গরিমা, প্রলয়কালের ঊর্মি। তাঁরা দু’জনেই সেই দেবতার উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রণিপাত করলেন। ধ্যানমগ্ন হয়েও মহাদেব সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা; তাই এই দুই দেবতার প্রণাম গ্রহণ করে তিনি স্মিত হাস্যে অভয় মুদ্রা প্রদর্শন করলেন।
ত্রয়ী দেবতার এইভাবে মিলন ঘটিয়ে, নিজ নিজ কর্তব্যকর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়ে দেবী বিষ্ণুকে বিশ্রামের জন্য বিদায় জানালেন। তারপর ব্রহ্মাকে বললেন, হে ব্রহ্মা, এবার তুমি আমায় অনুসরণ করো। যা দেখে, যাঁদের দেখে তুমি সুসন্তানের জন্ম দিতে পারো—এসো তোমায় সেই শুভশক্তিময় শুভলোকের দর্শন করাই, এসো!
এই বলে দেবী আদ্যাশক্তি শূন্যে পাড়ি দিলেন। ব্রহ্মা তাঁকে অনুসরণ করলেন। জল ও মৃত্তিকাময় নবগঠিত মেদিনী ত্যাগ করে তাঁরা উপস্থিত হলেন মনোরম মনোহর স্বর্গলোকে। সেখানকার সুরম্য উদ্যান, নিশ্চিন্ত ও জরাহীন প্রাণচঞ্চলতা, দেবদেবীদের অপরূপ রূপ-লাবণ্যে শুভালোকের ছটা দেখে ব্রহ্মা মোহিত হলেন।
দেবী একে একে শিবলোক, ইন্দ্রলোক, বৈকুণ্ঠলোক প্রভৃতি লোকসকল দর্শন করিয়ে ব্রহ্মার জন্য ব্রহ্মলোক নির্দিষ্ট করে তাঁকে সেখানে অধিষ্ঠিত করলেন। তারপর আশু সৃষ্টির আদেশ দিয়ে দেবী অন্তর্হিত হলেন।
দেবীর আদেশ পেয়ে ব্রহ্মা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে পদ্মাসনে আসীন হলেন। নিরন্তর প্রজাসৃষ্টির জন্য অনুগত অপত্য ‘প্রজাপতি’বর্গের সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করলেন। একে একে সৃষ্ট হলেন দশজন পুত্র—মরীচি, অত্রি, অদিরস, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, বশিষ্ঠ, ভৃগু, দক্ষ ও নারদ। পরে ব্রহ্মা অসংখ্য প্রজাপতি সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু এঁরাই প্রথম। এঁরা ব্রহ্মার মন থেকে সৃষ্টি হলেন বলে এঁদের বলা হতে লাগল, ‘ব্রহ্মার মানসপুত্র’।
দশজন পুত্রই বেদজ্ঞ, নীতিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, যজন-যাজনে ঋষি, স্বভাবে সৌম্য। বিশিষ্ট এই পুত্রদের জন্ম দিয়ে ব্রহ্মার বেশ আহ্লাদ হল। আহ্লাদ থেকে এল অহং। অহং থেকে মনে ঘনাল মোহের গহীন অন্ধকার।
মোহবেষ্টিত ব্রহ্মা তখন সৃষ্টিরঙ্গে মগ্ন। তিনি বুঝতেই পারলেন না তাঁর মনের বিকার। তাই তমসাচ্ছন্ন মন নিয়েই বসলেন ফের পুত্র সৃজনে। এবার তাঁর মন থেকে জন্ম নিল ঘোর তমসার মতো কুটিল, ভয়াল অসুরের দল।
তাদের মধ্যে ভয়ংকরতম যে অসুরটির জন্ম হল, তার নাম, ‘হলাহল’। হলাহল জন্ম নিয়েই পিতার চরণে প্রণিপাত করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে বর অর্জন করতে বসে পড়ল ঘোর তপস্যায়। দাবদাহ, উল্কাপাত, বজ্রপাত, প্রবল হিমানিপাত, তুষারপাত—কোনকিছুই তাকে তপস্যার পথ থেকে দূরে সরাতে পারল না। ত্যাগ-তিতিক্ষার সমন্বয়ে চালিয়ে গেল কঠিন অথচ দীর্ঘ তপস্যা।
মোহ-তমসায় একে ব্রহ্মার মতিচ্ছন্ন হয়েছে, তার ওপর ঘোর তপস্যা। ব্রহ্মা নিজেকে আর উদাসীন রাখতে পারলেন না। বরাভয় নিয়ে আবির্ভূত হলেন হলাহলের সম্মুখে। বললেন, বৎস, বল কী তোমার অভিলাষ! তোমার সমস্ত বাসনা আমি পূর্ণ করব।
ধ্যাননিরস্ত হলাহল ব্রহ্মার এই ব্যাগ্রতা দেখে অত্যন্ত আপ্লুত হল। সে তক্ষুনি ব্রহ্মার পদবন্দনা করে বলল, হে পিতা, আপনি আমায় এই বর দিন যে, আমি অসুরকুলের অধিপতি হয়ে ত্রিলোক জয় করে যেন একেশ্বর হতে পারি। দেব-মানব-দানব সকলের কাছে অপরাজেয় থেকে স্বেচ্ছায় তনুত্যাগ করতে পারি।
ব্যাপারটা তলিয়ে দেখার অবকাশ হল না। মোহের বসে ব্রহ্মা তৎক্ষণাৎ স্মিত হেসে ‘তথাস্তু’ বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ব্রহ্মা অদৃশ্য হতেই অট্টহাস্যে ত্রিলোক কাঁপিয়ে বিকট এক রণহুঙ্কার ছাড়ল হলাহল। সেই বীভৎস হুঙ্কারে ত্রিলোক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল, ইন্দ্রের আসন টলে গেল, মেদিনী প্রকম্পিত হল, বারিমণ্ডলে জলোচ্ছ্বাস শুরু হল, সহস্র সহস্র অসুরেরা উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে ছুটতে ছুটতে তার অধীনে এসে শরণ নিল। সকলে সমবেত হতেই হলাহল আবার হুঙ্কার ছেড়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে স্বর্গপানে ঝঞ্ঝার বেগে ধাওয়া করল।
অতর্কিত এই আক্রমণে দেবরাজ ইন্দ্র হতচকিত হয়ে গেলেন। ব্রহ্মার বরে বলীয়ান বলাহলের সঙ্গে স্বর্গরক্ষার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েও পেরে উঠলেন না। দেবতারা সকলে ভীষণ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে স্বর্গ ত্যাগ করে কেউ কেউ গোপন গুহায় গিয়ে আত্মগোপন করলেন। কেউ বা দেবরাজের সঙ্গে গেলেন ত্রিদেবের শরণ নিতে।
ইন্দ্রাদি দেবতারা শরণ চাইতে প্রথমে ব্রহ্মার কাছে হাজির হলেন। তাঁরা ব্রহ্মাকে প্রণিপাত করে হলাহলকে বরদান ইত্যাদি কৃতকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই ধীরে ধীরে ব্রহ্মার মন থেকে অহং আচ্ছাদিত তমসা কেটে গেল। সরে গেল মোহের আবরণ।
তিনি তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় হতাশায় খানিক ম্লান হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, হে দেবগণ, কৃতকর্মের জন্য আমার গ্লানির শেষ নেই। কিন্তু হলাহল আমারই মানসপুত্র। রণরঙ্গে পুত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে প্রতিবিধান আমি করতে পারব না। এসো, আমরা বরং পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণু ও লয়কর্তা মহাদেবকে আবাহন করি, তাঁরা নিশ্চয়ই এর প্রতিবিধান করবেন…
দেবতারা সমবেতভাবে স্তবগানে ভগবান বিষ্ণু ও মহাদেবকে আবাহন করলেন। তাঁদের কাতর প্রার্থনায় দুই দেবতা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তাঁরা আবির্ভূত হলেন ব্রহ্মলোকে। দেবতারা তাঁদের যথাবিহিত বন্দনা ও প্রণিপাত করে নিজেদের দুরবস্থার কথা নিবেদন করলেন। জানালেন স্বর্গের অধিকার পুনরায় ফিরে পাওয়ার বাসনা।
বিষ্ণু-মহেশ্বর দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন, অপরাজেয় হলাহল শুধু স্বর্গই অধিকার করেনি, মর্ত ও পাতাল অধিকার করে একই সঙ্গে ত্রিলোকে হিংসা আর অধর্মের প্রসার শুরু করে দিয়েছে। তার অত্যাচারে মর্তের মুনি-ঋষি-সজ্জনেরা ‘ত্রাহি, ত্রাহি’ রব তুলে ত্রিদেবের বেদিমূলে মাথা কুটছে; পাতালে যক্ষ ও নাগেরাও অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিকার চেয়ে ত্রিদেবের স্মরণ নিয়েছে; স্বর্গের গন্ধর্ব ও অপ্সরাদের দল হলাহলের আসুরিক মত্ততায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ত্রিদেবকে স্মরণ করে উদ্ধার পেতে চাইছে।
ত্রিলোকের এই হাহাকারে ভগবান বিষ্ণু ও মহাদেব অত্যন্ত বিচলিত হলেন। শরণাগতকে তাঁরা কখনই ফিরিয়ে দেন না। জীবধর্মের অবিরাম প্রবাহ বজায় রাখাই তাঁদের ব্রত। তাই বিষ্ণু ও মহাদেব ব্রহ্মাদি দেবতা ও স্বর্গ-মর্ত-পাতালের নিপীড়িতদের উদ্ধারের জন্য যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত হলেন। ব্রহ্মা যেহেতু হলাহলকে ইচ্ছামৃত্যুর সুযোগ দিয়ে দেব-মানব-দানবের সঙ্গে সংগ্রামে অপরাজিত থাকার বর দিয়েছেন; তাই তাকে বধ করা বিষ্ণু বা মহাদেব কারও পক্ষেই সহজ নয়। সেজন্যই তাঁদের একটি শর্ত ব্রহ্মাকে পালন করতে হবে…
ব্রহ্মা আপন কৃতকর্মের জন্য আগেই যার পর নাই লজ্জিত ছিলেন। এবার বিষ্ণু ও মহাদেবের মুখে শর্তের কথা শুনে খানিক ভীত হলেন। ভয়ার্ত দুই চোখ তুলে তাকালেন তাঁদের দিকে; শঙ্কিত মন বলল, শর্ত!...
[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]
কাহিনিসূত্রঃ
দেবী ভাগবত পুরাণ
কালিকা পুরাণ