একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ৩

অনন্তের ফনার ওপর ভীষণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন ভগবান বিষ্ণু। তাঁরই কানের ময়লা হতে উদ্ভূত দুই দৈত্য মধু ও কৈটভের সঙ্গে। চলছে বাহু যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ মধু ও কৈটভ। একজন শ্রান্ত হলে অপরজন এসে লিপ্ত হচ্ছে যুদ্ধে। তাই বিষ্ণু বিশ্রামের কোন অবসরই পাচ্ছেন না। তবু অবিরত অবিচ্ছিন্নভাবে চলছে দুরন্ত এই সংগ্রাম।

হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন এই সংগ্রাম নিষ্পত্তি হল না, তখন অনন্তের কাছে ফনার ওপর দুই পক্ষের এই যুদ্ধজনিত পীড়ন অসহ্য হয়ে উঠল। তিনি বার বার প্রভু বিষ্ণুর কাছে কাতর প্রার্থনা জানালেন বিরাম চেয়ে বিশ্রাম চেয়ে। কিন্তু যুদ্ধমত্ত বিষ্ণু তাঁর আবেদন শুনতেই পেলেন না। তখন অনন্তের অবস্থা ভারি শোচনীয় হয়ে উঠল।

তবু নিরুপায় অনন্ত সৃষ্টির কথা ভেবে ক্ষণে ক্ষণে সমস্তই সহ্য করতে লাগলেন। এবং এভাবেই অবিরাম অবিশ্রান্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হল।

এতদিন পরে বিষ্ণু একদিন দারুণ শ্রান্ত হলেন। এই শ্রান্তির সংবাদ বিলক্ষণ টের পেল দুই বিপক্ষ অসুর। তারা হেসে বলল, ওহে বিষ্ণু, তুমি তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আমাদের পরাক্রমের বিরুদ্ধে কেন মিথ্যে কাল নষ্ট করছ! পরাজয় স্বীকার কর। হয় আমাদের দাস হও, নয় আমাদের বধ্য হও! তোমাকে বধ করে ঐ বৃদ্ধ দেবতাকে বধ করব!—এই বলে তারা সম্মুখে দণ্ডায়মান ব্রহ্মাকে নির্দেশ করল।

তাই শুনে ভীত ব্রহ্মা আরও ভীত হলেন। কিন্তু বিষ্ণু মৃদু হাসলেন। বললেন, ওহে মধুকৈটভ, তোমরা ঠিকই বুঝেছ, আমি সত্যিই ক্লান্ত। দেখো, তোমরা দু’জনে আমার সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করছ, অথচ আমি একা। তোমাদের একজন যখন যুদ্ধ করছ, অপরজন তখন বিশ্রাম নিতে পারছ। কিন্তু আমি অবিরাম পাঁচ হাজার বছর ধরে কেবল যুদ্ধই করে যাচ্ছি। কাজেই আমি তো শ্রান্ত হবই। তোমরা আমার মতো ক্লান্ত-শ্রান্তকে বধ করতে চাইছ বটে, যুদ্ধনীতি কিন্তু তা বলে না। রণক্লান্ত, ভীত, অস্ত্রহীন, পতিত ও বালকের ওপর বীরেরা কখনও প্রহার করে না। তোমরা তো বীর। তাই তোমাদের বলছি যে, একটু অপেক্ষা করো, আমি ক্ষণকাল বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে আসব। তখন আবার যুদ্ধ হবে, তারপরই না-হয় জয়-পরাজয় স্থির হবে।

বিষ্ণুর কথা মধুকৈটভের বেশ যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হল। তাছাড়া তারা তো যথার্থই বীর। কাজেই তারা বিষ্ণুকে বিশ্রামের জন্য বিদায় দিল।

বিষ্ণু অনন্তের কোলে ফিরলেন বিশ্রাম নিতে। বিশ্রাম করতে করতে ভাবলেন যে, এই দুই অসুর কোথা থেকে এল? কোথা থেকে এমন বল-বীর্য অর্জন করল? কীভাবেই বা এদের পরাস্ত করা যাবে?

ভাবতে ভাবতেই বিষ্ণু ধ্যানমগ্ন হলেন। ধ্যানে দেখতে পেলেন, দেবী ভগবতী আদ্যাশক্তির ইচ্ছেতেই পুরাতন সৃষ্টি ধ্বংস হচ্ছে, চতুর্দিক প্রলয়জলে মগ্ন হচ্ছে, জলের ওপর অনন্তশয্যায় তিনি চেতনাহীন যোগনিদ্রায় নিমগ্ন হচ্ছেন, কীভাবে দেবী প্রলয় জলের মাঝে নতুন সৃষ্টির জন্য উদ্বেলিত হচ্ছেন, কীভাবে ব্রহ্মার উদ্ভব হল, লীলাময়ী দেবী কীভাবে তাঁরই কর্ণমল থেকে অসুর দুটিকে জন্ম দিলেন। আর দেখলেন, কীভাবে দেবী দুই অসুরকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন।

সেই অভূতপূর্ব ইতিহাস দর্শন করার পর বিস্ময় বিমুগ্ধ বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ হল। তিনি অনুধাবন করলেন, এতদিন যা হয়েছে, যা ঘটেছে, সমস্তই দেবীর লীলা। এও বুঝলেন, সেই লীলা দেবী কীভাবে সমাপন করবেন, তা একমাত্র দেবীরই হাতে। অমনি দেবীর সেই লীলাসমাপ্তির দিশা পেতেই তিনি করজোড়ে স্তব সহকারে দেবীকে আবাহন করতে শুরু করলেন।

স্তবতুষ্টা দেবী মধুরামূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে বিষ্ণুকে বললেন, বৎস, তুমি যথার্থই উপলব্ধি করেছ যে, যা ঘটছে সমস্ত আমারই লীলা। লীলার সমাপ্তিতেই হবে জগতসৃষ্টির সূচনা। মধুকৈটভকে আমি সৃষ্টি করেছি, তাদের মোহিত করে আমিই হব মৃত্যুর কারণ। তোমার শরীর থেকে সৃষ্টি করেছি, তাই তোমার হাতেই হবে তাদের মৃত্যু। এর কোন অন্যথা নেই। যাও রণরঙ্গে ফিরে যাও, অস্ত্র আর ছলনাকে আশ্রয় কর।

দেবী অদৃশ্য হলেন। জোড় কর সংবৃত করে ফের বিষ্ণু হাজির হলেন অনন্তের ফনায়। যুদ্ধক্ষেত্রে। তাঁকে দেখে অপেক্ষারত মধুকৈটভ দারুণ উল্লসিত হয়ে রণে অগ্রসর হল।

শুরু হল মুষ্টিযুদ্ধ। চলল সমানে সমানে প্রহার। জমে উঠল ধুন্ধুমার লড়াই। তখন সমস্ত শূন্যব্যেপে আবির্ভূতা হলেন দেবী। সে যেন এক অন্য মনোহারী রূপ। রুদ্র অথচ মায়াবী। আগুনের মতো তাঁর মুখমণ্ডল, স্ফুলিঙ্গের মতো তাঁর কেশমালা। দু’চোখে মোহিনীর মায়া। সেই মায়ালু চোখের কটাক্ষ ছুঁড়লেন দুই অসুরের দিকে।

ব্যস, দুই অসুরের অমনি যুদ্ধ উন্মত্ততা স্তিমিত হল। তারা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল ঐ অগ্নিবর্ণা মোহিনীরূপের দিকে। দেবীর কটাক্ষে তারা বিহ্বল হল।

তাই দেখে স্মিত হাস্যে বিষ্ণুর মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হল। তিনি মৃদু অথচ মধুর স্বরে বললেন, হে মধুকৈটভ, তোমরা সত্যিই বীরশ্রেষ্ঠ। আমি যুগে যুগে অসংখ্য অসুরের সঙ্গে সংগ্রামে রত হয়েছি, কিন্তু তোমাদের মতো বীর কখনো দেখিনি। তোমাদের বীরত্বে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তাই চাইছি তোমাদের বর দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করতে। বল কী বর চাও?

দেবীর মায়ায় বিষ্ণুর কথা দুই অসুরের অহং-এ লাগল। তারা দারুণ অট্টহাসি হেসে বলল, তুমি আমাদের বর দেবে? এখনও বোঝনি শক্তি দিয়ে চরাচরের সমস্তই আমরা বশ করতে পারি? সমস্তই অর্জন করতে পারি? ওহে বিষ্ণু, তুমি তো সেই অনন্ত চরাচরের তুচ্ছ একজন। তোমার কাছে আমরা কেন বর চাইব! তোমার কী ক্ষমতা আমাদের সমৃদ্ধ করার! তুমি বরং আমাদের কাছে প্রার্থনা করো, আমরা তোমাকে সমৃদ্ধ করব! বল কী চাও?

বিষ্ণু আগের মতো স্মিত মুখেই অবস্থান করছিলেন। আগের মতোই মধুর স্বরে বললেন, বেশ। তাহলে এই বর দাও যে, তোমরা এক্ষুনি আমার হাতে মৃত্যুবরণ করবে!

কথাটা শুনেই এক লহমায় দুই অসুরের সমস্ত মোহ যেন কেটে গেল। সচকিত হয়ে দেখল, শূন্যে আর সেই অগ্নিবর্ণা মোহিনী নেই। হঠাৎ যেন বিহ্বলতা কেটে গিয়ে বোধদয় হল, এ কী অঙ্গীকার করে বসলাম! এখন তো বরদানের অঙ্গীকার থেকে ফেরার পথ নেই। তাহলে বাঁচার উপায়!?

উপায় ঠাউরাতে কয়েক মুহূর্ত লাগল মধুকৈটভের। দেখল, চারিদিকে জল শুধু জল। সেই জলই তাদের দিশা দেখাল। ঐ তো তাঁদের বাঁচার উপায়, বরদানের ফাঁকি! তারা অসম্ভব খুশি হয়ে বলল, বেশ তো। তোমার হাতেই না-হয় আমরা মরব। কিন্তু অনন্তনাগের এই ফনা, ক্রোড় আর ঐ অসীম-অনন্ত জল ব্যতীত যদি কোন শুষ্ক স্থানে তুমি আমাদের হত্যা করতে পার, তাহলে কর!

তাদের কথা শেষ হতেই বিষ্ণু আগের মতোই স্মিত হেসে বললেন, বেশ।

তারপরই তাঁর ঊরু দুটিকে জলের ওপর শূন্যে প্রলম্বিত করতে শুরু করলেন। দিগন্ত প্রসারিত সেই ঊরুদ্বয়কে দেখিয়ে বললেন, এই দেখো মধুকৈটভ, এখানে জল নেই, শুষ্ক; এ-অনন্তের ফনা বা ক্রোড়ও নয়, এস এর ওপর তোমাদের মস্তক স্থাপন কর, আমি হত্যা করি!

এই আহ্বান শুনে মধুকৈটভ একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। প্রাণরক্ষা বিষয়ে দারুণ সন্দিহান হয়ে বেশ ভয় পেয়ে গেল। এবং নিজেদের কলেবর আসুরিক মায়াবলে দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর করতে শুরু করল। বিষ্ণু তাদের কলেবরের অনুপাতে নিজের দুই ঊরুও আয়তনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে ফেললেন। বললেন, ওহে বীর মধুকৈটভ, আর ছলনা কেন, সত্য রক্ষা কর। বীর হয়ে বীরের ধর্ম পালন কর। নিষ্ফল মোহ ত্যাগ কর। যে বর দান করেছ, তাকে সার্থক কর!

মধুকৈটভ বুঝল আর নিস্তার নেই। তারা সত্যিই বীর। তাই বীরের ধর্ম পালনই তাদের শেষ ধর্ম মেনে নিয়ে বিষ্ণুর ঊরুতে আপন আপন মস্তক স্থাপন করল। তখন বিষ্ণু আবাহন করলেন তাঁর ঐশ্বর্যশালী আয়ুধ সুদর্শনকে।

আহ্বান পেতেই অমনি ঘূর্ণিত সুদর্শন সেই মুহূর্তে সবেগে ধেয়ে এসে দুই অসুরের মস্তক খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলল। চরাচরে ধ্বনিত হল মধুকৈটভের মৃত্যুকালীন প্রবল আর্তচিৎকার। দুই অসুরের দেহ থেকে প্রবল স্রোতে বেরিয়ে আসতে লাগল রক্ত ও মেদ সকল। জলের ওপর মেদ ঘনীভূত হয়ে মাটির রূপ নিল। সৃষ্টি হল পৃথিবীর। ‘মেদ’ থেকে সৃজিত হল বলে, পৃথিবীর আর এক নাম হল, ‘মেদিনী’।

এভাবেই দেবী আদ্যাশক্তির লীলার মধ্য দিয়ে সূচনা হল সৃষ্টির প্রথম অধ্যায়ের। দেবীর কৃপায় মধুকৈটভকে হত্যা করে বিষ্ণু ও অনন্ত কালান্তক যুদ্ধ হতে নিষ্কৃতি পেলেন এবং ব্রহ্মাও ঐ দুই অসুরের কোপ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যার পর নাই কৃতার্থ হলেন। সকলে সমস্বরে শুরু করলেন দেবীর স্তব ও আবাহন।

কৃতার্থ দেবতাদের আবাহনে দেবী তুষ্ট হয়ে আবির্ভূত হলেন তাঁদের সম্মুখে। তিনি আবির্ভূতা হলেন তাঁদের কৃপা করতে সমস্ত সৃষ্টিকে কৃপা করতে…

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]

কাহিনিসূত্রঃ

দেবী ভাগবত পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...