একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ১

কোথাও কোন শব্দ নেই। চারিদিকে বিরাজ করছে ভয়ানক এক নৈঃশব্দ্য। ধূ ধূ করছে অন্ধকার। কোথাও কোন দিগন্ত নেই। যেদিকেই তাকানো যাচ্ছে, সেদিকেই সীমাহীন নিস্তরঙ্গ জলরাশি।

সেই জলের ওপর বিশাল কুণ্ডলী পাকিয়ে ফনা তুলে ভেসে রয়েছে যে সুবৃহৎ সর্পটি; সে, 'অনন্ত'। তার কুণ্ডলীতে শয্যা পেতে পরম প্রশান্তিতে শুয়ে আছেন কেবল এক রমণীয় সুপুরুষ। তিনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন।এই নিদ্রা, যোগনিদ্রা। কেননা, তাঁর শরীরের কোথাও কোন স্পন্দন নেই।

নিদ্রিত এই পুরুষ স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। সৃষ্টির খেলা সাঙ্গ হলে তিনি নিদ্রা যান। আবার নতুন সৃষ্টির সূচনায় জেগে উঠে সৃষ্টি কর্মে অংশ নেন। এই যে সময়, এই যে কাল এই মুহূর্তে প্রবাহিত হচ্ছে, তা হচ্ছে নতুন এক কল্প। মহাপ্রলয়ের পর নতুন এক যুগের সূচনাকাল। এ-যুগের সৃজন এখনও শুরু হয়নি। তাই চারিদিকে এত অন্ধকার, তাই এমন নৈঃশব্দ্য।

হঠাৎ এই চরম নিদ্রাতুর নৈঃশব্দ্যকে খান খান করে ফেলল বিকট অথচ মধুর এক নাদ। 'ওঁ'-কার। এই নাদ নির্গত হল ভীষণ জলদগম্ভীর এক অদৃশ্য পুরুষকণ্ঠ হতে। দশদিকে গম গম করে ধ্বনিত হল। তার স্বনন-ঝংকারে কেঁপে উঠল সমস্ত চরাচর। শনশন করে বইতে শুরু করল বাতাস। স্তব্ধ বারিমালায় শুরু হল প্রবল আন্দোলন। দুলে উঠল শান্ত শয্যা।

অশান্ত এই আবহে বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ হল। তবু তিনি চোখ খুললেন না। তাঁর ঠোঁটে ফুটে উঠল রহস্যময় স্মিত হাসি। নাভি থেকে নির্গত হল কুঁড়িসহ পদ্মের মৃণাল। ক্রমশ মৃণালটি বড় হতে হতে বিশাল আকার ধারণ করল। তারপর অসামান্য মোহময় আলো ছড়াতে ছড়াতে কুঁড়িটি তার সাদা পাপড়িগুলো দুরন্ত ছন্দে দ্রুততার সঙ্গে মেলতে শুরু করল। 

মুহূর্তেই সমস্ত পাঁপড়ি ছড়িয়ে প্রস্ফুটিত হল সুবিশাল এক শ্বেত পদ্ম। অমনি সেই পদ্মের ঠিক মধ্যিখানে কোরকের বিছানায় শান্ত সৌম্য বৃদ্ধ এক ঋষিকে দেখা গেল। শাদা দাড়ি শাদা চুল-শোভিত শ্বেত বস্ত্রে অলঙ্কৃত এই ঋষিও যেন নিদ্রিত।

 

Shakti-Peeths1

 

মুহূর্তেকের মধ্যেই নৈঃশব্দ্য খান খান করে পূর্বের পুরুষ কণ্ঠে ধ্বনিত হল সেই সহস্র বজ্রসদৃশ ওঁ-কার ধ্বনি। সেই ধ্বনিতে চরাচরের সঙ্গে কেঁপে উঠে চোখ মেললেন ঋষি। চরাচরে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। চারিদিকে নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা, অনাবিল নৈঃশব্দ্য! তার মধ্যে কে এমন জলদগম্ভীর নাদ করল! আর...আর এই যে আমি, এই আমিই বা কে! কোথা থেকে এলাম! কেনই বা এলাম!

মহাশূন্যে ভাসমান এক পদ্মের ওপর একাকী নিজেকে অবস্থান করতে দেখে ঋষি একেবারেই অবাক হয়ে গেলেন। ভাবলেন, এই যে পদ্ম, এ-ই বা এল কোথা থেকে! এমন ভাবনা মনে জাগতেই তিনি পদ্মের ওপর থেকে উঁকি দিয়ে নীচে তাকালেন। দেখলেন, সহস্র যোজন নীচে কেবল অবিরল জলরাশি। আবার অবাক হলেন। আচ্ছা, এই যে বিপুল জলরাশি, কোন আধারে তা আবদ্ধ হয়ে এমন প্রবাহবিহীন নিস্তরঙ্গ রয়েছে!

ঋষির মনে এভাবেই ক্রমান্বয়ে বিস্ময় থেকে জাগল কৌতূহল। কৌতূহল থেকে তৈরি হল জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসা ক্রমশ প্রবল থেকে প্রবলতর হতে শুরু করল। তখন ঋষি আর স্থির থাকতে পারলেন না। পদ্মের মৃণাল বেয়ে নেমে এলেন জলে। জলে ডুব দিয়ে শুরু করলেন অনুসন্ধান। কিন্তু, সহস্র বছর অনুসন্ধান করেও তিনি না-পেলেন পদ্মের সূচনা খুঁজে, না-পেলেন জলের আধার খুঁজে, না-পারলেন নিজের পরিচয় জানতে!

দীর্ঘ অনুসন্ধানে অবশেষে ঋষি ক্লান্ত হলেন। ক্লান্তির পথ বেয়ে হতাশ হলেন। তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল নিষ্ফল দীর্ঘশ্বাস। আর ঠিক তখনই ভেসে এল অদৃশ্য এক নারীকণ্ঠ, 'তপস্যা করো!'

ছোট্ট এই অনুজ্ঞা। আগে-পরে কিচ্ছু নেই। অনুজ্ঞা না-মানলে কী হবে, তার কোন পূর্বাভাস নেই। অনুজ্ঞা মানলে কী লাভ হবে, তারও কোন নির্দেশ নেই। অনুজ্ঞার বিরুদ্ধে 'কেন করব!' বলে প্রশ্ন তোলাই যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্রহ্মার মনে এতকিছু বিস্ফার এলই না। বিধির মতোই এ অনুজ্ঞা যেন লঙ্ঘন করার কোন উপায় নেই। তাই বাধ্য বালকের মতোই বৃদ্ধ ঋষি পদ্মে ফিরে তপস্যায় বসলেন।

তপস্যায় কেটে গেল কত কত কাল...

তারপর একদিন ঋষি চোখ খুললেন। তাঁর চোখ থেকে এবার বেরিয়ে আসতে লাগল জ্ঞানের বিভা। অন্তর থেকে বিকীর্ণ হতে লাগল জ্ঞানের জ্যোতি। ঠোঁটে ফুটে উঠল স্মিত হাসি। এতদিনের তপস্যায় অবশেষে তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন। বুঝেছেন নারীকণ্ঠের অনুজ্ঞার মানে। বুঝেছেন, তপস্যা ছাড়া জ্ঞানলাভ করা যায় না। অজ্ঞানের অন্ধকার দূর না-হলে নিজেকেও চেনা যায় না। জেনেছেন, তাঁর নাম, ব্রহ্মা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর--এই ত্রিদেবের মধ্যে কর্মে প্রথম, কিন্তু উদ্ভবে অন্তজন তিনি। জেনেছেন, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়--এই ত্রিকর্মের মধ্যে সৃজনের উদ্দেশ্যেই তাঁর উদ্ভব।

ব্রহ্মার এই আত্মোপলব্ধির মাঝেই আবার ধ্বনিত হল সেই অদৃশ্য নারীকণ্ঠ, 'সৃজন করো!' এই আজ্ঞা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন ব্রহ্মা। এতদিনে বুঝে গেছেন, এ-কণ্ঠ সর্বেশ্বরী এক দেবীর। যাঁকে সহজে দেখা যায় না, কিন্তু তাঁর ইচ্ছেতেই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের আবর্তন ঘটে চলে বার বার। তাই তাঁর আদেশের অন্যথা করার সামর্থ্য শুধু ব্রহ্মার কেন, কারও নেই। সেই দেবীর আদেশ পেয়েও, কী সৃজন করবেন, কীসের আদলে সৃজন করবেন--সহসা সে-সব কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না ব্রহ্মা। তাই হতবাক হয়ে দারুণ চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি।

কিন্তু হঠাৎ-ই ব্রহ্মার সেই দারুণ চিন্তার স্রোত মুহূর্তে খান খান হয়ে গেল নিদারুণ এক হুঙ্কারে। চমকে উঠলেন তিনি। ঝটিতে তাকিয়েই দেখতে পেলেন, শূন্যে ভাসতে ভাসতে তাঁর সম্মুখে হাজির হয়েছে দুই বিকটদর্শন দৈত্য। তাদের হাতে উদ্যত খড়্গ। চোখে দুরন্ত ক্রোধ। সম্মুখে প্রসারিত রক্তলোলুপ জ্বিহা। মুখে প্রাণঘাতী হুঙ্কার। তাদের সমবেত আক্রমণে সহসা দারুণ বিপন্ন হয়ে পড়লেন নিরীহ নিরস্ত্র নিরপরাধ বৃদ্ধ ব্রহ্মা...

[ধারাবাহিক এই কাহিনিতে সতীর জন্ম থেকে প্রতিটি সতীপীঠের ইতিহাস ও মাহাত্ম্যকথা পর্বে পর্বে আপনাদের সামনে আমরা তুলে ধরব। তাই আজ যে কাহিনিটির সূত্রপাত করলাম, এর পরবর্তী অংশ আপনারা পড়তে পারবেন আগামী পর্বে। প্লিজ, সঙ্গে থাকুন]।

কাহিনিসূত্র:

দেবীভাগবত পুরাণ

লিঙ্গ পুরাণ

শিব পুরাণ

মার্কণ্ডেয় পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...