জানেন কি, হিংলাজের দেবীকে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই মানুষই পুজো করেন?

'পীঠনির্ণয় তন্ত্র' গ্রন্থে প্রথম সতীপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে হিংলাজকে। কেননা, এখানে দেবীর দেহের প্রথম অংশ 'ব্রহ্মরন্ধ্র' পড়েছিল। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে দুর্গম মরুভূমির মাঝে নদী ও পর্বতবেষ্টিত স্থানে এই সতীতীর্থ অবস্থিত। লোকমুখে তাই এই তীর্থের নামই হয়েছে, 'মরুতীর্থ হিংলাজ'

হিংলাজের তীর্থযাত্রীরা যুগ যুগ ধরে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, উটে চেপে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্য দিয়ে দেবীদর্শন করে ধন্য হতেন। মরুপথে ছিল ভযানক দস্যুর ভয়। তারা যখন-তখন পথিককে আক্রমণ করে সর্বস্বান্ত করে যেত। তাই এই পথে যাত্রীরা দলবেঁধে যাত্রা করতেন। পথ দীর্ঘ। করাচি থেকে নব্বই মাইল। হেঁটে বা উটে চেপে যেতে সময় লাগত কয়েকদিন। মরুভূমিতে মরুঝড়ে বিভ্রান্ত হবার ভয়, পথ হারানোর ভয়; তাই পথ দেখানোর জন্য নির্দিষ্ট লোকও পেয়ে যেতেন তীর্থযাত্রীরা। পথ দেখানো এবং তীর্থ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাহাত্ম্যকথা বর্ণনাই তাঁদের পেশা, এখনকার গাইডের মতো। এঁরা এখনও আছেন। এঁদের বলা হয়, 'ছড়িদার'। এঁরা জাতিতে মুসলিম।

বর্তমানে অবশ্য আর হিংলাজ দুর্গম তীর্থ নয়। দশ-পনের বছর হল মরুভূমির বুক চিরে দুই লেনের হাইওয়ে তৈরি করে দিয়েছেন পাকিস্তান সরকার। করাচি থেকে একেবারে দেবীর মন্দির অব্দি প্রাইভেট, ভাড়ার গাড়ি অথবা বাসে চেপেই পৌঁছে যাওয়া যায়।

তীর্থ হিসেবে হিংলাজ হল একইসঙ্গে ভয়ঙ্কর ও সুন্দর। যাত্রাপথে মরুভূমির অসহ্য গরম ও শীতের তীব্রতা পার হয়ে এই তীর্থে পৌঁছনোর বেশকিছুটা আগেই রয়েছে দেবী শক্তির মন্দির। ভক্তেরা প্রথমে এখানে পুজো দিয়ে তারপর আসল শক্তিপীঠের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এই মন্দির থেকেই এখন 'ছড়িদার' পাওয়া যায়। মন্দির ছাড়িয়ে এগোলে মেলে 'চন্দ্রকূপ'

চন্দ্রকূপ হল একটি সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত গরম কাদার হ্রদ। আগে পাহাড়ে ভক্তরা ঢাল বেয়ে উঠতেন, এখন অবশ্য সাড়ে চারশোটি সিঁড়ির ধাপ তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ে ওঠার জন্য। পাহাড়টি আসলে একটি 'কর্দম আগ্নেয়গিরি'। আগ্নেয়গিরি যেভাবে গরম ও তরল ধাতবলাভা উদ্গীরণ করে, এই পাহাড়টি সেভাবেই কাদা উদ্গীরণ করে। আগ্নেয়গিরির মুখটি একটি হ্রদের মতো দেখতে হয়েছে। তাতে সবসময়ই বুদ্বুদ তুলে টগবগ করে কাদা ফুটছে। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় 'মাড ভলক্যানো'

যাই হোক, চন্দ্রকূপের পাড়ে দাঁড়িয়ে নারকেল উৎসর্গ করে আজীবনের সমস্ত পাপের কথা সকলের সামনে স্বীকার করে তবেই সতীপীঠে প্রবেশ করতে হয়। আদ্যিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত ভক্তজনেরা তাই-ই করে আসছেন। চন্দ্রকূপ থেকে নেমে পেরোতে হয় হিঙ্গুলা নদী। বর্ষার জলে পুষ্ট এই নদী বর্ষায় ভরে ওঠে, অন্য সময় তেমন জল থাকে না। এখন অবশ্য চিন্তা নেই, নদীর ওপর ব্রিজ হয়েছে।

হিঙ্গুলা নদী পেরোলেই হিংলাজ পর্বত। চার হাজার ফুট উঁচু এই পর্বতের একটি প্রশস্ত গুহায় দেবীর বাস। হিংলাজকে ঘিরে যেন পরস্পরের হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি পাহাড়। চারপাশে নেমে এসেছে ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড়ের এবড়ো-খেবড়ো পেশি। চারপাশে খেঁজুর আর কাঁটানাটার বন। রয়েছে মরুবাসী হিংস্র জন্তুজানোয়ারের ভয়ও। আর রয়েছে অনাবিল নৈঃশব্দ্য।

পর্বতের যে গুহায় দেবী অবস্থান করছেন, সেই গুহাটি একটি সুবৃহৎ প্রাকৃতিক গুহা। প্রায় একশো ফুট চওড়া, তিরিশ ফুট উঁচু। গুহার ভেতরে একটি বেদির ওপর শায়িত দুই দেবী পাশাপাশি। সামনের দিকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত দেবী, যাঁকে ভক্তেরা 'কোট্টরী' বলে ডাকেন; তাঁর পিছনে দেবীর সঙ্গিনী যোগিনী। বাসন্তী রঙের সিঁদুর-রঞ্জিত উঁচু মুখ দুটি কেবল জেগে আছে। টানা চোখ, মাথায় মুকুট। তবে প্রাচীন তীর্থযাত্রীদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আগে দেবীর কোন মুখমন্ডল দেখা যেত না; শুধু সিঁদুর লেপিত রক্তবস্ত্রে আবৃত প্রস্তর খণ্ডে তাঁরা অর্ঘ্য দান করতেন। শায়িত দেবীর নীচে একটি অর্ধবৃত্তাকার সুড়ঙ্গ রয়েছে।  এই সুড়ঙ্গে ঢুকে দেবীকে প্রদক্ষিণ করাই নিয়ম। দেবীর কাছাকাছি রয়েছে একটি অখন্ড অগ্নিকুন্ড। এই কুণ্ড অবিচ্ছিন্নভাবে সেই প্রাচীনকাল থেকেই জ্বলছে। এঁকে দেবীর জ্যোতির্ময়রূপ হিসেবেই পুজো করেন ভক্তরা। আসলে, এই পাহাড়ের নীচে রয়েছে গন্ধকের ভান্ডার। তা থেকে যে অবিরাম গ্যাস নির্গত হয়, তাই-ই জ্বলছে অখন্ড জ্যোতি হয়ে আজও।

হিংলাজের দেবী কোট্টরীর পৌরাণিক মাহাত্ম্য রয়েছে। রামায়ণের কালে যুদ্ধে ব্রাহ্মণ রাবণকে বধ করে রামের ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়েছিল। সেই পাপ থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন এই তীর্থে এসে তপস্যা ও পুজোর মধ্য দিয়ে। চৈত্র মাসের নবমীতে এই মন্দিরে প্রতিবছর দেবীর মহোৎসব হয়ে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে এখনও এই দেবীর পুজো হয় রক্তকরবীর ফুল, সিঁদুর ও নারকেল দিয়ে।

হিংলাজ তীর্থের অসাধারণ একটা দিক হল, দেবী যেমন হিন্দুদের আরাধ্যা, তেমনি মুসলিমদের কাছেও পূজনীয়া। প্রাচীন কাল থেকে তাঁরাও দলবেঁধে এই তীর্থে আসেন। এখানে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পুজো দেন। এই তীর্থের রক্ষণাবেক্ষণও করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। তাঁরা দেবীকে 'নানী মা' বলে ডাকেন। পুজো দেন সিন্নি দিয়ে। তাঁরা হিংলাজকে বলেন, 'নানী কি হজ'। এই এত বছরে পুজোকে কেন্দ্র করে কোনরকম সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দেয়নি, কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। একটি ইসলামিক দেশের এই দেবীস্থানে এমন সম্প্রীতি ও ধর্মীয় উদারতা উদাহরণ হয়ে রয়েছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে। তাই দেবী এখানে নিছক দেবী নন, প্রকৃতই মা হয়ে উঠেছেন; যে মায়ের কাছে চরাচরের সকল সন্তান প্রিয়, সকল সন্তান সমান...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...