একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ১৩

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, বিনা-নিমন্ত্রণে দক্ষের যজ্ঞস্থলে এসে অপমানিতা হয়ে সতী প্রাণত্যাগ করলেন। সেই খবর পেয়ে ক্রোধে ও শোকে আপন কেশ থেকে মহাদেব বীরভদ্রকে সৃষ্টি করলেন। বীরভদ্র যজ্ঞস্থলে এসে যজ্ঞের সব আয়োজন তছনছ করে ফেললেন। যুদ্ধে বিষ্ণুকে হারিয়ে মুণ্ড কেটে তাঁকে হত্যা করলেন। দক্ষেরও মুণ্ড কেটে পায়ে দলে তা পাতালে পুঁতে ফেললেন। তখন ব্রহ্মা হাতজোড় করে বীরভদ্রের কাছে অনুরোধ করলেন শান্ত হওয়ার জন্য।  

এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…

দক্ষের যজ্ঞস্থল লণ্ডভণ্ড, সমস্ত আয়োজন চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভূমিতে একদিকে একদিকে পড়ে আছেন ছিন্নমস্তক বিষ্ণু, অন্যদিকে দক্ষ। যন্ত্রণায় পড়ে পড়ে আর্তনাদ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অসংখ্য দেবতা। দক্ষের অনুগত সেনারা সকলেই মৃত। বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে তাদের দেহ। তারই মধ্যে ব্রহ্মার অনুরোধে বীরভদ্র ক্রোধ সংবরণ করে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু তখনই চরাচর লালে লাল হয়ে উঠল। উঠল প্রচণ্ড এক বিধ্বংসী ঝড়। সেই ঝড়ের ভেতর থেকে ধীর মন্থর পায়ে বেরিয়ে এলেন বৃষভ-নন্দী। তাঁর পিঠে আসীন নতমস্তকে মুহ্যমান মহাদেব। তিনি দক্ষের যজ্ঞস্থলের দিকে এগিয়ে আসতেই বীরভদ্র দীপ্ত এক অগ্নিশিখা হয়ে মহাদেবের অন্তরে লীন হয়ে গেলেন।

অমনি ব্রহ্মা সচকিত হলেন। বুঝলেন, মহাদেব দেবী-সতীর আত্মাহীন দেহটির কাছে এলে বা তাঁকে দেখলেই আবার অনর্থ হবে। এই মুহূর্তে সেটা হতে দেওয়া সমীচীন নয়। তাই তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন মহাদেবের দিকে। তাঁর পথ রোধ করে করজোড়ে দাঁড়ালেন। ব্রহ্মাকে সম্মুখে দেখে বৃষভ-নন্দীও স্থির হলেন। মহাদেবও মাথা তুলে ব্রহ্মার দিকে চাইলেন। ব্রহ্মা দেখলেন, শোকে-দুঃখে মহাদেবের দুই নয়ন জবাফুলের মতো লাল।

তখন ব্রহ্মা পরম আর্তিতে বিনয়াবনত ভঙ্গিতে পদবন্দনা করে মহাদেবকে তুষ্ট করলেন। অদ্রশ্যে তাঁর সহায় হলেন স্বয়ং আদ্যাশক্তি। পরম শোকের সেই মুহূর্তে দেবী আদ্যাশক্তির মায়ায় মহাদেব ক্ষণিকের জন্য যেন ভুলে গেলেন সতীর আত্মত্যাগের কথা। চরাচরে ভক্ত ব্রহ্মা আর ভগবান মহাদেব ছাড়া আর কিছুই যেন রইল না। ভক্তকে কৃপা করা ছাড়া তাঁর যেন আর কোন দ্বিতীয় কর্তব্যও রইল না। তিনি প্রসন্ন বদনে স্নিগ্ধ কণ্ঠে ব্রহ্মাকে বললেন, বৎস ব্রহ্মা, এখন বল তোমার কী অভিলাষ?

ব্রহ্মা মহাদেবের এই ভাবান্তর দেখে অত্যন্ত সুখী হলেন। করজোড়ে বললেন, প্রভু ভগবান বিষ্ণু নিহত হয়েছেন, তাঁর মস্তক পাতালে সুপ্ত রয়েছে; দয়া করে তাঁকে আপনি জীবন দান করুন। তাঁর অভাবে পালনক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। হে প্রভু, কৃপা করে তাঁকে জীবন দান করুন!

মহাদেব অভয় মুদ্রা তুলে বললেন, আচ্ছা, বেশ। তথাস্তু।

অমনি বলতে-না-বলতেই পাতাললোক থেকে বিষ্ণুর মস্তক উত্থিত হয়ে দেহের সঙ্গে সংযোজিত হল। মহাদেব এবার তাঁর অভয়মুদ্রাময় ডান হাত সম্মুখে প্রসারিত করতেই অমৃতধারা পতিত হল গিয়ে একেবারে বিষ্ণুর শ্রীমুখে। অমনি বিষ্ণু চোখ খুললেন। উঠে বসলেন। কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলেন। তারপর মহাদেবের পদবন্দনা করে করজোড়ে একপাশে উঠে দাঁড়ালেন। বিষ্ণুর এই বিনয়নম্র ব্যবহারে মহাদেব বেশ প্রীত হলেন। তখন ব্রহ্মাকে বললেন, বল বৎস, আর কী চাও?

ব্রহ্মা এবার ভূমিতে পতিত বীরভদ্রের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত দেবতাদের এবং দক্ষের সেনাদের জীবন প্রার্থনা করলেন। মহাদেব আবার তাঁর প্রার্থনা পূরণ করলেন। পুনরায় জীবন পেয়ে দেবতারা এবং দক্ষসেনারা মহাদেবের স্তবস্তুতি করে তাঁকে আবার তুষ্ট করলেন। তখন মহাদেব পুনরায় ব্রহ্মাকে বললেন, বল বৎস, তোমার আর কী প্রার্থনা?

তখন ব্রহ্মা যেন অন্তরে অমোঘ সাহস পেলেন। এতক্ষণ আপন পুত্র প্রজাপতি দক্ষের প্রাণ চেয়ে প্রার্থনা জানাতে সাহস পাচ্ছিলেন না বটে, কিন্তু পুত্রের জন্য তাঁর অন্তর হাহাকার করছিল। তিনি জানেন যে, দক্ষ শিব ও সতীর প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করেছেন। তিনি জানেন, শিবের মনে যদি আবার সতীর বিরহ জেগে ওঠে, তাহলে অনর্থ হবে। এই সমস্ত তাঁর মনে চলছিল বলেই আর-সকলের প্রাণ ফিরে চাইলেও এতক্ষণ দক্ষের প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেননি ব্রহ্মা। এবার যেন তাঁর খানিক সাহস হল, মরিয়া হয়ে বলে বসলেন, হে প্রভু, আপনি আমার সন্তান দক্ষকে দয়া করে জীবন দান করুন।

মহাদেব প্রার্থনা শুনে দক্ষের মুণ্ডহীন দেহটির দিকে তাকালেন। অমনি তাঁর অন্তরে ছায়াছবির মতো ফুটে উঠল বীরভদ্র কর্তৃক দক্ষের মস্তক দলনের ঘটনা। চোখের সামনে ফুটে উঠল আত্মত্যাগের পূর্বে দক্ষের প্রতি সতীর দেওয়া অভিশাপের কথা। সতী অভিশাপ দিয়েছিলেন, নিজের কৃতকর্মের জন্য সারাজীবন দক্ষ অনুশোচনায় দগ্ধ হবেন।

সতীর কথা পুনরায় স্মরণ হতেই বিস্মৃত-বিরহব্যথা পুনরায় জেগে উঠল মহাদেবের মনে। ক্রোধ ও শোক তাঁকে পুনরায় অধীর করল। দক্ষের অন্যায়ের কথা স্মরণ করে সেই অধীরতা আরও প্রবল হল। তবু ব্রহ্মার প্রার্থনা থেকে তিনি সরে এলেন না। ব্রহ্মার প্রার্থনা মেনে দক্ষকে পুনর্জীবিত করতেই হবে, নইলে যে সতীর অভিশাপের সত্যতা রক্ষা হবে না। জীবন লাভ না-করলে সারাজীবন দক্ষ অনুশোচনায় জ্বলে-পুড়ে মরবেন কেমন করে!

মহাদেব দক্ষকে প্রাণ দেবেন, কিন্তু ক্ষমা করবেন না। দক্ষ যেভাবে নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছেন, আপন জেদকেই যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তাতে তিনি একটি ছাগলের চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় রাখেননি। অসংখ্য পুত্রকন্যার জন্ম দিয়ে তিনি যে স্বভাব লালন করেছেন, তা ছাগলেরই স্বভাব। তাই মহাদেব তাঁর দেহে ছাগলের মস্তক স্থাপন করে অমৃত পান করিয়ে তাঁকে জীবনদান করলেন। হ্যাঁ, এই বিধিই যেন ঠিক হল—দর্পণে যতবার দক্ষ আপন মুখ দেখবেন, ততবার কৃতকর্মের কথা স্মরণ হবে, ততবার তিনি দগ্ধ হবেন! এভাবেই তিনি আজীবন শাস্তি পাবেন। দক্ষের কোন ক্ষমা নেই!

জীবন পেয়ে দক্ষ করজোড়ে মহাদেবকে নমস্কার জানিয়ে তাঁর পদবন্দনা করলেন। কিন্তু তাঁকে প্রশ্রয় দেবার মতো মনের অবস্থা মহাদেবের আর রইল না। কেননা, তাঁর চোখ ততক্ষণে পড়েছে ভূমিতে এলিয়ে পড়া সতীর নিষ্প্রাণ দেহটির দিকে।

অমনি নন্দীর পিঠ থেকে ধীরে নামলেন মহাদেব। ধীরে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সতীর দিকে। মুহূর্ত দাঁড়ালেন এসে সিথানে। চোখ ভরে উঠল জলে। আবেগে কাঁপল ঠোঁট। ধীরে ধীরে সিথানের কাছটিতে বসে কোলে তুলে নিলেন মাথা। তারপর সতীর মায়াময় চিবুকে হাত রেখে বিড়বিড় করতে লাগলেন মহাদেব, সতী, ছেড়ে চলে যেতে পারলে আমায়, একবারও ভাবলে না আমার কথা! তুমি যে আমার হ্লাদিনী, তোমায় ছাড়া আমি কেমন করে থাকব বল তো! তুমি আদ্যা, তুমি মহামায়া, তুমি আমার শক্তি, আমি তোমার ভৈরব! আমি সকলকে বাচিয়ে তুলতে পারি, কিন্তু আদ্যাশক্তিকে বাঁচিয়ে তোলার বিদ্যে যে আমি জানি না! তবে তোমায় প্রাণ ফিরিয়ে দিতে না-পারি, তোমার এই দেহ আমি কাউকে কেড়ে নিতে দেব না। সতী, তুমি ছাড়া আমার জীবন নিরর্থক, এই চরাচরেরও কোন মূল্য নেই। তাই আত্ম-আপন-চরাচর সমস্ত ধ্বংস করে ফেলব…হ্যাঁ ধ্বংস করে ফেলব সব…ধ্বংস…

বলতে বলতেই সতীকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালেন মহাদেব। কাঁধে তুলে নিলেন মুহূর্তেই। অমনি তাঁর হাতে-পায়ে-দেহের বিভঙ্গে ফুটে উঠল নাচের মুদ্রা। হয়ে উঠলেন নটরাজ। চরাচরে গুরু গুরু ডাকে গর্জে উঠল ক্ষুব্ধ মেঘমালা। সেই গর্জন যেন হয়ে উঠল ডম্বরুর তাল। মহাদেব সেই তালে শুরু করলেন প্রলয় নাচন। সেই নাচের তালে তালে দুলে উঠতে লাগল সমস্ত সৃষ্টি, সমস্ত চরাচর। শুরু হল বিশ্বলয়ের খেলা।

সেই দুরন্ত প্রলয় থেকে সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য মহাদেবকে নিরস্ত করতে ব্রহ্মা-বিষ্ণুসহ সমস্ত দেবতারা কাতর প্রার্থনা শুরু করলেন। সমস্ত জীবকুল ত্রাহি ত্রাহি রবে আর্তনাদ শুরু করল। কিন্তু মহাদেব তখন উন্মত্ত প্রায়, কারও প্রার্থনা, কারও আর্তনাদ তাঁর কানে প্রবেশ করল না। ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হলেন। ধ্যানে বুঝলেন যে, যতক্ষণ সতীর দেহ শিবের কাঁধে থাকবে, ততক্ষণ কিছুতেই মহাদেবকে নিরস্ত করা যাবে না। তিনি বিষ্ণুকে সুদর্শন দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে সতীকে মহাদেবের কাঁধ থেকে বিচ্যুত করতে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু সে-কথা শুনে বিষ্ণু অত্যন্ত শঙ্কিত হলেন। বললেন, মহাদেবের আবেগকে অকস্মাৎ স্তব্ধ করে দিলে, প্রিয়তমা সতীকে এভাবে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেললে তিনি ক্রোধে দেবকুলকেই আবার ধ্বংস করে ফেলবেন না তো!

বিষ্ণুর আশঙ্কায় ব্রহ্মাও এবার শঙ্কিত হলেন। চাইলেন বিষ্ণুর চোখে। যেন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে উপায়?...

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি মঙ্গলবার, পরের পর্বে।]

কাহিনিসূত্রঃ

শিব পুরাণ

লিঙ্গ পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এবং,

লৌকিক কাহিনি      

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...