একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ১৩

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, অপমান করার জন্য দক্ষ তাঁর নিজের যজ্ঞকর্মে আর-সকলকে নিমন্ত্রণ করলেও কন্যা সতী ও  জামাতা শিবকে আমন্ত্রণ জানাননি। সতী যজ্ঞের কথা শিবের মুখ থেকে শুনে সেখানে যাবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনিচ্ছা সত্বেও শেষমেশ তাঁকে যেতে অনুমতি দেন শিব। শিবের অনুমতি পেয়ে সতী তৎক্ষণাৎ দক্ষের যজ্ঞস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…

দক্ষের যজ্ঞস্থলে হাজির হয়ে সতী দেখলেন সেখানে এলাহি আয়োজন। স্বর্গের সমস্ত দেবতারা, সমস্ত দেবর্ষিরা, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের দল, মর্তের মুনিঋষিরা সকলেই সমাগত। এমনকি দক্ষের অপরাপর কন্যা-জামাতারাও সেখানে উপস্থিত, শুধু তিনি আর শিব নেই! এই যে তিনি এলেন, তাতে কেউ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল না, আপ্যায়ন করল না, এমনকি তাঁকে ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করল না। তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না যে, কেন এমনটা হচ্ছে! তাঁর সঙ্গে কেন এমন ব্যবহার করা হচ্ছে! তিনি ভীষণ আহত হলেন, অপমানিত বোধ করলেন, তাঁর চোখ বেয়ে গড়িয়ে এল জলের ধারা। দূরে দক্ষ তাঁর দিকে পিছন ফিরে যজ্ঞে ব্রতীর আসনে বসেছিলেন। সতী এগিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, পিতা, তুমি আমাকে, আমার স্বামীকে এভাবে কেন উপেক্ষা করলে?

সতীর প্রশ্ন শুনেও দক্ষ তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন না। মুখে তাঁর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না। পিছন ফিরেই এক প্রহরীকে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, প্রহরী, অনিমন্ত্রিতকে এই পবিত্র যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করতে কেন দিয়েছিস! ওর আগমনে এই যজ্ঞস্থল অপবিত্র হয়ে উঠল! অসভ্যের সঙ্গে বাস করে ও কী ভুলে গেছে নিমন্ত্রণ ছাড়া কোন শুভ অনুষ্ঠানে আসতে নেই! হয় ও চলে যাক এই মুহূর্তে, নয়তো ওকে দূর করে দে!

দক্ষের মুখে এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলেন না। সতী এই নিদারুণ অপমানে খানিক স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলেন। দক্ষের এই কদাকার রূপ তিনি ইতিপূর্বে দেখেননি, তাই স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি দক্ষ তাঁকে এভাবে অপমান করবেন। এত অতিথির মাঝে এমন অপমানে তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। চোখে ঝরতে লাগল অঝোর ধারা।

খানিক কেঁদে আবেগঘন অথচ মৃদু কণ্ঠে ধীরে ধীরে সতী বললেন, পিতা, তোমার মনে আছে, তুমি যখন আদ্যাশক্তিকে কন্যারূপে চেয়েছিলে, তখন তিনি কি বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, তোমার কন্যারূপে তিনি জন্ম নেবেন ঠিকই, কিন্তু অনাদর হলে, অপমানিত হলে সেই কন্যা দেহত্যাগ করবে। তুমি সেই শর্তে রাজি হয়েছিলে। মনে আছে? তারপরই আমার জন্ম হয়েছিল। তুমি জানো, আমি সেই আদ্যাশক্তির অংশ। সেদিন যা কথা হয়েছিল, তার তো অন্যথা হতে পারে না পিতা। তাই তোমার অনাদর, তোমার অপমান বুকে নিয়ে আমি আর বেঁচে থাকব না। যাবার আগে বলে যাই, আমার মৃত্যুর কারণ হয়ে সারাটা জীবন তুমি জ্বলে পুড়ে মরবে! সারাটা জীবন তোমার অনুশোচনার অন্ত থাকবে না!

শেষের কথাগুলো বলতে বলতে সতীর শান্ত কণ্ঠ ক্রমশ দৈবকণ্ঠের মতো বজ্রনাদের মতো ত্রিলোক মথিত করে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তাঁর দেহে জ্যোতির বলয় ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে শুরু করল। কথা শেষ হতেই সেই বলয় অগ্নিময় হয়ে উঠল। আগুনের শিখারা ক্রমে দীর্ঘ হতে হতে ঢেকে ফেলল সতীর সুললিত তনু। সেই অগ্নিশিখার মধ্যেই দেহ থেকে নির্গত হয়ে নিমেষে বিলীন হয়ে গেল তাঁর প্রাণবায়ু। তখন অগ্নিবলয় অদৃশ্য হয়ে গেল, ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল তাঁর প্রাণহীন দেহ। অমনি উপস্থিত সকলে একেবারে ‘হায় হায়’ করে উঠলেন। শুরু হয়ে গেল হাহাকার। সকলেই বলতে লাগলেন, হায় হায় দক্ষ, এ তুমি কী করলে! কেন এ অনর্থ ঘটালে!

সতী প্রাণ ত্যাগ করতেই যজ্ঞস্থল থেকে দেবর্ষি নারদ বেরিয়ে অমনি হাজির হলেন কৈলাসে। তখন সতীবিহীন কৈলাসে মহাদেব আনমনে বসেছিলেন। নারদ এসে তাঁকে সতীর দেহত্যাগের সংবাদ দিতেই তিনি একইসঙ্গে শোকে-ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন।   নিজের  একগাছি কেশ উৎপাটিত করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন। সেই কেশ থেকে অমনি উদ্ভূত হলেন এক পরম শক্তিশালী কালান্তক পুরুষ। পুরুষের নাম, 'বীরভদ্র'।  

বীরভদ্রের হাতে ত্রিশূল, নয়ন আরক্ত, মুখে হুঙ্কার। শিবের চোখের দিকে  তাকিয়েই  তিনি বুঝে গেলেন প্রভুর আদেশ। অমনি তিলমাত্র বিলম্ব না-করে ঝড়ের বেগে হুম হুম হুঙ্কার করতে করতে তিনি সবেগে চললেন দক্ষের যজ্ঞস্থলের দিকে। সেই হুঙ্কারে বীভৎস সব গণেরা অস্ত্র নিয়ে 'রে রে' করে তাঁর সঙ্গ নিয়ে দলে দলে ছুটলেন যজ্ঞক্ষেত্রের দিকে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বিপুল কলরবে গণেদের সঙ্গে নিয়ে বীরভদ্র হানা দিলেন যজ্ঞস্থলে। মুহূর্তে তছনছ করে ফেললেন যজ্ঞের আয়োজন। হোতা, ঋষি, মুনি ও ব্রাহ্মণের দল ভয় পেয়ে যে যে-দিকে পারল, পালিয়ে গেলেন। যাঁরা বাধা দিতে এলেন, তাঁদের কাউকে ধরে দূরে ছুঁড়ে দিলেন বীরভদ্র, কাউকে ত্রিশূলে বিদ্ধ করে মেরে ফেললেন।  গণেরা উন্মত্তের মতো যাকে সামনে পেল, তাকেই হত্যা করতে লাগল। ভয়ার্ত চিৎকার আর মারমুখি হুঙ্কারে সমস্ত যজ্ঞস্থান ভরে উঠল।

চোখের সামনে এভাবে যজ্ঞ-অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যেতে দেখে দক্ষ দিশাহারা হয়ে অস্ত্র ধারণ করলেন। মুখোমুখি হলেন বীরভদ্রের। শুরু হল দুজনের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ। একসময় দক্ষের হাতের তরবারি বীরভদ্রের ত্রিশূলের ঘায়ে দু'খন্ড হয়ে ছিটকে পড়ল। অমনি রাগে অন্ধ হয়ে দক্ষ বল্লম ছুঁড়ে মারতে গেলেন বীরভদ্রকে। বীরভদ্র তখন দারুণ ক্রোধে ত্রিশূলের এক প্রহারে দক্ষের ধড় থেকে মুন্ড আলাদা করে ফেললেন। তারপর কঠিন পদাঘাতে তা প্রোথিত করলেন একদম পাতালে।

দক্ষের মাথা পা দিয়ে পাতালে পাঠিয়েও যেন তুষ্টি হল না বীরভদ্রের। এবার তিনি যাকে সামনে পেলেন, তাকেই হত্যা করতে শুরু করলেন। তাঁকে পরাস্ত করে এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করতে সুদর্শন নিয়ে সামনে এলেন স্বয়ং বিষ্ণু। অমনি তাঁর সঙ্গে শুরু হল যুদ্ধ। যুদ্ধ এবার যেন সমানে সমান হতে লাগল। কিন্তু বার বার সুদর্শন ছুঁড়েও বিষ্ণু বীরভদ্রের গায়ে আঁচড়টুকুও কাটতে পারলেন না। বীরভদ্র শেষটায় ত্রিশূলের আঘাতে সুদর্শনকে নষ্ট করে বিষ্ণুর বুকে দারুণ পদাঘাত করে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিলেন। ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে বিষ্ণু উঠে আবার তাঁকে প্রহার করতে গেলেন। তখনই ত্রিশূলের এক আঘাতে বীরভদ্র বিষ্ণুরও মস্তক ছিন্ন করে তাঁকে বধ করলেন। তারপর তাঁর মস্তকও তিনি পাতালে প্রেরণ করলেন।

আসলে, প্রজাপতি ভৃগুর যজ্ঞে দক্ষ যখন শিবকে অপমান করেছিলেন, তখন বিষ্ণু তাঁর সেই অন্যায়ে কোন প্রতিবাদ জানাননি; আজ দক্ষ যখন সতীর প্রতি অন্যায় করছিলেন, তখনও তিনি প্রতিবাদ জানাননি; আত্মহত্যার পূর্বে সতীর পাশে এসেও দাঁড়াননি। উল্টে প্রতিটি ক্ষেত্রে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থেকে দক্ষের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাঁর হয়ে শিবভক্ত বীরভদ্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। চরম অন্যায় করেছেন তিনি। সেই অন্যায়ের প্রতিফল হিসেবেই শিবভক্তের পদাঘাত তাঁকে বুকে সহ্য করতে হয়েছে, হয়েছে মৃত্যুবরণ করতে।

বীরভদ্রের ধ্বংসাত্মক রূপে দারুণ সন্ত্রস্ত হয়ে এতক্ষণ একপাশে অবস্থান করছিলেন ব্রহ্মা। বীরভদ্রকে থামানোর আর কোন উপায় না-দেখে এবার তিনি তাঁর সামনে করজোড়ে বসে পড়লেন। তারপর তাঁকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে শুরু করলেন শিবের স্তব।

অমনি বীরভদ্র স্থির হলেন। কিন্তু অশান্ত হল প্রকৃতি। আকাশে মুহুর্মুহু দেখা যেতে লাগল বিদ্যুতের ঝলক, গুরু গুরু রবে গম্ভীর বজ্রনাদ শুরু হল, মেদিনী কাঁপতে শুরু করল, দিগন্তে উঠল ধুলোর ঝড়। তাতে ব্রহ্মা আরও সন্ত্রস্ত হলেন, বাকি যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন তাঁরাও ত্রস্ত চোখে চেয়ে রইলেন সেই অশান্ত দিগন্তের পানে। আরও এক তাণ্ডবের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় শুরু করলেন পল গুণতে...

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ আগামি মঙ্গলবার পরের পর্বে।]

কাহিনিসূত্র:

লিঙ্গ পুরাণ

শিব পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...