একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ১২

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, কিছুকাল একান্তে যাপন করার পর শিব-সতী কৈলাসে ফিরলেন। তখনই প্রজাপতি ভৃগু এসে শিবকে অনুরোধ করলেন তাঁর আয়োজিত এক যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে। শিব তাঁর নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। যজ্ঞস্থলে দক্ষ এলেন সবার শেষে। তিনি আসতেই সকল দেবতা উঠে দাঁড়ালেন, দাঁড়ালেন না শুধু শিব। দক্ষ শ্বশুর হিসেবে শিবের কাছ থেকে এই সম্মান আকাঙ্খা করেছিলেন। তাই সেই সম্মান না-পেয়ে শিবের ওপর ক্ষেপে গিয়ে তাঁকে কটু কথা বলে অপমান করতে শুরু করলেন। সকলেই ভাবলেন অপমানিত শিব বুঝি এবার প্রলয় ঘটাবেন। কিন্তু তখনই শিব তাকালেন ভৃগুর দিকে।

এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…

ক্রমাগত দক্ষের নিন্দাবাক্য শ্রবণ করেও শিব নিজেকে অসংযত হতে দিলেন না, সংযম হারালেন না, শান্ত হয়ে বসে রইলেন; সেই সঙ্গে দেখলেন, এই নিন্দাবর্ষণের প্রতিটি মুহূর্তেই প্রজাপতি ভৃগু সযত্নে আয়োজিত যজ্ঞটি বিনষ্ট হবার আশঙ্কায় কাঁপছেন। তাই তাঁকে অভয় দিতেই তিনি ভৃগুর চোখে চোখ রাখলেন। তাঁর সেই দৃষ্টি দেখে আশঙ্কায় ছিলেন বলেই ভৃগু প্রথমে ভয় পেলেন; তারপরই বুঝলেন সেই দৃষ্টিতে রয়েছে অনন্ত বরাভয়। সেই দৃষ্টি দিয়েই আশুতোষ শিব যেন বলছেন, ওহে ভৃগু, কোন চিন্তা নেই। আমি তো তোমায় কথা দিয়েছি, আমার উপস্থিতিতে তোমার যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। দক্ষ যতই আমাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করুন, অপমান করুন, আমি তোমার যজ্ঞ নষ্ট হতে দেব না!

শিবের চোখে অভয়বাণী পাঠ করে ভৃগু বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। ওদিকে দক্ষও যেন এবার শিবের প্রতি কুকথা বর্ষণ করে ক্লান্ত হলেন। ক্লান্ত হতেই হাত ঝেড়ে উত্তরীয় ঝাঁকিয়ে একটা অবজ্ঞার ভঙ্গি করে তিনি শিবের দিকে পিছন ফিরে একটি আসনে বসে পড়লেন। মহাদেব তাই দেখে মৃদু হাসলেন। সেই হাসি একমাত্র আদ্যাশক্তি মহামায় ছাড়া আর কেউ দেখতে পেলেন না। দক্ষকে নিরস্ত হতে দেখে ও মহাদেবকে শান্ত থাকতে দেখে উপস্থিত সকলে বেশ স্বস্তি পেলেন।

তখন শুরু হল ফের যজ্ঞের আয়োজন। খানিকক্ষণের মধ্যেই বেদমন্ত্রের সুমন্দ্র সুমধুর ধ্বনিতে দশদিক মুখরিত হল। তারপর যজ্ঞবেদির সপ্তজিহ্ব অগ্নিতে সহস্র মণ ঘৃত আহুতির মধ্য দিয়ে যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হল। আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল না। শুধু একটা কথা শিবের মনকে পীড়া দিতে লাগল, তা হল, দক্ষ যখন তাঁর নামে অকথা-কুকথা বলছিলেন, তখন অন্য দেবতাদের মতোই ব্রহ্মা-বিষ্ণু চুপ করে রইলেন, একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করলেন না!

দক্ষ ব্রহ্মার মানসপুত্র। বিষ্ণুর কে! তবু চুপ! আর ব্রহ্মা পুত্রের প্রতি বাৎসল্য বশতই কি প্রতিবাদ করলেন না? নাকি অন্য দেবতাদের মতো তিনিও দক্ষকে ভয় করেন? ভয়ই বা করবেন কেন! দক্ষকে তিনিই তো ক্ষমতা দিয়ে দিয়ে দক্ষ তৈরি করেছেন। তাহলে তিনি কী শিবের অপমানকে প্রশ্রয় দিলেন ইচ্ছে করেই! অতীতের অপমানের শোধ নিলেন? পঞ্চম মস্তকটি উৎপাটনের শোধ? না হলে, এর ক’দিন পরেই সমস্ত প্রজাপতিদের অধিপতি দক্ষকেই বা করে দেবেন কেন!

হ্যাঁ, শিবনিন্দার কয়েকদিন পরেই ব্রহ্মার অনুগ্রহে দক্ষ হয়ে উঠলেন সমস্ত প্রজাপতিদের অধিপতি। এই বিরল সম্মান পেয়েই ধরাকে সরাজ্ঞান করলেন দক্ষ। আয়োজন করলেন এক বিরাট যজ্ঞের। সেই যজ্ঞের নাম, ‘বৃহস্পতি’। সেদিন ভৃগুর গৃহে শিবকে অপমান করেও সাধ মেটেনি তাঁর। তাই যজ্ঞে সকল দেবতাদের সকল ঋষিদের সকল রাজাদের সমস্ত ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ জানালেও শিবকে এবং আপন কন্যা সতীকে আমন্ত্রণ জানালেন না। সর্বজ্ঞ শিব সমস্তই জানেন, জানেন এ লীলা সাঙ্গ হবার পথে এগিয়ে চলেছে, তাই রাগ করলেন না, বিচ্ছেদের ব্যথায় খানিক আনমনা হলেন।

‘দেখ স্বামী, কোথাও বোধ হয় আগুন লেগেছে! দেখ!’—শিব আনমনা হয়ে কতকাল বসে ছিলেন, খেয়ালই ছিল না। সহসা উত্তেজিত সতীর কথায় তাঁর চমক ভাঙল। তিনি সচকিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন ‘কী হয়েছে সতী?’

চিন্তিত কণ্ঠে সতী বললেন, ‘ঐ দেখ দূরে…ঐ যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী কেমন পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে…বোধ হয় আগুন লেগেছে! ও কি অরণ্য, নাকি জনপদ?’

শিব মৃদু হেসে বললেন, ‘ওটা পর্বত-অরণ্যময় জনপদ, কনখল। চিন্তা নেই দেবী। ওখানে আগুন লাগেনি। যজ্ঞ হচ্ছে। যজ্ঞবেদি থেকে পর্যাপ্ত ঘৃত সেবন করে তৃপ্ত ধোঁয়ারা গগনে উঠে আসছে।’

শিবের কথা শুনে সতী বিস্মিত হলেন, ‘যজ্ঞ হচ্ছে! তুমি যাওনি! তুমি যজ্ঞে না গেলে, যজ্ঞভাগ তুমি না গ্রহণ করলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে?’

শিব শুকনো হেসে বললেন, ‘কেন হবে না। সমস্ত দেবতারাই তো ওখানে উপস্থিত আছেন। তাঁরা আর আমি কি আলাদা? তাঁরা যজ্ঞভাগ গ্রহণ করলেই আমার যজ্ঞভাগ পাওয়া হয়ে যাবে। তাঁরা তৃপ্ত হলেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে।’

শিবের যুক্তি সত্য, কিন্তু তবু তা মানতে চাইল না সতীর মন। তিনি অবুঝের মতোই বললেন, ‘তা হোক। তবু তুমি গেলে না কেন?’

শিব এবার ইচ্ছে করেই হাসলেন। যেন হেসে নিজেকে হালকা করতে চাইলেন। বললেন, ‘বা রে, নিমন্ত্রণ না-করলে যাব কী করে?’

কথাটা শুনে খানিক থম মেরে রইলেন সতী। নিজের মনেই যেন বলে উঠলেন, ‘নিমন্ত্রণ করল না! তোমাকে! দেবাদিদেবকে নিমন্ত্রণ করল না! কে সে দুর্মতি! কে সে?’

শিব এই প্রথম মৌন হলেন। তাতে সতীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। তিনি আরও ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল না কে এই যজ্ঞের আয়োজন করেছে? বল না!’

শিব আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি জানেন সতীর এই অধীরতাকে প্রলম্বিত করে শান্ত থাকতে পারবেন না। তাই ধীরে বললেন, ‘তোমার পিতা, প্রজাপতি দক্ষ।’

দক্ষের কথা শুনে সতী যেন নির্বাক হয়ে গেলেন। তারপর অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘পিতা! পিতা তাঁর যজ্ঞে তোমায় আমন্ত্রণ জানালেন না! আমায় ডাকলেন না! কেন! তিনি কী করে বিস্মিত হলেন তাঁর কন্যা-জামাতাকে! কী করে!’

মহাদেব কী-ই বা বলবেন। তাই চুপ করে রইলেন। ভৃগুর ভবনে দক্ষের অপমানের কথা তিনি সতীকে জানাননি। এখনও জানালেন না। চুপ করে রইলেন। কিন্তু সতী স্থির থাকতে পারলেন না। পিতার যজ্ঞে তাঁদের নিমন্ত্রণ নেই!—এই কথাটাই তাঁর মন যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। এই কথাটাই তাঁকে অস্থির করে তুলছে। খানিক চুপ থেকে খানিক ভেবে তিনি নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘দেখ স্বামী, পিতার অনেক কন্যা, তাই হয়তো কোনভাবে তাঁর ভুল হয়ে গেছে আমাদের নিমন্ত্রণ করতে…সেখানে জামাতা হয়ে তোমার যাওয়া চলে না…কিন্তু আমি তো কন্যা, আমি তো যেতেই পারি…গিয়ে দেখে আসি, জেনে আসি পিতা আমাদের ইচ্ছায় না অনিচ্ছায় উপেক্ষা করলেন! তুমি অনুমতি দাও…যাই?’

শিব এবার স্থির চোখে সতীর দিকে চাইলেন। দুটো হাত আলতো রাখলেন তাঁর কাঁধে। তাঁর দৃষ্টি, তাঁর স্পর্শে রইল একরাশ আশ্রয়। বললেন, ‘সতী, তুমি তো এখন নিছক পিতার কন্যা নও, আমার ঘরণী। আমার ঘরই তোমার ঘর এখন। তাই বিনা নিমন্ত্রণে তোমারও এখন পিতার ঘরে যাওয়া চলে না, পিতার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া চলে না! আবার কন্যা হয়ে তুমি যদি পিতার কাছে যেতে চাও, স্বামী হয়ে আমার বাধা দেওয়াও চলে না। তুমি আমার ঘরণী, কিন্তু তিনি তোমায় জন্ম দিয়েছেন। তবে আমি বলি কি, কী দরকার গিয়ে, তিনি নিশ্চয় কিছু একটা ভেবে আমাদের আমন্ত্রণ জানাননি, এখন গিয়ে তাঁর সেই ভাবনাকে বিচলিত করে কী লাভ!’

শিবের কথার উত্তরে সতী কোন কথা বললেন না। না, স্বামীর প্রতি তাঁর কোন অভিমান হল না তাঁর। তবে, দুর্ভাবনার বেড়াজাল থেকে নিজেকে বের করে আনতেও পারলেন না। গুম মেরে শিবের আশ্রয়ে তেমনি বসে রইলেন মাথা নীচু করে। শিব বুঝলেন সেখানে না-গিয়ে সতী কিছুতেই শান্তি পাবেন না, স্বস্তি পাবেন না। তখন খুব ধীরে সতীর চিবুকখানি তুলে ধরে বললেন, ‘বেশ, পিতার কাছে গেলে যদি তোমার অন্তর শান্ত হয়, তাহলে যাও, তাঁর কাছ থেকে ঘুরে এসো। তোমায় আটকাব না, যাও।’

শিবের কথায় এবার সতীর মুখে হাসি ফুটল। অমনি স্বামীর চরণ বন্দনা করে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। বললেন, ‘সাবধানে থেকো। আমি শিগিগির ফিরে আসব!’

শিব শুকনো হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, বেশ।’

সতী যজ্ঞস্থলের দিকে রওনা দিলেন। যতদূর তাঁকে দেখা গেল, মহাদেব তাঁর দিকে চেয়ে চেয়ে তাঁর যাওয়া দেখলেন। তারপর দৃষ্টি ফেরালেন সম্মুখভূমিতে। অমনি বেরিয়ে এল তাঁর অন্তর থেকে নিদারুণ এক দীর্ঘশ্বাস… 

 

   

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্নপীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠসমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]

কাহিনিসূত্রঃ

শিব পুরাণ

দেবী ভাগবত পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...