আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, ক্রুদ্ধ মহাদেব ত্রিশূল তুলে ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হলে বিষ্ণু এসে তাঁকে থামালেন। বললেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর তিন দেহে একই পুরুষ। সুতরাং দেবী সতীকে কামভাবে দেখে ব্রহ্মা অন্যায় করেননি। এই অভেদতত্ত্ব বুঝে শিব শান্ত হলেন। দক্ষ ও অসিক্লী তখন কন্যাকে বিদায় জানালেন। শোভাযাত্রাসহ শিব নবপত্নীর সঙ্গে একান্ত কালযাপনের জন্য এক সুন্দর উপবনে হাজির হলেন।
এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…
প্রেমের কোন ভেদ নেই। দেব-দানব-মানবে শুদ্ধ প্রেমের প্রকাশ সমান। তাতে কামনা তো থাকেই, কিন্তু সেই কামনায় কোন আগ্রাসন থাকে না। মুগ্ধতার অবসরে পরস্পরে শুধুই সমর্পণ থাকে। সমর্পিত এই প্রেমেরই এক আবহ রচিত হল হিমালয়ের সেই সুরম্য উপবনে। বরযাত্রীদলের গণ, প্রমথ, গন্ধর্বেরা শিব-সতীর সঙ্গে শোভাযাত্রা ও সঙ্গীত-নৃত্য সহকারে উপবনে এসেছিল; ক্রমে তারা বিদায় নিল। শিব-সতী একান্ত হলেন।
তখন সেই নির্জনে অবকাশ হল প্রেম প্রকাশের। যে-প্রেমে কামনা, আদর, আদিখ্যেতা, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, খুনসুটি, যৌনতা প্রভৃতি আর-পাঁচজন নর দম্পতির মধ্যে দেখা যায়; সেই মানবিক আবেগের প্রকাশই ছোট ছোট পরিচিত অনুষঙ্গে দেখা যেতে লাগল শিব-সতীর মধ্যে। তাতে কোন নতুনত্ব নেই। তাই সেই আবেগমাখা মুহূর্তগুলির বিবরণেরও কোন প্রয়োজন নেই।
প্রেমের মুহূর্তগুলোর সঙ্গে প্রবাহিত হতে লাগল এক একটি ঋতু। সেই প্রবাহে একদিন প্রকৃতির আঁচলে প্রজাপতির মতো উড়ে এসে আশ্রয় নিল বর্ষা ঋতু। তখন সতীর চিত্ত চঞ্চল হল। তাঁর ভারি ইচ্ছে হতে লাগল কৈলাসে যাবার। বিবাহের পর শিব-নিবাসে তো তাঁর অধিষ্ঠানই হয়নি। ফলে নানান বাহানায় মহাদেবের কাছে তিনি আবদার করতে শুরু করলেন সেখানে যাবার জন্য। মহাদেব জগতের সকলের চাওয়া-পাওয়ার খেয়াল রাখেন, প্রিয়পত্নীর এই আবদারটুকু রাখবেন না! রাখবেন বৈকি। হেসে বললেন, বেশ তো, সে না-হয় যাওয়া যাবে।
সতী দেখলেন প্রেমময় এই একান্তবাস ছেড়ে শিবের এখনই যাবার মন নেই। অথচ তাঁর মন উচাটন হয়েছে কৈলাসের জন্য। কেননা, কৈলাস মানেই তো তাঁর গৃহ, তাঁর সংসার। সংসারে না-গেলে কী আর গৃহবধূর মন মানে! তাই সতী গোঁ ধরলেন, উঁহু, ‘যাওয়া যাবে’ নয়, এখনই যেতে হবে।
সতীর এমন আবদারের কাছে মহাদেব নিরুপায়। হাসলেন অসহায়চিত্তে স্মিত হাসি। বললেন, বেশ, তবে তাই হোক।
অমনি স্মরণ করলেন বাহন বৃষভ-নন্দীকে। স্মরণমাত্রেই নন্দী হাজির হলেন। তখন তাঁর পিঠে চেপে মহাদেব ও সতী হাজির হলেন কৈলাসে।
কৈলাস। আহা, দুধের ফেনার মতো নরম তুষারে আবৃত ও অলঙ্কৃত শিবের আবাস। শান্ত, স্নিগ্ধ, সমাহিত পরিবেশ। দুরন্ত ও অসভ্য প্রমথগণের আবাস সেখানে। তবুও স্থানমাহাত্ম্যে তারা দারুণ শান্ত। একান্ত অনুগত। তাই চারিদিকে এক অদ্ভুত প্রশান্ত নীরবতা বিরাজ করছে। আহা, এই তাঁর সংসার! এমন সংসারেই তো সুখ।
নন্দীর পিঠ থেকে নেমে মহাদেব বসলেন গিয়ে তাঁর যুগনির্দিষ্ট আসনে। প্রমথ ও গণেরা দেবীকে বরণ করে নন্দীর পিঠ থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে বসাল মহাদেবের বামে। তারপর পুষ্প-অর্ঘ্য দিয়ে সেই যুগলমূর্তিকে পুজো করল। সাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানাল। পতিগৃহে এই প্রথম আগমনে দেবী সতী এইভাবে বরিত হয়ে পূজিত হয়ে যার পর নাই আনন্দিত হলেন।
আনন্দের এই আবহে কৈলাসে উপস্থিত হলেন প্রজাপতি ভৃগু। ব্রহ্মদেব যে-ক’জন প্রজাপতির জন্ম দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন এই ভৃগু। তিনি এসে শিব ও সতীকে প্রণতি জানালেন। দেবী সতী নিজে তাঁকে আপ্যায়ন করলেন, উপবেশনের আসন দিলেন, অতিথিসৎকারের আহার দিলেন। গৃহিণীর কর্তব্য সমাপন হলে, তখন শিব কথা বলার অবসর পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ওহে প্রজাপতি ভৃগু, এবার বল কোন প্রয়োজনে শ্রম স্বীকার করে তুমি আমার আবাসে এসেছ?
ভৃগু করজোড়ে বললেন, হে মহাদেব, আপনি দেবাদিদেব। আপনাকে বাদ দিয়ে কোন কর্মই সম্পূর্ণ হয় না। আমি একটি মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছি। সমস্ত দেব, মহর্ষি ও মহাত্মাদের এই যজ্ঞে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এবার আপনি তাতে অংশগ্রহণ করলে তবেই আমার সেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে। অতএব হে শম্ভু, আপনি দয়া করে আমার নিমন্ত্রণ স্বীকার করুন।
ভৃগুর বিনয়ে মহাদেব অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। স্মিত হেসে বললেন, বেশ, তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। তোমার যজ্ঞ যাতে সম্পূর্ণ হয়, সফল হয়; তার জন্য আমার যা করণীয়, আমি করব।
এইভাবে মহাদেবের কৃপা তথা আশ্বাসবাণী পেয়ে ভৃগু কৃতার্থ হলেন। তিনি পুনরায় প্রণতি জানিয়ে বিদায় নিলেন।
কালচক্র নিয়ত আবর্তিত হতে হতে ক্রমে মহাযজ্ঞের দিনটিকে হাজির করল। নির্দিষ্ট ক্ষণে মহাদেব হাজির হলেন গিয়ে ভৃগু-প্রজাপতির ভবনে। সেখানে তখন বিপুল ব্যস্ততা, এলাহি আয়োজন। তাঁকে দেখে উপস্থিত দেব-ঋষি অতিথিরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন। হাতের কাজ ফেলে ছুটে এলেন স্বয়ং ভৃগু। প্রণতি জানিয়ে আপ্যায়ন করে আসনে অধিষ্ঠিত করলেন। ভৃঙ্গারে জল এনে পা ধুইয়ে দিলেন, ভৃগুপত্নী চুল দিয়ে তাঁর পা মুছিয়ে দিলেন। এমন আন্তরিক আপ্যায়নে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন মহাদেব।
আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে মহাদেব দেখলেন সমস্ত দেবলোক ইতিমধ্যেই হাজির হয়ে গেছেন এই যজ্ঞস্থলে। ঋষিরা এবং মহর্ষিরা ব্রতী-হোতা প্রভৃতির সহায়তায় যজ্ঞস্থল সজ্জিত করছেন। ব্রহ্মা ও বিষ্ণু সমস্ত তদারক করছেন। ব্রহ্মাচারীগণ হবি, সমিধ, যজ্ঞের দানসামগ্রী সমস্ত যজ্ঞবেদির সামনে গুছিয়ে রাখছেন। সকলেই ব্যস্ত, সকলেই আনন্দিত। কিন্তু হঠাৎ-ই সমস্ত ব্যস্ততা স্তব্ধ হয়ে গেল। সকলেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সদরের দিকে সম্ভ্রমে প্রণিপাত করতে লাগলেন। মহাদেব যে-দিকে বসেছিলেন, সেখান থেকে সদর ভালো দেখা যায় না। তাই বুঝতে পারলেন না কে এসেছেন, কেন সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছেন! কেনই বা প্রণিপাত করছেন!
মহাদেবের এই বিস্ময়ের মাঝেই সহসা দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন প্রজাপতি দক্ষ। তখন তাঁকে দেখে এবং দেবাদি সকলের নতি হবার দেউলে প্রবণতা দেখে তিনি মুচকি হাসলেন।
এদিকে যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করেই সবাইকে অমন সশ্রদ্ধভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দক্ষ বেশ প্রসন্ন হলেন। দেবতাদের দেবতা মহাদেবের শ্রদ্ধার পাত্র তিনি, প্রণম্য তিনি; এঁরা তো তাঁর চরণে প্রণিপাত করবেনই। এ-কথা মনে আসতেই বেশ একটা সার্বভৌম হয়ে ওঠার অহং জাগল মনে, চমৎকার আনন্দ হল তাঁর। আর তখনই তাঁর চোখ পড়ল মহাদেবের দিকে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে তিনি আসনে বিরাজ করছেন! একি, সকলে উঠলেও মহাদেব উঠে দাঁড়াননি! তাঁকে নমস্কারটুকুও নিবেদন করেননি! এ যে ঘোর অপমান!
অপমানের কথা মাথায় আসতেই দক্ষ এতক্ষণের প্রশান্তি হারালেন। ধৈর্য হারালেন। অসম্ভব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সেই ক্রোধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলেন। চোখ লাল করে গর্জন করে উঠলেন, ওহে শিব, তুমি কি সমস্ত শিষ্টাচার ভুলে গেছ! ভুলে গেছ আমার কন্যাকে বিবাহ করেছ? আমি যে তোমার প্রণম্য—এই সত্যটাও ভুলে গেছ! ধিক, একটা কুলমানহীনের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে! যার কুলের ঠিক নেই, যার জন্মের ঠিকানা নেই; সে অন্যের সম্মান কী করে রক্ষা করবে! তোমার এতবড় স্পর্ধা, তুমি দক্ষ প্রজাপতিকে অপমান করেছ—এর শাস্তি তোমায় পেতেই হবে! এ তোমার দেবাদিদেব হয়ে ওঠার মিথ্যে দম্ভ, সেই দম্ভ আমিই দলন করব!
দক্ষের মুখে এই সব কটুকথা শুনে উপস্থিত সকলেই একটা বিকট বিড়ম্বনার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। ভৃগু শুরুর আগেই যজ্ঞ পণ্ড হল ভেবে শঙ্কিত হলেন। কেননা, সকলেই ভাবলেন দক্ষের কটুবাক্যে শিব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবেন। সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলবেন। কিন্তু এ কি তিনি তো তার কিছুই করছেন না! শান্ত হয়ে বসে আছেন! তাহলে কি আরও বড় প্রলয়ের জন্য তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন!
শিব এতক্ষণ দক্ষের চোখে চোখ রেখে তার নিন্দাবাক্য শ্রবণ করছিলেন, তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল; এবার ভৃগুর চোখের দিকে তাকালেন। হঠাৎ চোখাচোখি হতেই ভৃগুর বুকের ভিতর অজানা শঙ্কায় ধড়াস করে উঠল!...
[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্নপীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠসমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]
কাহিনিসূত্রঃ
দেবী ভাগবত পুরাণ
কালিকা পুরাণ