আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, মূলত ব্রহ্মার প্ররোচনায় শিব বিবাহে সম্মত হলেন। ব্রতিনী সতীর কাছে উপস্থিত ও মদনের বাণে বিদ্ধ হয়ে তাঁকে পত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে চাইলেন। তারপর যখন সতীকে পাওয়ার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হলেন, তখনই সতী দক্ষের কাছে তাঁকে চেয়ে নেবার অনুরোধ জানিয়ে চলে গেলেন। শিব বিরহে কাতর হলেন। তারপর কৈলাসে ফিরে সতীকে দক্ষ দান করবেন কি না এই দ্বন্দ্বে ব্যাকুল হলেন।
এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…
মদনের বাণে দেবাদিদেব মহাদেবের মন ক্রমে এতটাই ব্যাকুল হল যে, তিনি সাধারণ একজন প্রেমিক-মানুষের মতো আচরণ করতে লাগলেন। দ্বিধাদ্বন্দ্বে আকুল হয়ে সতীর বিরহে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁর সাধের ধ্যানের আসনটিতেও বসে থাকতে পারলেন না। ‘হা সতী’, ‘হা সতী’ বলে অধীর হয়ে পদচারণা করতে লাগলেন। তাঁর এই পাগলপারা অবস্থা দেখে কৈলাসের যত গণেরা, ভুত-পিশাচেরা সকলেই অবাক হয়ে গেল। তাদের হৃদয়ে প্রেমপ্রবৃত্তি নেই, তাই প্রভুর হৃদয়ের এই অস্থিরতা কারণ তারা অনুধাবন করতে পারল না। তাই অত্যন্ত অবাক হয়ে ভীত হয়ে তারা বিমূঢ় দর্শকের মতো চেয়ে রইল।
আর মহাদেব? তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল যে, দক্ষের কাছে গিয়ে সতীকে চাইলে তিনি যদি সতীকে দান না-করেন! যদি মুখের ওপর ‘না’ বলে দেন! সেটা তিনি তা সহ্য করবেন কেমন করে! সতীকে না-পেলে তিনি এই জীবন অতিবাহিত করবেন কেমন করে!—দ্বন্দ্বব্যাকুল মনে এসব ভাবতে ভাবতেই মহাদেবের হঠাৎ ব্রহ্মার কথা স্মরণ হল। ব্রহ্মাই তো তাঁকে এই প্রেমের পথে চালিত করেছেন, এই বিবাহে উৎসাহিত করেছেন, এই অতুল বিরহ দান করেছেন! তাহলে সতীর সঙ্গে তাঁর মিলনের পথ প্রশস্ত করাও তো তাঁরই কর্তব্য!
মহাদেব আবাহন করলেন ব্রহ্মাকে। তিনি আবাহন করতেই সাবিত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অমনি ব্রহ্মা তাঁর কাছে হাজির হলেন। ব্রহ্মার সঙ্গে সাবিত্রীকে দেখে শিব সতীর জন্য আরও ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অতিথি সম্ভাষণের পূর্বেই তিনি হৃদয়দুর্বল পুরুষের মতো কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন, হে ব্রহ্মা, তুমি এক্ষুনি দক্ষের কাছে যাও, যে করেই হোক সতীর সঙ্গে আমার বিবাহের প্রস্তাবে শীঘ্রই সম্মতি নিয়ে এসো, যাও!
মহাদেবের কথা শুনে ব্রহ্মা ও সাবিত্রী দুজনেই বেশ খুশি হলেন। খুশি হলেন, কেননা তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। যোগী শিবকে ব্যাকুল করে বিবাহের পথে অগ্রসর করানোই তো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ব্রহ্মা শিবকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, হে শম্ভু, তুমি উতলা হয়ো না, শান্ত হও, শীঘ্রই সতীর সঙ্গে তোমার মিলনের পথ অবশ্যই প্রশস্ত হবে। কেননা তাই-ই বিধির ইচ্ছে। তুমি ধৈর্য ধর, আমি দক্ষের সদনে গিয়ে এক্ষুনি সেই বিধিপথ প্রস্তুত করে আসছি।
মহাদেবকে যথাবিহিত নমস্কার জানিয়ে ব্রহ্মা ও সাবিত্রী চলে গেলেন। কিন্তু শিবের অস্থিরতা ব্রহ্মার কথায় স্তিমিত হল না। তাঁর প্রেমিকহৃদয় ব্রহ্মার কথাকে স্তোকবাক্যজ্ঞান করে আরও বিরহ জ্বালায় জ্বলতে লাগল—যার সাক্ষী হয়ে রইল নির্বাক প্রমথেরা।
ওদিকে দক্ষালয়ে দক্ষও বিশেষ শান্তিতে ছিলেন না। তিনি পত্নী অসিক্লীর মুখে শিবকে স্বামী হিসেবে পাবার জন্য সতীর সাধনার কথা শুনেছেন। স্বয়ং সতীর মুখে শুনেছেন, শিব তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চান। জেনেছেন, সতী শিবকে দক্ষের কাছে এসে পাণিপ্রার্থনা করতে বলেছেন। আর এই সমস্তটা শুনেই দক্ষ আনন্দিত হয়েও বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
দক্ষের আনন্দ ও দুশ্চিন্তার একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। কারণ আছে। মহাদেব দেবতাদের মধ্যে প্রধান। আদি। তিনি পরমেশ্বর। আর দক্ষ? তিনি ব্রহ্মার দশ মানসপুত্রের মধ্যে একজন। দেবসমাজে তিনি দশজনের একজন হিসেবেই মান লাভ করেন। বিশেষ একজন হিসেবে নন। কাজেই দেবাদিদেবকে যদি জামাতা হিসেবে তিনি লাভ করতে পারেন, তাহলে তাঁর শ্বশুর হিসেবে দেবতাদের মধ্যে তিনি হঠাৎ করেই বিশেষ মান্যগণ্য হয়ে উঠতে পারবেন। কেননা, তখন তিনি দেবতাদের দেবতা শিবেরও প্রণম্য হয়ে উঠতে পারবেন। অর্থাৎ তাঁর কৌলীন্য ছোঁয়ার মতো ক্ষমতা আর কারও থাকবে না এই দেবলোকে। দেবী আদ্যাশক্তির আরাধনা করে কন্যারূপে এই জন্যই তো তিনি চেয়েছিলেন।
অন্তনিহিত এই কারণটির জন্যই তিনি অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়েছেন। ভাবছেন, মহাদেব এখনও কেন সতীর বিবাহ প্রস্তাব তাঁর কাছে পাঠালেন না! সতী মহাদেবকে তাঁর কাছে এসে পাণিপ্রার্থনা করতে বলায় তিনি ক্রুদ্ধ হলেন না তো! বিরূপ হলেন না তো! ইস, সতী কেন একেবারে মহাদেবকে সঙ্গে করেই তাঁর কাছে নিয়ে এলেন না!—এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দক্ষ বড় অস্থির হয়ে আপন প্রাসাদে পদচারনা করতে লাগলেন।
অস্থিরতার এই মুহূর্তেই ব্রহ্মা আবির্ভূত হলেন তাঁর সামনে। সম্মুখে পরমপিতাকে দেখে প্রণাম করলেন দক্ষ। তারপর আপ্যায়ন করে নিজের হাতে তাঁর পা ধুইয়ে দিয়ে তাঁকে আসন পেতে দিলেন বসতে। তারপর তাঁর পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, হে পিতা, বলুন কী বার্তা?
ব্রহ্মা স্মিত হেসে বললেন, বৎস, আমি কৈলাস হতে মহাদেবের বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তুমি তো জানো, তোমার কন্যা সতীর জন্মই হয়েছে মহাদেবের পত্নী হওয়ার জন্য। তাই আমারও ইচ্ছা যাতে অতি সত্বর সেই কারণ সিদ্ধ হয়। এবার যত শীঘ্র পার মহাদেবের হাতে তোমার কন্যাকে অর্পণ কর।
দক্ষ এই কথায় অত্যন্ত তৃপ্ত হলেন, তাঁর অন্তর শান্ত হল, তাঁর মুখে প্রফুল্লতার রেশ ছড়াল। করজোড়ে বললেন, পিতা, আপনি স্বয়ং এই প্রস্তাব বহন করে এনেছেন, মহাদেব স্বয়ং এই প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন, আমার কন্যা সতীও তাঁকে পাবার সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছে; আর কী চাই! এখন মহাদেব কোন শুভক্ষণে আমার ভবনে আসবেন আমি শুধু তার প্রতীক্ষায় আছি, আমি অপেক্ষা করছি কখন তাঁর হাতে আপন কন্যা সম্প্রদান করব। হে পিতা, আমার এই অধীরতার সংবাদ মহাদেবকে গিয়ে জ্ঞাপন করুন।
দক্ষের মুখে এই বিনয়বচন শুনে ও বিবাহের জন্য অধীরতা দর্শন করে ব্রহ্মা অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। জগতের মঙ্গলের জন্য, দেবতাদের মঙ্গলের জন্য শিব ও শক্তিকে মিলিয়ে দেবার জন্য তিনি যে প্রকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন বিষ্ণুর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে, তা অতি সহজেই সিদ্ধ হচ্ছে দেখে, তিনি বেশ আহ্লাদিত হলেন। আর দেরি না-করে দক্ষকে আন্তরিক আশীর্বাদ দান করে বিদায় নিলেন। পাড়ি দিলেন শিবলোকের দিকে।
রয়ে গেলেন বিরাট কক্ষে প্রজাপতি দক্ষ। একা। ব্রহ্মার গমনপথের দিকে চেয়ে তাঁর ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। তাতে মিশে রইল কিছুটা আত্মতুষ্টির অহং, খানিকটা ক্রূরতা। কিন্তু তাঁরও ওপরে যে নিঃশব্দে হাসলেন অদৃশ্য মহাকাল, তা তিনি দেখতে পেলেন না!
আসলে, যা সহজ, তা বোধহয় সহজ নয়; মঙ্গলের মাঝেও অনেক অনেক অমঙ্গলের পদধ্বনি থাকে, তাকে চিনতে পারা, তার সঙ্গে যুঝতে পারাও সহজ নয়। যে শিব দেবতাদের আদি, যিনি নিজেই স্বয়ং বিধাতা, তিনি কি এই কুটিল হাসি দেখতে পেলেন না? সাধারণের আবরণে থেকে তিনিও কি দক্ষের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বুঝতে পারলেন না? নাকি এও তাঁরই এক দুরধিগম্য লীলা? কে জানে!...
[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]
কাহিনিসূত্রঃ
দেবী ভাগবত পুরাণ
কালিকা পুরাণ