একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ৭

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, দেবী আদ্যাশক্তির আজ্ঞায় দক্ষ অসিক্লীকে বিবাহ করলেন। দেবী সতীর জন্ম হল। সতী শৈশব থেকেই শিব-অনুরক্তা। যৌবনে পা দিয়ে শিবকে স্বামী হিসেবে পেতে চাইলেন। ব্রহ্মা ও নারদ এসে তাঁকে বলে গেলেন যে, শিবকে তিনি অবশ্যই লাভ করতে পারবেন। কিন্তু সদ্য কোন উপায় না-দেখে সতী খানিক ভাবনায় পড়লেন।

এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…

শিব স্বয়ম্ভু। শিব সুন্দর। শিব পরমকাম্য। তাঁকে কামনা করে সতী সেই শৈশব থেকে পুজো করে আসছেন, তাঁকে উপাসনা করে আসছেন। শৈশবেই মাতা অসিক্লী শিবের প্রতি তাঁর অনুরাগ দেখে তাঁকে দিয়েছিলেন মহাদেবের একখানি পটচিত্র। সেই পটখানিই সেই থেকে সতীর অন্তরের ধন। অমূল্য সম্পদ। তায় এখন শিবসুন্দরকে দেখে তাঁর চোখ জুড়ায়, বুক উথালপাথাল করে, মন কেবলই নিজের করে পেতে চায়। ব্রহ্মা ও নারদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই তাঁদের মুখে আপন বাসনার বিবরণ শুনে সতী আরও উচাটন হয়ে উঠেছেন।

সেদিন আপন ঘরে শিবের সেই পটচিত্রখানি বুকে ধারণ করে সতী আপন মনে তাঁরই কথা ভাবছেন, ভাবছেন, কখন, কেমন করে তাঁর সেই সাধনার ধনকে পাবেন!

এমন সময় মা অসিক্লী এলেন সেখানে। মায়ের চোখে মেয়ের হৃদয় আড়াল হল না। তিনি বুঝলেন, মেয়ের অধীরতা, আকুলতা। কেন সেই ব্যাকুলতা, তাও বুঝলেন। কার জন্য ব্যাকুলতা, তিনি জানেন। তিনি এও জানেন, অতুল সাধনা ছাড়া শিব ধরা দেন না।খানিক নীরব থেকে অসিক্লী পরম স্নেহে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন। তাতে সতীর মগ্নতা ম্লান হল, তিনি সচকিত হলেন। লজ্জিত হলেন। কিন্তু শিবের সেই পট বক্ষের আশ্রয় থেকে অপসারিত করলেন না।অসিক্লী যেমন মমতায় মেয়েকে স্পর্শ করেছেন, তেমনই মমতামাখা কণ্ঠে বললেন, তাঁকে পাবার এখনও সময় হয়নি মা। আরও কিছু লীলা বাকি, আরও কিছু কৃচ্ছ্রসাধনার প্রয়োজন।

সতী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন মায়ের দিকে। মা বললেন, নারীর কৃচ্ছ্র হল ব্রতে। সে ব্রত করে সংসারের মঙ্গলের জন্য, আপনার মঙ্গলের জন্য, সমস্ত অভিলাষ পূরণের জন্য। তুমি শিবের অভিলাষে বার মাসের বারটি ব্রত পালন কর মা, তোমার কামনা পূর্ণ হবে। এসো তোমায় ব্রতের আচার শিখিয়ে দি!

মায়ের আবাহনে অবগাহন করে সতী ব্রতিনী হলেন। তখন আশ্বিন মাস, সতী এই মাস থেকেই শুরু করলেন বার মাসের বার ব্রতের ধারা। এক-একটি মাস কাটতে লাগল এক একটি ব্রতে।

সতী যখন ব্রত শুরু করলেন, ওদিকে কৈলাসে শিব তখন ধ্যান সমাপন করে আপন গণেদের সঙ্গে অবসর যাপন করছিলেন। সময় উপযুক্ত বিবেচনা করে ব্রহ্মা বসন্তকে এই সময় আদেশ দিলেন মৃদুমন্দ মলয় বাতাসে শিবের যোগীচিত্তে শৃঙ্গারের আবেগ জাগাতে। কামদেব ও রতিকে আদেশ দিলেন, মহাদেবের মনে রমনীর প্রতি কামনা জাগাতে।

ব্রহ্মার এই আদেশে অনতি বিলম্বেই কৈলাসক্ষেত্রে ব্যাপিত হলেন বসন্ত ঋতু। তাঁর সমীরের স্নিগ্ধ শিহরে শিবের চিত্তে উচাটন জাগল। কামদেবের পুষ্পধনুর টঙ্কারে রমণীর তরে তাঁর উতলা হল মন। তখনই হঠাৎ তাঁর চোখ গেল দূরে, দেখলেন, ব্রহ্মা ও বিষ্ণু আপন আপন পত্নী সাবিত্রী ও লক্ষ্মীর সঙ্গে কৈলাসের দিকেই আসছেন। পত্নীসহ দুই দেবতাকে দেখে তাঁর অন্তরে অভূতপূর্ব এক ভাবের সঞ্চার হল। মনে হল, অহো, দোঁহে কী অপূর্ব শোভা, কী অপূর্ব জ্যোতি, কী অপূর্ব তেজঃ! মনে হল, আহা, আমারও যদি অমন সাধ্বী কোন পত্নী থাকত, তাহলে বেশ হত!

শিব এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ব্রহ্মা-বিষ্ণু সস্ত্রীক এসে পড়লেন তাঁর সাক্ষাৎ-সন্নিধানে। অমনি শিব সচকিত হয়ে প্রফুল্লবদনে তাঁদের যথোচিত আদর-আপ্যায়নে উপবেশন করালেন। তারপর হেসে জিজ্ঞেস করলেন, এবার বল, তোমাদের আগমনের হেতু?শিবের প্রশ্ন শুনে বিষ্ণু ইঙ্গিতে ব্রহ্মাকেই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে অনুরোধ করলেন। শিবের হাসিতে অভয় পেয়ে ব্রহ্মা স্মিত মুখে বললেন, হে ত্রিকালজ্ঞ, তোমার সদ্য যা অভিলাষ, তা-ই আমাদের আগমনের হেতু। দেখ, তুমি তপোনিষ্ঠ, কিন্তু সঙ্গহীন। সঙ্গছাড়া অপত্য হয় না। তোমার অপত্যে দেবতাদের প্রয়োজন। অপত্যের জন্য প্রয়োজন নারী। নারী হলেন শক্তি। শক্তি ছাড়া সিদ্ধি হয় না। অতএব হে স্বয়ম্ভু, নিজের জন্য বিবাহ কর, দেবতাদের জন্য বিবাহ কর!

ব্রহ্মার বাক্য শুনে শিব গম্ভীর হলেন। খানিক ভাবলেন। তারপর বললেন, তোমরা যা বলেছ, ঠিকই বলেছ। শাস্ত্রের কথাই বলেছ। জগত-সত্যের কথাই বলেছ। কিন্তু আমি যোগমুক্ত হলে যে যোগযুক্ত হবে, আমি কামাসক্ত হলে যে মোহিনী হবে, যে সর্বদা আমার কর্মের অনুগামিনী হবে—তেমন রমণী কে আছে, যাকে আমি বিবাহ করব?

ব্রহ্মা স্মিত হেসে বিনীতভাবে বললেন, আছেন বৈকি মহাদেব, তেমনই রমণী আছেন। দক্ষ কন্যা দাক্ষায়ণী সতী। তিনি শৈশব থেকেই তোমায় কামনা করে আরাধনা করেন, এখন তোমাকে পাবার জন্যই ব্রতচারিণী হয়েছেন। হে দেব, তুমি তাঁকে কৃপা কর, পত্নীরূপে গ্রহণ কর!

এবার বিষ্ণু মুখ খুললেন। করজোড়ে অনুনয় করে বললেন, হে শম্ভু, তুমি তাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ কর! অতঃপর লক্ষ্মী করজোড়ে বললেন, হে আশুতোষ, তুমি তাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ কর! সাবিত্রী করজোড়ে বললেন, হে ভোলানাথ, তুমি তাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ কর! সকলের এই বিনীত অনুরোধে যোগেন্দ্র শিব আবারও ভাবিত হলেন। ভাবলেন, তারপর স্মিত হেসে বললেন, বেশ। তাই হবে।

শিবের এই কথা শুনে লক্ষ্মী-নারায়ণ, ব্রহ্মা-সাবিত্রী, কামদেব-রতি, বসন্ত, গণসমূহ সকলেই আনন্দে উদ্বেলিত হলেন। শিবের নামে জয়ধ্বনি দিলেন। তারপর আপন আপন লোকে প্রস্থান করলেন। ক্রমে কৈলাস নির্জন হল। নির্জনতার এই আবহে ব্রহ্মার উপদেশ, সতীর সংবাদ সমস্তই মনের মধ্যে অদ্ভুত এক ভালোলাগা অনুরণিত করতে লাগল। তখন শিব সতীকে দেখার জন্য, তাঁকে কৃপা করার জন্য অধীর উতলা হলেন। আবির্ভূত হলেন ব্রতচারিণী সতীর সম্মুখে।

সতী তখন হিমালয়ের নির্জন কন্দরে দীর্ঘ উপবাসে নন্দাব্রত উদযাপন করছিলেন। সহসা প্রাণপ্রিয় ইষ্টের সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি লজ্জিত হলেন। কিন্তু কর্তব্য ভুললেন না। ব্রীড়াবনতা বদনে মহাদেবের চরণবন্দনা করলেন। তারপর তাঁর কৃপার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

কিন্তু শিব অপরূপা সতীকে দেখে এমনই বিহ্বল হলেন যে, সতীকে কৃপা-সম্ভাষ করতেও বিস্মৃত হলেন। দু’জনের সেই নীরব অপেক্ষায় মহার্ঘ হল ক্ষণ। কামদেবের এই বিলম্ব সইল না। শিব-সতীর এই পূর্বরাগকে ত্বরিত করতে আড়াল থেকে তিনি তাঁর পুষ্পধনুতে ‘হর্ষক’ বাণ যোজনা করলেন। বিদ্ধ করলেন শিবের হৃদয়।

অমনি প্রগলভ হয়ে উঠলেন শিব। হয়ে উঠলেন মোহময়। প্রেমময় স্মিত হেসে বললেন, হে দেবী, আমি তোমার ব্রতে অতিশয় তুষ্ট হয়েছি, বল কী বর চাও? 

কিন্তু লজ্জায় সতী কথা বলতে পারলেন না। কিছুই চাইতে পারলেন না। বলতে পারলেন না যে, ‘আমি তোমাকেই চাই!’ দ্বিধায়-সংকোচে বসে রইলেন জড়ের মতো। কামনার ধন হাতের কাছে পেয়েও আঁকড়ে ধরতে পারলেন না, এমনই তাঁর সংকোচ!

মহাদেব তাঁর মনের অবস্থা বুঝলেন। মহাদেব যোগী, মহাদেব ত্রিকালজ্ঞ, মহাদেব পরম প্রেমিক। তিনি সতীর হৃদয় জানবেন না তো, জানবেন কে! তবুও লীলাময় তিনি। তাই মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, হে দেবী, বল কি বর চাও?

এবার সতী সাহস সঞ্চয় করলেন। নিজের লজ্জা সংযত করলেন। ধীরে বললেন, হে দেব, আমায় এই বর দিন, যেন আমার অভিলাষ পূর্ণ হয়!

মহাদেব সতীর মুখ থেকে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা শুনতে চাইছিলেন, তাঁকে পাওয়ার কথা জানতে চাইছিলেন। তাই ইঙ্গিতমাত্রেই মহাদেব ভীষণভাবে হৃদয়তাড়িত হলেন। বললেন, বেশ, তাই হোক। হে দেবী, তুমি আমার পত্নী হও!

সতীর পানে অনিমেষ চেয়ে একবার নয়, বার বার বলতে লাগলেন মহাদেব, ‘হে দেবী, তুমি আমার পত্নী হও!’। বার বার বলেও যেন সাধ মিটতে চাইল না তাঁর। সতীকে হৃদয়ে ধারণ করতে মন চাইল। সতী তাঁর অন্তরের সেই বাসনা অনুধাবন করে যুগপৎ আনন্দিত ও আরও আরও লজ্জিতা হলেন। স্মিত হেসে মৃদু স্বরে বললেন, হে জগদীশ্বর, আমায় পিতার কাছে প্রার্থনা করে আমায় গ্রহণ কর।

আর অপেক্ষা করলেন না। সতী পুনরায় মহাদেবের চরণ বন্দনা করে গৃহে ফিরে গেলেন।

আর মহাদেব? তিনি খানিক বিহ্বল হয়ে সতীর গমনপথের দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর ধীরে কৈলাসে ফিরে লোক সাধারণের মতো বিরহ জ্বালায় পাগলপারা হলেন, অধীর হয়ে ভাবতে বসলেন। ভাবতে লাগলেন, দক্ষের কাছে সতীকে চাইতে হবে? তবে তাঁকে পাওয়া যাবে? তাহলে বর দিলাম কেন! দক্ষ যদি রাজি না হন? তাহলে? তাহলে কী হবে?...

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]

কাহিনিসূত্রঃ

দেবী ভাগবত পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...