একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ৯

আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, শিব দুর্ভাবনায় পড়েছেন দক্ষ তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করবেন কিনা, এই নিয়ে। শেষে সেই দুর্ভাবনা আর সহ্য করতে না-পেরে ব্রহ্মাকে ডেকে দক্ষের কাছে পাঠালেন, ঘটকালি করে তাঁকে রাজি করাতে। ওদিকে দক্ষ তখন শিবকে জামাতা হিসেবে বরণ করে দেবলোকে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় মশগুল। কাজেই ব্রহ্মা তাঁর কাছে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। জানালেন, শিব যখনই আসবেন তাঁর ভবনে, তখনই তাঁর হাতে তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন। 

এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…

কৈলাসে উৎকণ্ঠায় অধীর আশুতোষ শিব। কখনও বসছেন, কখনও পায়চারি করছেন, কখনও বা অস্থির ভঙ্গিতে চেয়ে চেয়ে দেখছেন ব্রহ্মার আগমন পথের দিকে। আর ভাবছেন, সেই কখন ব্রহ্মা দক্ষের কাছে গেছেন, এখনও এলেন না কেন! তবে কী দক্ষ রাজি হচ্ছেন না! তবে কী দক্ষকে রাজি করাতে না-পেরে ব্রহ্মা এখানে আসতে ভয় পাচ্ছেন বা লজ্জা পাচ্ছেন!

এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শিবের মনে অস্থিরতার শেষ নেই যেন, যেন শেষ নেই দ্বন্দ্বের! শিবের উৎকণ্ঠায় উৎকণ্ঠিত তাঁর অনুগত গণেরাও। তারাও অধীর আগ্রহে অনিমেষ চোখে চেয়ে আছে ব্রহ্মার আগমনপথের দিকে। চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তারা সচকিত হয়ে উঠল, ধৈর্য হারিয়ে দারুণ কোলাহল করে উঠল। তাদের কোলাহলে শিবও সচকিত হয়ে উঠলেন। অমনি তাঁর চোখ গেল তাদের কোলাহলের উৎসের দিকে। দেখতে পেলেন, দূরে, অতি দূরে হংসের পিঠে চেপে কৈলাসের দিকেই এগিয়ে আসছেন ব্রহ্মদেব! তাঁকে আসতে দেখে যেমন আনন্দ হল মহাদেবের, তেমনি আশাহত হওয়ার আশঙ্কায় তাঁর হৃদয়ে যেন একটা শিহরণের স্রোত বয়ে যেতে লাগল ক্রমাগত। দুর্বিষহ এই অবস্থায় কয়েকটা মুহূর্ত কাটল। তারপর ক্রমে ব্রহ্মা হাজির হলেন শিবের সম্মুখে।

ব্রহ্মা কোন ভণিতা করলেন না। সরাসরি হেসে বললেন, তোমার আশঙ্কা অমূলক মহাদেব। তোমার প্রস্তাবে দক্ষ যার পর নাই আনন্দিত হয়েছেন, বলেছেন যে-শুভক্ষণে তুমি তাঁর দ্বারে যাবে, সেই শুভক্ষণেই তিনি তাঁর কন্যা সতীকে তোমার হাতে সমর্পণ করবেন। ব্রহ্মার মুখে এই কথা শুনে মহাদেবের বুকের পাথর যেন নিমেষে নেমে গেল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুক্ত হলেন। পুলকে তাঁর সর্বাঙ্গ শিহরিত হল। আনন্দে অধীর হয়ে হাঁক দিলেন, ‘ওহে শুভক্ষণ, আর বিলম্ব কেন!’

অমনি সমস্ত নক্ষত্রমালা ও গ্রহদল একযোগে শুভ অবস্থানে এসে দাঁড়াল। ত্রিলোকে ব্যাপিত হল ওঙ্কার। সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে পড়ল আনন্দের হিল্লোল। তখন শিবের মাথায় দেদীপ্যমান হয়ে উঠলেন রাঙা ভাঙা চাঁদ। বাড়িয়ে তুললেন জটার জৌলুস। কণ্ঠে, কটিতে, বাহুদ্বয়ে সুললিত সর্পকুল হল অলঙ্কার। কণ্ঠে দুলল রুদ্রাক্ষের হার। কটির ব্যাঘ্রচর্ম সাতরঙের বাহারে দশদিক চমকিত করল। মহাদেব সেজে উঠলেন বরের সাজে। মহাদেবকে বরসজ্জায় এভাবে সেজে উঠতে দেখে শিবানুচর অযুত অযুত গণ ও প্রেতেরা মহানন্দে অধীর হল। শিবের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে তূরী, ভেরি, দুন্দুভি, শিঙা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গাল বাজাতে বাজাতে নৃত্য করতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেই আনন্দ কোলাহলে ছেয়ে গেল দশদিক।

অমনি ব্রহ্মা স্মরণ করলেন নারদ প্রভৃতি মানসপুত্রদের, স্মরণ করলেন সমস্ত দেবদেবীদের। তিনি স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেবদেবীরা একে একে আবির্ভূত হতে লাগলেন শিব সন্নিধানে। তাঁদের সঙ্গে সমস্ত গন্ধর্ব-অপ্সরাগণও প্রকট হলেন সেখানে। প্রকট হয়েই তাঁরা শামিল হলেন এই আনন্দ উৎসবে। গন্ধর্বেরা গান ধরলেন, অপ্সরাগণ শুরু করলেন রমণীয় নৃত্য। অমনি চারিদিকে সুগন্ধময় পবন প্রবাহিত হতে শুরু করল। শুরু হল পাখির সমবেত কূজন। সমস্ত জগত এক শান্ত-সমাহিত-সৌম্যরূপ ধারণ করল। গগনমণ্ডল হতে অবিরাম ধারায় সুগন্ধময় পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। সমস্ত চরাচর যখন এইভাবে আনন্দময় হয়ে উঠল, তখন ব্রহ্মা মহাদেবকে সম্বোধন করে কমনীয় কণ্ঠে বললেন, হে শম্ভু, শুভক্ষণ প্রস্তুত, শুভানুধ্যায়ীরা সমাগত, শুভপথ প্রশস্ত এবার বিবাহযাত্রা শুরু করা উচিত!

সকলকে সমাগত দেখে মহাদেবও অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন। ব্রহ্মার আবাহনে তাই তিনি স্মিত হেসে সম্মতি জানালেন। অমনি বাহন বৃষভ-নন্দী সুসজ্জিত হয়ে ত্বরিতে এসে দাঁড়ালেন তাঁর পায়ের কাছে। তখন প্রসন্ন বদনে মহাদেব তাঁর পিঠে চেপে বসলেন। এগিয়ে চলল শোভাযাত্রা। দেবকন্যারা বাজাতে শুরু করলেন শঙ্খ, দেবীরা দিতে লাগলেন উলুধ্বনি। সম্মুখে মহাদেব, পশ্চাতে আর-সকলে তাঁর অনুগমন করতে লাগলেন। এ এক দেখার মতো শোভাযাত্রা। চোখ জুড়ানো সমারোহ। যা দেখলে জীবন ধন্য হয়ে যায়।

তুমুল আনন্দ কোলাহলের মধ্য দিয়ে শোভাযাত্রা থামল এসে দক্ষের প্রাসাদের সম্মুখে। তাঁদের আনন্দ কোলাহল শুনে স্বয়ং দক্ষ ও অসিক্লী পূর্বেই দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। শোভাযাত্রা এসে থামতেই তাঁরা সকলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে উলু, শঙ্খধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টির মধ্য দিয়ে অন্দরে এনে বসালেন। তারপর দক্ষ স্বহস্তে সকলের পা ধুইয়ে দিলেন। অসিক্লী আপন মেঘবরণ চুল দিয়ে পা মোছালেন। শেষে ফল ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। ক্রমে বেশ কিছুকাল হাস্যপরিহাসের পর উপস্থিত হল বিবাহের ক্ষণ। তখন গণ এবং গন্ধর্বদের নৃত্যগীতের মাঝে শিবকে আবাহন করে যথাবিহিত পূজা-মন্ত্রের বিধি মেনে দশদিক ও শতাগ্নিশিখাকে সাক্ষী রেখে দক্ষ কন্যা সতীকে শিবের হাতে সম্প্রদান করলেন। সম্প্রদানের সময় ব্রহ্মা, নারদ ও অপরাপর মুনিরা ঋক-সাম-যজুঃ বেদ থেকে বিবাহ সঙ্গীত গাইলেন। সমবেত শুভ মেঘেরা গগন থেকে পুষ্পবৃষ্টি করল।

বিবাহ-আচার সম্পূর্ণ হতেই নারায়ণ স্মিত মুখে নবদম্পতি শিব-সতীকে প্রীতিজ্ঞাপন করে মহাদেবকে বললেন, আহা, দাক্ষায়ণী সতীর সঙ্গে হে মহাদেব তোমাকে কী অপূর্বই না লাগছে! হে শম্ভু প্রার্থনা করি, তুমি এঁর সহায়তায় সংসারীদের মঙ্গল করো, দেব ও মনুষ্যকে রক্ষা করো, দুর্বৃত্তদের সংহার করো! যে তোমার হ্লাদিনী দেবী সতীর রূপলাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে আকাঙ্ক্ষা করবে, সে দেব-দৈত্য-নর যেই হোক না কেন, তাকে তুমি বধ করবে! নারায়ণের এই প্রার্থনা তথা আন্তরিক উপদেশ মহাদেবের পছন্দ হল। তিনি মৃদু হেসে বললেন, বেশ, তুমি যা বলেছ, তাই হবে!

শিবের কথা শেষ হতে-না-হতেই স্মিত হাসিতে নবলীলার চাপল্য নিয়ে সেখানে অদৃশ্য কায়ায় হাজির হলেন মহামায়া। মুহূর্তে মায়ায় আবিষ্ট করলেন ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মার মনে তৈরি হল মোহের আবরণ। চক্ষু হল মোহের স্ববশ।

এই অবস্থায় ব্রহ্মা তাকালেন সতীর দিকে। বধূবেশে আহা তাঁর কী অপরূপ রূপ! সেই রূপ দেখে ব্রহ্মার হৃদয়ে জাগল তাঁকে একান্ত করে পাওয়ার বাসনা। সেই বাসনা এতই প্রবল হল যে মোহবশীভূত ব্রহ্মা তাকে দমন করার চেষ্টাই করলেন না।  আড়াল করার চেষ্টা করলেন না। তাঁর কামনাবিধুর অবস্থা সকলেই অবলোকন করে শঙ্কিত হলেন। সকলের সম্মুখেই নির্গত হয়ে নিপতিত হল তাঁর জন্মবীজ! সেই জন্মবীজ থেকে ‘সংবর্ত’, ‘আবর্ত’, ‘পুষ্কর’ ও ‘দ্রোণ’—নামের চারটি মেঘ জন্ম নিল। জন্ম নিয়েই তারা ত্বরিতে উঠে গেল গগনমণ্ডলে। ঢেকে ফেলল চরাচর। গর্জন করতে করতে প্রচণ্ড বারিধারায় চরাচর ভাসিয়ে দিতে চাইল।

ব্রহ্মার এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কাণ্ড দেখে সকলেই হতবাক। দেবী সতীর দিকে কামুক চোখে তাকালে, যে তাকাবে তাকে হত্যা করবেন বলে মহাদেব নারায়ণকে কথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ কী করলেন ব্রহ্মা! প্রীতির এই অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর ও অবশ্যম্ভাবী একটি ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত। নৃত্য-গীত কখন থেমে গেছে। মহাদেবের মুখের হাস্য কখন মিলিয়ে গেছে। তাঁর মুখমণ্ডলে জমতে শুরু করেছে মেঘের মতো পুঞ্জ পুঞ্জ ক্রোধ। সকলেই যেন চরম সময়টির জন্য মোহাবিষ্টের মতোই নির্বাক নিঃস্পন্দ হয়ে অপেক্ষারত। তারই মধ্যে ক্রমে সমস্ত ক্রোধ একাকার হল। অমনি শিব লেলিহান শিখার মতো লোহিত হয়ে উঠলেন। তাঁর জটারাশি গগনে উত্থিত হয়ে ঢেকে দিতে চাইল সমস্ত চরাচর। তাঁর কঠিন হস্তে উঠে এল কালান্তক ত্রিশূল। সকলকে ত্রস্ত করে ব্রজ্রনাদে দারুণ এক হুঙ্কার ছেড়ে তিনি সবেগে ধাবিত হলেন চতুরানন ব্রহ্মাকে হত্যা করতে!… 

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]

কাহিনিসূত্রঃ

দেবী ভাগবত পুরাণ

কালিকা পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...