একান্ন সতীপীঠের সাতকাহন: পর্ব- ২

প্রথম পর্বের শেষে আমরা দেখেছি যে, সৃষ্টিকর্মে লিপ্ত হবার আগেই দুই ভয়ানক অসুর ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাকে হত্যা করতে অগ্রসর হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অসুর দু'জন কারা? কেন তারা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করল? ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পূর্বে কীভাবেই তারা সৃষ্ট হল? কে'ই বা তাদের সৃষ্টি করলেন? কেনই বা সৃষ্টি করলেন?

আসলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর পৃথকভাবে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কর্তা ঠিকই, কিন্তু ত্রয়ী দেবতা এক না-হলে সৃষ্টির সূচনাই হয় না। আড়াল থেকে আপন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তাঁদের সৃষ্টিকর্মে নিয়োগ করেন যিনি, তিনি দেবী আদ্যাশক্তি। দেবাদিদেব যেমন আদি দেবতা, ইনি তেমনি আদি দেবী। 'ভগবতী', 'মহামায়া', 'যোগমায়া', 'পরাশক্তি' প্রভৃতি তাঁর কত নাম। প্রতিটি কল্পান্তে যখন প্রলয়কাল আসে, যখন সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যায়, তখনও ইনি স্বমহিমায় বিরাজ করেন। প্রয়োজনে সৃষ্টির উপলক্ষ তৈরি করতে নিজেই নিযুক্ত হন।

তাই নতুন কল্পের শূন্য চরাচরে দেবী যখন আড়াল থেকে ব্রহ্মাকে সৃজন করার আদেশ দিলেন, যখন দেখলেন ব্রহ্মা আদেশ পেয়েও কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না; তখন ত্রয়ী দেবতাকে মিলিয়ে দিতে দেবী এক নতুন লীলার পরিকল্পনা করে মুচকি হাসলেন। তারপর অনন্তের কোলে নিদ্রিত বিষ্ণুর শিয়রের কাছটিতে আবির্ভুত হলেন।

দেবীর মায়ায় বিষ্ণুর নিদ্রা আরও প্রগাঢ় হল। দেবী বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল বিষ্ণুর বাম কানে প্রবেশ করালেন। আঙুলের অগ্রভাগে তুলে আনলেন কিছু যুগসঞ্চিত ময়লা। ভূমিহীন মৃত্তিকাহীন চরাচরে সেই ময়লা দিয়েই তৈরি করলেন এক ভীষণ দর্শন অসুরমূর্তি। দেবীর ইচ্ছায় মূর্তি প্রাণ পেল। চিৎকার করে উঠল 'মধু দাও, মধু দাও!' বলে। দেবী তার মুখে মধু দিয়ে শান্ত করলেন। নাম দিলেন, 'মধু'

 

ShaktiPeeth1

 

একটি অসুর সৃষ্টি করে দেবীর মন ভরল না। তিনি তার দোসর সৃষ্টিতে নিবিষ্ট হলেন। এবার ডান হাতের কড়ে আঙুল বিষ্ণুর ডান কানে প্রবেশ করালেন। তুলে আনলেন সামান্য কিছু ময়লা। তাই দিয়েই সৃষ্টি করলেন কীটের মতো দেখতে এক অসুরকে। দেবী তার নাম দিলেন, 'কৈটভ'

সৃষ্টির সূচনাতেই দেবী সৃজন করলেন দ্বেষ। হিংসার প্রতিমূর্তি। প্রতিমা। তারপর অসুর দু'জনকে আদেশ করলেন, মধু-কৈটভ যাও, এবার বিষ্ণুকে নিদ্রা থেকে তুলে যুদ্ধ কর।

এমন আদেশ পেয়ে দুই অসুর যেন কৃতার্থ হল। করজোড়ে বলল, তুমি আমাদের জন্মদাত্রী। মাতা।তোমার আদেশ শিরোধার্য। আমরা যুদ্ধ করব। ভীষণ যুদ্ধ। তুমি শুধু বলে দাও, আমাদের আত্মরক্ষার উপায়।

স্বভাবে অবোধ অসুর সন্তানদের এই বিনয় দেখে দেবী অত্যন্ত খুশি হলেন। বললেন, বৎস মধু-কৈটভ, তোমাদের বিনয়ে আমি প্রীত হয়েছি। বর দিচ্ছি, একমাত্র বিষ্ণু ছাড়া আর কেউ-ই তোমাদের বধ করতে পারবেন না। তবে বিষ্ণু তখনই তোমাদের বধ করতে পারবেন, যখন তোমরা তাঁর হাতে মৃত্যুবরণ করতে চাইবে, তার আগে নয়। যাও, যুদ্ধ করো।

আদেশ দিয়ে দেবী অন্তর্হিত হলেন।

তখন মধু ও কৈটভ বর লাভ করে ভারি নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রিত বিষ্ণুকে জাগানোর কাজে লিপ্ত হল। অনেক প্রচেষ্টাই করল, কিন্তু জাগাতে সমর্থ হল না। ব্যর্থ হয়ে তারা দারুণ ক্রুদ্ধ হল। ক্রুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর গায়ে দর্প সহকারে আঘাত করতে লাগল। সর্বাঙ্গে আঘাত করতে করতে তারা হঠাৎ বিষ্ণুর নাভিমণ্ডল থেকে উদ্গত অদৃশ্যপ্রায় পদ্মের মৃণালটি দেখতে পেল। এত আঘাতেও বিষ্ণু জাগছেন না দেখে, তারা আরও আরও ক্রুদ্ধ হয়ে খড়্গ উদ্যত রেখে মৃণাল অনুসরণ করে শূন্যে ভাসতে ভাসতে উপরে উঠে এল। এবং উপরে উঠেই পদ্মাসনা ব্রহ্মাকে দেখতে পেয়ে এক প্রবল হঙ্কারে চরাচর কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই বৃদ্ধ! তুমি কে?

তাদের সেই উদ্যতখড়্গ রুদ্র ও বীভৎস মূর্তি দেখে ব্রহ্মা ভীত হয়ে সন্ত্রস্ত কণ্ঠে নিজের নাম নিবেদন করে বললেন, আমি ব্রহ্মা...

অসুরেরা আবার হুঙ্কার ছাড়ল, ওহে ব্রহ্মা, যদি বাঁচতে চাও তাহলে এক্ষুনি গিয়ে বিষ্ণুকে নিদ্রা থেকে জাগাও! যাও!

ভীত নিরস্ত্র নিরপরাধ নির্ঝঞ্ঝাটে ব্রহ্মা মধু-কৈটভের সঙ্গে সংঘাতে যাবার কথা ভাবতেও পারলেন না। তিনি নিতান্ত বাধ্য বালকের মতো মৃণাল বেয়ে নেমে এলেন প্রলয়পয়োধি জলে। সম্মুখে দেখলেন সহস্র ফনা অনন্তের কোলে নিদ্রিত আছেন ভগবান বিষ্ণু। আহা, কী অপরূপ! পরনে হলুদ রঙের বস্ত্র। গলায় চিরসুগন্ধী চিরজীবী ফুলমালা। অঙ্গে রত্ন অলঙ্কার। মাথায় রত্নমুকুটের শোভা। মুখে স্মিত হাসি। চারটি হাতে শোভা পাচ্ছে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম।

ব্রহ্মা দেখলেন, বিষ্ণুর অঙ্গ থেকে নির্গত হচ্ছে এক আশ্চর্য মোহময় প্রশান্ত জ্যোতি। তাতে তিনি মুগ্ধ হলেন। বিমুগ্ধ চোখে অবাক হয়ে চেয়েই রইলেন বিষ্ণুর পানে। মুগ্ধতার এই বিলম্ব অসুরদের সইল না। তারা আবার হুঙ্কার ছাড়ল, বিলম্ব করছ কেন ব্রহ্মা, এক্ষুনি বিষ্ণুকে তোল!

মুগ্ধতার মাঝে অসুরদের আচমকা হুঙ্কারে চমকে উঠলেন ব্রহ্মা। নিজেকে সংযত করে বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গে উদ্যোগী হলেন। অল্পক্ষণেই বুঝলেন বাহ্য উপায়ে এই যোগনিদ্রা ভঙ্গ হবার নয়। তাই তিনি শুরু করলেন যোগনিদ্রার দেবী যোগমায়ার স্তব। যোগমায়া, দেবী আদ্যাশক্তিরই আরেক রূপ।

ব্রহ্মার স্তবে যোগমায়া তুষ্ট হয়ে যোগনিদ্রার আবেশ দূর করলেন। বিষ্ণু জাগরিত হলেন। সম্মুখে ব্রহ্মাকে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি খুব প্রসন্ন হলেন। কিন্তু অসুরেরা তাঁকে প্রসন্নতা প্রদর্শনের সময় দিল না। উদ্যত খড়্গ ও রক্তিম চোখের ক্রূরতা নিয়ে বিষ্ণুর প্রতি দারুণ হুঙ্কার হেনে রণরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অসভ্যের মতো হঠাৎ এই আক্রমণে অসম্ভব ক্রুদ্ধ হলেন বিষ্ণু। তিনি শয্যা ছেড়ে ত্বরিতে উঠে দাঁড়ালেন অনন্তের ফনায়। সেখানেই শুরু হল ঘোরতর যুদ্ধ।

সেই যুদ্ধ প্রলম্বিত হল সহস্র বৎসর। কেননা, দুই পক্ষই প্রবল পরাক্রম। কেউই কম যান না। প্রবল প্রত্যাঘাতের পর প্রত্যাঘাতে বিশ্রামহীন বিরামহীন এই যুদ্ধ চলতেই লাগল। এই পরাক্রম ও প্রত্যাঘাত বছরের পর বছর অনন্ত আর আপন ফনায় সহন করতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি অত্যন্ত কাতর হয়ে দুই পক্ষকেই নিরস্ত্র হওয়ার জন্য বারে বারে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন। কিন্তু দুই পক্ষই তখন যুদ্ধের নেশায় বিভোর, জয়ের আশায় মগ্ন। অনন্তের কাতর প্রার্থনা তাঁদের কানে গেল না।

অনন্তের অবস্থা ভারি শোচনীয় হয়ে উঠল। ভারি অভিমান হল তাঁর! তাঁরই বিধাতা, তাঁরই বিষ্ণু, তাঁর কথাই শুনছেন না! এবার তাহলে তাঁর গতি কী হবে!...

[কাহিনির পরবর্তী অংশ পড়তে চোখ রাখুন আগামি পর্বে। দেবী সতীর জন্ম থেকে একান্ন পীঠ গড়ে ওঠার ইতিহাস, পীঠ সমূহের ইতিহাস, মাহাত্ম্য ও কিংবদন্তি পরিবেশিত হবে এই ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলোতে।]

আজকের কাহিনি সূত্র:

কালিকা পুরাণ

দেবী ভাগবত পুরাণ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...