আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে, যজ্ঞস্থলে এসে ব্রহ্মার প্রার্থনায় শিব বিষ্ণুকে প্রাণদান করলেন। দক্ষকেও প্রাণদান করলেন, তবে অন্যায়ের শাস্তি দিতে তাঁর দেহে ছাগমুণ্ড স্থাপন করলেন। তারপর সতীর মৃতদেহ দেখে শোকে অধীর হয়ে মৃতদেহটি কাঁধে তুলে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করতে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলেন। তখন ব্রহ্মা বিষ্ণুকে সুদর্শন দিয়ে সতীর দেহ কেটে শিবের কাঁধ থেকে সতীকে বিচ্ছিন্ন করতে অনুরোধ করলেন। কেননা, তা না-করলে এই তাণ্ডব থামবে না। কিন্তু বিষ্ণু সেটা করতে ভয় পেলেন। যদি শিব তাতে তাঁদের ওপর রুষ্ট হন, এই আশঙ্কায়। এ-কথাটা ব্রহ্মাকেও চিন্তায় ফেলল।
এবার শুনুন তার পরের ঘটনা…
সতী বিরহে শিব নটরাজ হয়েছেন। সতীর দেহ কাঁধে রেখে তাণ্ডব নৃত্যে তিনি বিশ্বলয়ের খেলায় মগ্ন হয়েছেন। খেলাও নয়, এ যেন এক বিধ্বংসী ধ্যান। সেই ধ্যান ভঙ্গ করতে সতীর দেহ বিখন্ড করে শিব-সতীকে আলাদা করতে হবে। কিন্তু তার পরিণতি যদি ভয়ঙ্কর হয়? যদি ক্রুদ্ধ শিব ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকেও বিনষ্ট করেন? তাহলে যে আবার অকালে মহাপ্রলয় ঘটবে! সৃষ্টির নিয়ম বিঘ্নিত হবে!—এই সব সাত-পাঁচ ভেবে ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু দুজনেই দ্বিধাগ্রস্ত হলেন, দুজনেই আকুল হলেন। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। কেননা, উদ্দাম শিবের উদগ্র পদভারে ত্রিলোক ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রবে ক্রন্দন শুরু করেছেন, পিনাকপাণির সুতীব্র ডম্বরুধ্বনি দেব-মানব-দানবের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাঁদের সমবেত আর্ত চিৎকারে চরাচরে সৃষ্টি হয়েছে এক নারকীয় আবহ। আর দেরি নয়, পরিণতি যা হয় হোক, এই আর্তি ও আর্তনাদের মাঝে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকা যায় না। তাতে পালনকর্তার দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ানো হয়। নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করা দেবতার কাজ নয়। নিজেকে নিঃশেষ করেও কর্তব্য পালন, পরহিত সম্পাদনই দেবধর্ম। তাই আর দ্বিধা নয়, দ্বন্দ্ব নয়; মুহূর্তের মধ্যে বিষ্ণু আহ্বান করলেন সুহৃদ-শস্ত্র সুদর্শনকে।
সুদর্শন। এ তো শিবেরই সৃষ্টি করা অস্ত্র, এ তো শিবেরই দান। আজকের এই মুহূর্তটির জন্যই কী সুদূর অতীতে শিব এই অস্ত্র গদাধারী বিষ্ণুকে দান করেছিলেন? হতেই পারে, লীলাময় শিবের লীলার স্বরূপ পূর্ব হতে বোঝে সাধ্য কার! সে-কথা ভেবেই মুহূর্তে বিষ্ণুর মনে পড়ে গেল শিবের কাছ থেকে সেই সুদর্শনপ্রাপ্তির ঘটনাটি।
বহুকাল আগের এক সন্ধ্যায় জল থেকে ‘জলন্ধর’ নামে এক মহাপ্রতাপশালী অসুরের জন্ম হল। জন্মের পরই সে দারুণ তপস্যায় ব্রহ্মাক্র তুষ্ট করে তাঁর কাছে অমরত্বের বর প্রার্থনা করল। কিন্তু সেই বর ব্রহ্মার পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিনি দেব-দানব-মানবের মধ্যে কেউই জলন্ধরকে বধ করতে পারবে না, এমন বর দান করলেন। আর এটাকেই অমরত্বের বর ভেবে জলন্ধর ভীষণ তাণ্ডবের সঙ্গে ত্রিলোক জয় করে ফেলল। স্বর্গচ্যুত দেবতারা তখন সুরক্ষার আর্তি নিয়ে বিষ্ণুর শরণ নিলেন।
ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের রক্ষা করতে জলন্ধরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন বটে, কিন্তু ব্রহ্মার বরের কারণে পরাজিত হলেন। তখন দেবতারা শিবের শরণে গেলেন। শিব যুদ্ধে নামার আগেই চাতুরীর আশ্রয় নিলেন। পায়ের আঙুল দিয়ে জলের ওপর একটি বিশাল চক্র এঁকে জলন্ধরকে বললেন যে, যদি সেই চক্র জলন্ধর জল থেকে তুলে আনতে পারেন, তাহলেই প্রমাণ হবে জলন্ধর প্রকৃত বীর। প্রকৃত বীরের সঙ্গে ছাড়া তিনি যুদ্ধ করেন না। তাঁর এই কথায় জলন্ধর নিজেকে বীর প্রমাণ করতে সেই চক্র জল থেকে কাঁধে করে তুলে আনতে গেল। চক্রটি বরফের মতো কঠিন হয়ে জলের ওপর ভাসছিল, যেই জলন্ধর সেটি নিজের কাঁধে তুলল, অমনি শিবের মায়ায় তা সুবর্ণময় হয়ে বন বন শব্দে ঘুরতে শুরু করল প্রচণ্ড গতিতে। তাতেই কন্ধকাটা হয়ে জলন্ধর মারা গেল। জলন্ধরকে দেব-মানব-দানব কেউই হত্যা করলেন না, অথচ সে মারা গেল। এতে ব্রহ্মার বরও বজায় থাকল, জলন্ধরের হাত থেকে ত্রিলোক রক্ষাও পেল।
জলন্ধরের মৃত্যুর পর ‘ধুন্ধু’ নামের এক অসুর আবার ত্রিলোক জয় করে অশান্তি শুরু করল। দেবতাদের অনুরোধে তাকে বধ করতে রাজি হলেন বিষ্ণু। কিন্তু এবার যুদ্ধে যাওয়ার আগে শিবের আরাধনা শুরু করলেন তিনি। একশো আটটি পদ্মের অভাবে নিজের পদ্মের মতো চোখ নিবেদন করে পুজো সম্পূর্ণ করলেন। তাতে শিব অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে যুদ্ধজয়ের বর তো দিলেনই; সেই সঙ্গে চক্রাকার সুদর্শন অস্ত্রটি চিরদিনের জন্য তাঁকে দান করলেন। বলা বাহুল্য, সেই অস্ত্রে অচিরেই ধুন্ধুকে পরাজিত করলেন বিষ্ণু। এবং সেই থেকে তাঁর বিশেষ অস্ত্র হয়ে উঠল ‘সুদর্শন’।
অতীতের স্মৃতি থেকে বর্তমানে ফিরলেন বিষ্ণু। সুদর্শনের তীব্র স্বননে সচকিত হলেন তিনি। দেখলেন, আহ্বান শুনে সুদর্শন তাঁর অঙ্গুলি অলংকৃত করে হাজির হয়েছে। সতীকাঁধে তাণ্ডবনৃত্যে মগ্ন শিব, ভীত-সন্ত্রস্ত চরাচরের আর্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে ঘূর্ণায়মান সুদর্শন হাতে হঠাৎ-ই তাঁর মনে হল, হ্যাঁ, এক বিস্তৃত লীলাময় পটভূমি রচনার জন্যই ভগবান শিব এই অস্ত্র তাঁকে দান করেছিলেন।
অনুভবের এই বৃত্তে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু আর কালবিলম্ব করলেন না। শিবের সেই ইপ্সিত লীলা সম্পূর্ণ করতেই অঙ্গুলি থেকে সুদর্শনকে মুক্ত করলেন। সুদর্শন দুরন্তগতিতে ঘুরতে ঘুরতে একে একে ছিন্ন করল সতীর প্রতিটি প্রত্যঙ্গ, তাঁর অলঙ্কারসমূহ। ছিন্ন অংশগুলি পতিত হল আদি ভারতবর্ষের চতুঃসীমার নানান প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে।
একসময় সতীশূন্য হলেন মহাদেব, তাঁর স্কন্ধ রিক্ত হল। তখন তাঁর নৃত্য থামল। থামল চরাচরের আর্তরব। নেমে এল এক নিঃসীম শূন্যতা। শিব স্থির হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে বসে পড়লেন ভূমিতে। শরীরের সমস্ত উদ্দামতা থেমে গিয়ে মনের ভেতর জমে উঠল এক নিদারুণ শোক। এতক্ষণে হৃদয়ের একূল-ওকূল ভাসিয়ে শোকধারা যেন প্রবাহিত হল তাঁর দুই নয়ন বেয়ে। ‘সতী!—আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। বেরিয়ে এল বুকফাটা হাহাকার, হে প্রিয় বিষ্ণু, তুমি আমার সতীকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলে! হায় সতী, তুমি কোথায় গেলে! ছেড়ে গেলে, একেবারেই ছেড়ে চলে গেলে!—শিবের বিলাপের কিছুতেই যেন আর অন্ত রইল না।
এই অবস্থায় বিষ্ণু আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি শিবের পাশটিতে এসে বসলেন। তারপর আলতো করে তাঁর হাতের ওপর হাত রাখলেন। সান্ত্বনার স্পর্শ দিলেন। ধীরে বললেন, হে প্রিয় শিব, হে স্বয়ম্ভু, তুমি তো সবই জানো, সবই তো নির্ধারিত, এই যে এখন তোমায় সান্ত্বনা দিচ্ছি, এও তো তোমারই লীলা! তাই হে লীলাময়, তুমি শান্ত হও। সতীকে আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিইনি। দেবী সতীর একান্নটি দেহখন্ড যে যে স্থানে পড়েছে, অচিরে সেই-সকল স্থানই দেবী আদ্যাশক্তি সতীর জাগ্রত ‘পীঠ’ হিসেবে ভক্তদের পরম প্রিয় হয়ে উঠবে। আর প্রতিটি পীঠেই ভিন্ন ভিন্ন নামে তুমি থাকবে ভৈরব হয়ে। এবার দেখলে তো, সতী তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাননি, আমিও তাঁকে দূরে সরিয়ে দিইনি; বরং দেবী চিরদিনের জন্য তোমার হ্লাদিনী হয়েই রয়ে গেলেন, আর তুমি হয়ে রইলে তাঁর আত্মা। এবার খুশি তো!
বিষ্ণুর কথা শুনতে শুনতে শিব শান্ত হয়েছিলেন। এবার খানিক চুপ থেকে কী যেন ভাবলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ প্রিয় বিষ্ণু, তুমি ঠিকই বলেছ কায়িক বিচ্ছেদ আসলেই আমাদের আত্মিক নৈকট্য দিয়েছে। আত্মাই সর্বময়, আত্মাই অনন্ত। তাই হে বিষ্ণু, এ মিলন, এ নৈকট্য আনন্দের তো বটেই। তবে এ আনন্দ শুধু আমার নয়, সমস্ত ভক্তের হোক। পীঠ পরিক্রমায় দেব-দানব-মানব সকলেই পাবে সেই আনন্দের ভাগ। পীঠ হয়ে উঠবে আনন্দময় সাধনক্ষেত্র। সেখানে সাধনপথে দেবীকে পেয়ে মুক্ত হবে সকলে। দেবী এখানে সকলের জন্য উন্মুক্ত হবেন। পীঠ হবে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চতুর্বর্গের প্রথম তিনটির মুক্তিক্ষেত্র, চতুর্থটির আহরণক্ষেত্র…
শিবের এই পুণ্যইপ্সার কথা শুনে ত্রিলোক জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল স্বয়ম্ভূ শিবের নামে, দেবী সতীর নামে, একান্নপীঠের উদ্দেশ্যে। বেজে উঠল শঙ্খ, মঙ্গলধ্বনিতে ভরে উঠল চরাচর। সেই আনন্দময় আবহের মধ্যেই সকলে স্ব স্ব লোকে ফিরে গেলেন। অন্যদিকে এর সঙ্গেই ত্রিলোকের পুণ্য ও মোক্ষকামীদের শুরু হয়ে গেল একান্নপীঠযাত্রা…
একান্নপীঠের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তন্ত্রগ্রন্থ, পুরাণ ও উপপুরাণের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। যেমন, ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে শুধুমাত্র চারটি আদিপীঠের কথা পাওয়া যায়। ‘কালিকা পুরাণ’-এ পীঠের সংখ্যা সাতটি। ‘কুব্জিকাতন্ত্র’ গ্রন্থে পীঠের সংখ্যা বেয়াল্লিশ, ‘জ্ঞানার্ণবতন্ত্র’ গ্রন্থে পঞ্চাশ, ‘পীঠনির্ণয়’ গ্রন্থে একান্ন, ‘শিবচরিত’ গ্রন্থে একান্নপীঠ ও ছাব্বিশটি উপপীঠের পরিচয় পাওয়া যায়। পণ্ডিতদের মতে, প্রাচীন গ্রন্থে পীঠসংখ্যা অল্প ছিল, অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে লেখা গ্রন্থাবলীতে পীঠের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
আসলে, ধর্ম দিয়ে সম্প্রদায়কে এক করার কৌশল বড় প্রাচীন। হিন্দুদের পাঁচটি উপাসক সম্প্রদায়—শাক্ত, সৌর, শৈব, গাণপত্য ও বৈষ্ণব—যখন যে সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি বেড়েছে, তাঁরাই মন্দির, পীঠ ও তীর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে সারা ভারতব্যাপী নিজেদের প্রতিপত্তি বিস্তারের মধ্য দিয়ে সকলকে সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। দেশব্যাপী আপন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন প্রদেশের ভক্তদের মিলনক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছেন। পীঠগুলিই সেই মিলনক্ষেত্র। তাই আমরা ভারতজুড়ে দ্বাদশ জ্যোতিরলিঙ্গ শিবতীর্থের সমারোহ দেখতে পাই, পাই ভারতব্যাপী বিষ্ণুতীর্থের সন্ধান।
শক্তি উপাসনার ক্ষেত্রে উত্তর-দক্ষিণ ও পুব-পশ্চিম ভারতের শাক্তসম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যাতে মেলবন্ধন বাড়ে, প্রচার বাড়ে; তারই জন্য প্রথমে মাহাত্ম্যময় পীঠের সংখ্যা অল্প থাকলেও পরে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারই জন্য অর্বাচীন পুরাণে বিষ্ণু কর্তৃক দেবীর দেহ একান্নখণ্ড বা তার বেশি করার কাহিনি ক্রমে ক্রমে রচনা করা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পীঠের পরিমাণ একান্ন হলে ভারতবর্ষের বিস্তৃত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও শাক্তসম্প্রদায়ের তীর্থের আওতায় আনা যায়, তাই সতীর একান্নটি দেহখন্ডের বৃত্তান্ত। সত্যি বলতে কী, প্রাচীন পুরাণে সতীর দেহত্যাগ ও দেহবিখন্ডীকরণের কোন কাহিনি নেই।
যাই হোক, আমরা ‘পীঠনির্ণয়’-কে আদর্শ ধরে আপনাদের শোনাব একান্নপীঠের ইতিহাস ও মাহাত্ম্যের কথা। পরের পর্বে নিয়ে আসছি প্রথম পীঠ হিংলাজের দেবী হিঙ্গুলার কাহিনি ও ইতিহাস…
[দেবী হিঙ্গুলার কাহিনির পড়তে চোখ রাখুন আগামি মঙ্গলবার, পরের পর্বে।]
কাহিনিসূত্রঃ
শিব পুরাণ
লিঙ্গ পুরাণ
কালিকা পুরাণ
এবং,
লৌকিক কাহিনি