গুরুশিষ্য পরম্পরায় বোপদেবের কাহিনি

বৈদিক যুগ থেকেই শিক্ষাদাতা ও শিক্ষাগ্রহীতার মধ্যে গুরুশিষ্যের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কই আবার শাস্ত্রমতে হয়ে ওঠে পিতা-পুত্রের বন্ধন।

 

শাস্ত্রে 'জন্মদাতা', 'ভয়ত্রাতা', 'কন্যাদাতা', 'বিদ্যাদাতা' বা 'দীক্ষাদাতা' ও 'অন্নদাতা'—এই পাঁচজন পিতার কথা বলা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে পঞ্চপিতার মধ্যে গুরু বা শিক্ষাদাতাও একজন। সেকালে দীক্ষাই বলুন বা শিক্ষা, তা দান করাই ছিল গুরুর কর্তব্য।

 

আসলে, পিতারা সেকালে ছিলেন বেশ রাশভারী মানুষ, কঠোর শাসক। সংসারে তাঁরা শাসন করেই শিক্ষা দিতেন। তাই ধীরে ধীরে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও পিতৃসুলভ শাসনভার উঠে এসেছিল গুরু-শিক্ষকের হাতে।

 

গুরু-শিক্ষকের দোষ কী, টোলযুগে গেরস্ত প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন যে, পণ্ডিতের প্রহার না-খেলে বিদ্যে হয় না! তাই টোলে (পরবর্তীকালের স্কুল-যুগেও) ছেলেকে পড়তে দিতে এসে কর্তারা বলে যেতেন, মাথা আর মুখ বাঁচিয়ে মারতে।

 

এমন ঢালাও ছাড়পত্র পেয়ে স্বভাবদোষে অনেক গুরু-পণ্ডিত ছাত্রকে এমন মার মারতেন যে, একেবারে কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ছাড়তেন! সেই জ্বালায় বিদ্যাসাগরমশাইয়ের বাবা ঠাকুরদাসমশাই ছেলেকে মারকুটে পণ্ডিতের টোল থেকে ছাড়িয়ে তুলনায় শান্তশিষ্ট এক পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করেছিলেন।

 

যাই হোক, এখন অবশ্য মারামারির পাঠ উঠে প্লে-স্কুলের কনসেপ্ট চালু হয়েছে এদেশেও। বাড়িতে বাবারা বন্ধু, স্কুলে স্যারেরাও। শাস্ত্রীয় পঞ্চপিতার চরিত্রও হয়েছে এখন একেবারে একালের ছাঁচে ঢালা। তবে তখনই বলুন বা এখন—কোন শিক্ষাব্যবস্থাই আপামর সকলের জন্য সাম্যবাদী-সুবিধের নয়। হতেও পারে না।

 

যা বলছিলাম, টোল-যুগের শিক্ষাব্যবস্থায় শাস্তি যেমন ছিল, অনেক ক্ষেত্রে তার মধ্যেও শিষ্যের প্রতি গুরু-পণ্ডিতের ভালোবাসাও ছিল। এমনই একটি ঘটনার কথা জানা যায় দ্বাদশ শতকের প্রসিদ্ধ মারাঠি পণ্ডিত ও ব্যাকরণ রচয়িতা বোপদেবের জীবনী থেকে—

আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগের কথা।

 

টোলের গুরুমশাই পণ করলেন কোবরেজের ছেলে বোপদেবকে ব্যাকরণ শেখাবেনই শেখাবেন! কিন্তু, প্রাণপণ চেষ্টা করেও পণরক্ষার কোন উপায় করে উঠতে পারলেন না।

 

কারণ, ক'মাস ধরে নাগাড়ে বাবা-বাছা করে, বেত্রপাণি হয়ে, মানহানি করে, এমনকি দানাপানি বন্ধ করেও কিছুতেই পানিনির ব্যাকরণসূত্র বোপদেবের মুখস্থ-কণ্ঠস্থ-আত্মস্থ কোনটিই করাতে পারলেন না। আসলে, বোপদেব এমন নিরেট যে, পড়াশুনোর কিচ্ছুটি মনে রাখতে পারেন না।

 

ফলে, গুরুমশাই একদিন হতাশ হয়ে হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। স্বভাবতই হতাশায় দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন এবং ফুঁসতে ফুঁসতে ছড়ি ধরলেন। তারপর মারাত্মক মারতে মারতে টোল থেকে বোপদেবকে একেবারে ঘাড় ধরে বের করে দিলেন। বললেন, হতভাগা আহাম্মক, ফের যদি এই টোলের চৌকাঠ মাড়াস, তোর একদিন কি আমারই একদিন! দূর হ চোখের সামনে থেকে, দূর হ!

 

বিতাড়িত হয়ে মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলেন বোপদেব। চোখে জল এল। মনে খুব দুঃখ হল। সেই দুঃখে আপন মনে চলতে চলতে তিনি পৌঁছে গেলেন একটি বাঁধানো পুকুর ঘাটে। ঘাটের সিঁড়িতে বসলেন। বসে তাঁর ভারি অনুশোচনা হতে লাগল।

 

বোপদেব মনে মনে বললেন, গুরুমশাই ঠিকই বলেছেন, আমি আহাম্মক, আমি হতভাগা! বুদ্ধি আমার একটুও নেই। গুরুমশাই বা পিতা কারও সম্মান রাখতে পারলাম না, আমি এমন হতভাগ্য! আমি এমন আহাম্মক যে, ব্যাকরণের একটা সূত্রও মনে রাখতে পারি না! অথচ, প্রাণপণে মনে রাখতেই তো চাই। কিন্তু, কী করলে মনে থাকবে সেটাই যে কিছুতে বুঝতে পারি না!

 

এই সব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তাঁর চোখ গেল ঘাটের শেষ ধাপে থাকা চ্যাপ্টা এক পাথরের ওপর গড়ে ওঠা একটা প্রগাঢ় গোল দাগের দিকে। মনে প্রশ্ন জাগল, কেমন করে হল এই দাগ?

 

তাঁর মনে এই প্রথম জন্ম নিল কোন প্রশ্ন। তারপর মনই খুঁজতে লাগল তার উত্তর।

 

খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ তাঁর মনে হল, কতকাল ধরে কলসি কাঁখে আশপাশের সমস্ত গেরস্ত-মেয়েরা এই পুকুরেই তো পানীয় জল নিতে আসেন। জল নিতে এসে তাঁরা নিত্যদিন পেতলের কলসি নামিয়ে রাখেন এই পাথরটিরই ওপর। কলসির তলায় থাকে ধাতুর গোল-সরু বিড়ে, যাতে কলসি মেঝেতে ঠিকঠাক বসে। দিনের পর দিন সেই বিড়ের ঘষা লেগে লেগে পাথরের ওপর ওই গোল দাগ হয়ে গেছে।

 

কারণটা এভাবে খুঁজে ফেলতেই বোপদেবের মনের মধ্যে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক মেরে গেল। নিরেট পাথরের বুকে দিনের পর দিন যদি ঘষা লেগে দাগ হতে পারে, তাহলে বার বার পাঠ করে আমিই বা পড়া মনে রাখতে পারব না কেন? আমি কি পাথরের চেয়েও নিরেট!

 

উপলব্ধির এই স্তরটিতে পৌঁছতেই বোপদেবের যেন নবজন্ম হল। অপমান থেকে আত্মসমীক্ষা, ক্ষণিকের দেখা থেকে দর্শন—সব মিলিয়ে বোপদেবের চোখ খুলে গেল। নবদৃষ্টি নিয়ে প্রথমেই তিনি ছুটে গেলেন গুরুমশাইয়ের কাছে। গিয়ে বললেন তাঁর উপলব্ধির কথা।

 

শুনে গুরুমশাই অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ছাত্রের দিকে। এই তো চোখ খুলেছে, এই তো মনের বিস্তার ঘটেছে, মন ভাবতে শিখেছে—ভাবাতেই তো তিনি চেয়েছেন বার বার! সেই চিন্তনের পাঠ বোপদেব যদিও পেলেন প্রকৃতি থেকে, প্রকৃতিই যেন তাঁকে দীক্ষা দিল। তবুও গুরু হিসেবে তিনিই তো উপলক্ষ।

 

ভারি আনন্দ হল গুরুমশাইয়ের। সেই আনন্দে যে-পুত্রসম ছাত্রকে তিনি টোল থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তাকেই জড়িয়ে ধরলেন গর্বিত বুকে।

 

তারপর, প্রকৃতির দীক্ষা অন্তরে রেখে গুরুমশাইয়ের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে বোপদেব কালক্রমে হয়ে উঠলেন পরম পণ্ডিত।

 

বোপদেবের কাছে একদা যে-ব্যাকরণশাস্ত্র ছিল একেবারে দুর্বোধ্য, সেই শাস্ত্রের সূত্রগুলি নিয়েই তিনি একদিন রচনা করলেন সহজ-সরল একটি ব্যাকরণ।

 

সেই ব্যাকরণ পড়ে সকলেই যাতে সহজে বুঝে ফেলতে পারে ব্যাকরণের সূত্র, অনায়াসেই তা মনে রাখতে পারে; সেদিকেই তিনি জোর দিলেন। এই একটি গ্রন্থের জন্যই ভাষাসাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে রইলেন। তাঁর সেই গ্রন্থটির নাম, ‘মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ'।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...