আজ কালীকথায় আমরা উত্তরবঙ্গে পাড়ি দেব। মালদহের প্রখ্যাত গোবরজনা কালী মন্দিরের কথাই জানাবো আপনাদের। মালদহ জেলার কালীপুজোগুলোর মধ্যে প্রাচীনত্ব, ঐতিহ্যের দিক থেকে মালদার গোবরজনা কালী পুজো জেলার প্রথম সারিতেই স্থান। সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ভিতরে, পাকুরিয়া থানার অন্তর্গত রতুয়া ২নং ব্লকের আড়াইডাঙ্গা অঞ্চলের গোবরজনা গ্রামের কালী পুজো। যা মালদবাসীর কাছে গোবরজনা কালীপুজো নামে পরিচিত। এই গোবরজনা কালী পুজো হল বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যপূর্ণ কালী পুজো।
মালদহ জেলার কালী মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হল গোবরজনা কালী মন্দির। প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই গোবরজনা কালী মন্দির। এই পুজো দেখতে কাতারে কাতারে মানুষের সমাগম হয় এই পুজোয়। কেবল মালদহের মানুষেরাই নন, জেলার বাইরে রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে মানুষ এই পুজোয় অংশগ্রহণ করতে আসেন। মানত করেন নিজেদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে ফের পুজো দিতে আসেন পরের বছর। ভিন রাজ্যের লোকেরাও আসেন, ঝাড়খন্ড, বিহার, এমনকি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল থেকেও বহু মানুষ আসেন পুজো দেখতে। এই মাতৃ প্রতিমা ভীষণ জাগ্রত বলেই প্রচার রয়েছে। বহু জনশ্রুতি, বহু অলৌকিক কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে গোবরজনা কালী পুজোর সঙ্গে।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই গোবরজনা কালীপুজো ডাকাতদের সৃষ্টি। ডাকাতদের দেবীই আজ সর্বজনীন। স্থানীয় ডাকাতদের হাতেই একসময়ে মা পুজো পেতেন। এ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে মালদহে, যা এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। কথিত রয়েছে, ডাকাতরা নাকি ডাকাতির আগে ও পরে শক্তির আরাধনায় ব্রতী হতেন, সেই সময় থেকেই গোবরজনার কালীন্দ্রী নদীর তীরে মা কালীর পুজো আরম্ভ হয়। পরবর্তীতে সেই পুজো দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঐ এলাকার চৌধুরী পরিবার। নিয়ম রীতি মেনেই সেই কালী মায়ের পুজো চালিয়ে যান জ্যোতিষ চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। বংশ পরম্পরায় চার শতকের অধিক সময় যাবৎ এই পুজো চলে আসছে।
আবার অন্য একটি মতে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে চৌধুরী বংশের কোনও এক পুরুষ মায়ের পুজোর প্রচলন করেছিলেন। সেই পুজো এখন আর কেবল চৌধুরী বংশেরই নয়, মালদবাসীর কাছে তা এখন সর্বজননীন পুজার আকার ধারন করেছে।
এক সময় ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল গোটা এলাকা। পাশে বয়ে চলেছে মরা কালীন্দী নদী। জনশ্রুতি রয়েছে, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ঐতিহাসিক চরিত্র ডাকাত ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী এই মায়ের পুজা শুরু করেছিলেন। দেবী চৌধুরাণী উত্তরবঙ্গেরই কাহিনী, কালীন্দী নদী দিয়ে দেবীর বজরা যাতায়াত করত।
একদা মালদা শহরের উপর বয়ে চলা কালীন্দী (আদপে নাম কালীন্দ্রী) নদী ছিল গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর সংগমস্থল, এই জলপথেই তৎকালীন জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল। কালীন্দী নদীর তীরবর্তী দুই পাড় ভয়ংকর ঘন গহন অরন্যে ঢাকা ছিল। ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী একবার উত্তরবঙ্গের আধিপত্য বিস্তার করতে, বজরায় চেপে উত্তরবঙ্গের দিকে যাত্রা করছিলেন। সেই সময় তাঁদের সাথে লেঠেল ও ডাকাতের দল ছিল।
কিন্তু হঠাৎ তাঁদের বজরা এই কালীন্দী নদীর কাছে এসেই আটকে যায়। কোনমতেই বজরা মুক্ত করতে না পেরে, তাঁরা স্থির করেন রাতটা সেই বনেই কাটিয়ে পরদিন যাত্রা করবেন। এই ভেবেই অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে সেখানে রাত্রিবাস করেন তাঁরা।সেই রাতেই কালী মা ভবানী পাঠককে স্বপ্নে দেখা দিলেন।
তাঁর মৃন্ময়ী মুর্তি গড়ে কালীন্দী তটে বনের মাঝে পুজা করতে বলেন। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ভবানী পাঠক পরদিন সকালে কালীন্দী তটের মাটি দিয়ে মৃন্ময়ি মাতৃমুর্তি গড়ে পুজোর প্রস্তুতি শুরু করেন। ডাকাতেরা কালী আরাধনা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। উদয় হয় এক সমস্যা, সেখানকার মাটি বালিমাটি হওয়ায় কিছুতেই মূর্তি গড়া যাচ্ছিল না। তাই কতকটা বাধ্য হয়েই, বালিমাটির সাথে গোবর মিশিয়ে ভবানী পাঠক মা কালীর মূর্তি গড়ে ফেলেন, শুরু হয় মায়ের পুজো।
কথিত আছে, ভবানী পাঠক নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে এই কালীকার পুজা করেছিলেন। বলা হয়, সেই থেকেই এই মায়ের নাম হয়ে যায় গোবরজনা কালী ও স্থানের নাম প্রচারিত হয়ে যায় গোবরজনা নামে। এই মায়ের পুজা সম্পন্ন করে কালীন্দী নদীতে মুর্তি বিসর্জন দিয়েই তাঁরা উত্তরবঙ্গ অভিযানে যাত্রা করেছিলেন।
তবে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রমান না থাকায়, এই জনশ্রুতি অনেকেই মানতে নারাজ। অনেকের মতে, তৎকালীন বিহার ও ঝাড়খন্ড সীমান্ত থেকে বাংলায় ঢুকে পড়া কিছু দস্যু ও ডাকাতেরা ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলে, এবং তারাই এই গভীর জঙ্গলে মা কালীর আরাধনা করে ডাকাতি করতে যেতেন। অনেকের দাবি অনুযায়ী, ভবানী পাঠক আসার অনেক আগে থেকেই এখানে কালীর পুজো হয়ে আসছে। শোনা যায়, রতুয়ার গোবরজনা কালী মন্দিরের পুজো নাকি রাজপুতদের হাতে শুরু করা। সাড়ে তিনশো বছর আগে গোবরজনাসহ সংলগ্ন জঙ্গলে ঘেরা গ্রামগুলিতে রাজপুতদের বাস ছিল।
তাঁরাই ঘন জঙ্গলে মন্দির স্থাপন করে কালীপুজো শুরু করেন। এখন সেই পুজোর দায়িত্ব রয়েছেন সুধাংশু চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। কিন্তু পারিবারিক হলেও এই পুজো সর্বজনীনতার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ। পরিবর্তীকালে মায়ের স্বপ্নাদেশ পান চৌধুরী বংশের জনৈক পুর্বপুরুষ, সেই থেকে চৌধুরী পরিবার মায়ের পূজার্চনা করে আসছে। এখন চৌধিরী বাড়ির অঙ্গনে মায়ের মৃন্ময়ি মাতৃপ্রতিমা তৈরি হয়। সেখানেই মূর্তিতে রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। তারপর সাজসজ্জায় সজ্জিতা হওয়ার পরে, দেবীকে কাঁধে করে মন্দিরে নিয়ে আসেন ভক্তরা, সাথে ডাক ঢোল শাঁখ কাসর বাজিয়ে মহাসমারোহে মাকে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। প্রতিমার আগমনের সময় রীতি মেনে বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া হয়।
মাতৃ প্রতিমা এখানে বেশ ভয়ংকর রণরঙ্গিনী, মা রণোন্মত্তা, মায়ের দুপাশে দুই সখী ডাকিনি যোগিনী। ভয়াল দর্শনা, বিকটদশনা দেবীর মূর্তি মনে ভাব ভয় ও ভক্তির সমসঞ্চার করে।
কালীন্দী নদী থেকে দেবীর ঘটের জল নিয়ে এসে, কার্তিক অমাবস্যা নিশ্চিতে মধ্যরাতে দেবীর পুজো শুরু হয়। ভোর পর্যন্ত চলে দেবীর পুজো হোম,পুষ্পাঞ্জলি। পুজো শেষে শুরু হয় ছাগবলিদান পর্ব। রক্তে ভেসে যায় মন্দির প্রাঙ্গন, পরদিন বিকেল পর্যন্ত চলে বলিদান পর্ব। সবশেষে মহিষ বলি দিয়ে বলিপর্ব সমাপ্ত হয়।
এই পুজো উপলক্ষ্যে পাঁচ হাজারেরও বেশি ছাগ বলি দেওয়া হয়। ভক্তদের অনেকেরই বিশ্বাস, মন্দির থেকে বলির রক্তের স্রোত মরা কালীন্দ্রী নদীর জলে মেশার পরই, 'তুষ্ট' হন মা কালী। পুজো উপলক্ষ্যে কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। মুসলমানেরাও এই পুজোতে অংশগ্রহণ করেন, সাম্প্রতিক ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্যেও এই পুজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অন্যতম নজির। এই পুজোর সময় গোবরজনা গ্রামজুড়ে মেলা বসে। চতুর্দশীর দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বেচাকেনা।
ঢাকের বাদ্যি আর জয়মা ধ্বনিতে মুখরিত থাকে মন্দির প্রাঙ্গন, তারপরই শুরু হয় মায়ের বিসর্জনের প্রস্তুতি। পরদিন সন্ধায় দেবীর বরনের পর মহাসমারোহে ফের ভক্তদের কাঁধে চড়ে কালী প্রতিমা চলে কালীন্দী, কালীন্দী নদীতেই প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।
পুজার দুইদিন মন্দির প্রাঙ্গনে বসে সুবিশাল মেলা। ভক্ত দর্শনার্থীদের ভিড়ে গোবরজনা কালীক্ষেত্র পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, কেবল কার্তিক অমাবস্যাতেই নয়, এইখানে প্রতি অমাবস্যাতেই মায়ের পুজো চলে। এছাড়া পয়লা বৈশাখে ব্যবসা ও পরিবার পরিজনের মঙ্গল কামনায় বহু মানুষ গোবরজনা মা কালীর মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।
মালদাবাসীর কাছে গোবরজনা মা কালীর পুজার আকর্ষণই আলাদা, ভক্তদের মনস্কামনা পূরণের দেবী রূপে মা কালী পূজিতা হন। তবে একথা স্পষ্ট যে, গোবরজনা কালী বহু প্রাচীন কাল থেকেই উত্তরবঙ্গে স্বমহিমায় বিরাজ করছে।
ডাকাতরাই শক্তির আরোধনার জন্য এই অঞ্চলে মা কালীর পুজো শুরু করেন। প্রায় ৩৫০ বছর ধরে এই ডাকাতের হাতে শুরু হওয়া এই পুজো আজও একই রীতি, নীতি, রেওয়াজ, মেনে হয়ে আসছে। সে সময় সমগ্র এলাকা ঘনজঙ্গলে ঢাকা ছিল। ঘনজঙ্গলে হিংস্র পশুও বাস করত। তাই মানুষের আনাগোনাও কম ছিল।
সেই সুযোগে বিহার থেকে একদল রাজপুত নদীপথে এসে এখানে বসবাস শুরু করে। এই রাজপুতদের পেশা ছিল ডাকাতি। এখান থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতি চালাত। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ও ডাকাতি করে ফিরে এসে শক্তির আরোধনার জন্য মা কালীর পুজো করতেন ডাকাতরা। কার্তিক মাসে ডাকাতেরা নিজেরাই মায়ের প্রতিমা তৈরি করে পুজো করত। আজ জঙ্গল আর নেই, হিংস্র জন্তু জানোয়ারের দাপট নেই, ডাকাত নেই। গ্রাম জনপদ গড়ে উঠেছে।
এলাকার এক চৌধুরী পরিবার বংশপরম্পরায় এই পুজো করে চলেছেন। জ্যোতিষ চৌধুরীর পৌত্ররা বংশ পালা করে এই পুজো করে আসছেন। চৌধুরী প্রতিবারের দান করা দেড় বিঘা জমির উপরেই মায়ের স্থাপিত মন্দির হয়েছে। মাঝে চলে গিয়েছে কয়েকটি শতাব্দী। আজও ইতিহাসের সেই সব দিনের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে গোবরজনা কালীপুজো।