একবার শত বর্ষ ব্যাপী প্রবল অনাবৃষ্টি শুরু হলে মহর্ষি গৌতম জলদেবতা বরুণ দেবের তপস্যায় মগ্ন হন। বরুণদেব তখন মহর্ষি গৌতমকে দর্শন দিয়ে গর্ত খনন করতে বললেন। মহর্ষি গৌতম গর্ত খনন করলে বরুণ দেবতা তা জলে পূর্ণ করে সেই জল সদা অক্ষয় হওয়ার বরদান করেন। তারপর থেকে এই জলে নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম করতে শুরু করলেন গৌতম মুনি, তিনি সেখানে ফুল ফল ও খাদ্য শস্য উৎপন্ন করতে থাকলেন। এরপর সেখানে অন্যান্য ঋষিরাও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁরা সেখানে সুখে বসবাস শুরু করলেন। একদিন গৌতম মুনি তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে জল আনতে বললে ঋষি পত্নীরা বাধা দিলেন। তখন গৌতম মুনির পত্নী অহল্যা নিজেই জল আনতে গেলেন। ঋষি পত্নীদের বুঝিয়ে জল নিয়ে এসে গৌতমকে দিলেন। এরপর এই কাজ অহল্যা রোজই করতেন আর ঋষি পত্নীগণ ঈর্ষাবশত অহল্যাকে ভৎর্সনা করতেন, অহল্যা মধুর বাক্যে তাদের বোঝাতেন। এই ঋষি পত্নীগণ আবার তাদের স্বামীদের কাছে এসে রোজ মিথ্যে কথা বলতেন অহল্যার নামে। তারা বলতেন যে, "গৌতম মুনি পত্নী অহল্যা জলের জন্য আমাদের ভৎসর্না করেন আপনাদের জীবনকে ধিক!"
এরপর একদিন ঋষিরা মিলিত হয়ে বিঘ্নরাজের পুজো করলেন। বিঘ্ন রাজ গণেশ যখন আবির্ভূত হয়ে বর দিতে চাইলেন তখন তারা চাইলেন যে, হে দেব গণপতি যদি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে আমাদের এই বরদান করুন যাতে আমরা গৌতমকে তার আশ্রম থেকে বিতাড়িত করতে পারি। গণেশদেব তাদের অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন অন্য বর নিতে, কিন্তু তারা কোন কথায় কর্ণপাত করলেন না বাধ্য হয়ে গণপতি দেব তখন তাদের মনঃপুত সেই বর দান করলেন। ঋষিদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে কোনকিছুই জানতেন না মহর্ষি গৌতম। তিনি যখন নিত্যকর্ম করতে যাচ্ছিলেন তখন সেখানে ভগবান গাভীর রূপ ধারণ করে শস্য ভক্ষণ করছিলেন এই সময় গৌতম একটি গাভী শস্য খাচ্ছে দেখে তৃণ গুচ্ছ হাতে নিয়ে গাভীটিকে তাড়াতে যান কিন্তু সে তৃণগুচ্ছ গাভীর দেহে স্পর্শ করা মাত্র শীর্ণকায় গাভীটি গৌতমের সামনে পড়ে গিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। তখন ঋষিগণ ও তাদের পত্নীগণ তা দেখে গৌতমকে বলতে থাকেন," গৌতম তুমি এ কী কাজ করলে?"
গো হত্যা করার জন্য ঋষি ও ঋষি পত্নীগণ গৌতমকে ভৎসনা করে বললেন তোমার সকল তপস্যাকে ধিক, তোমার মুখদর্শন করাও পাপ। তুমি যতক্ষণ এই আশ্রম এ থাকবে ততক্ষণ দেবগণ, পিতৃগণ কেউই আমাদের প্রদত্ত কোন দ্রব্য গ্রহণ করবেন না। তোমার মুখদর্শন করলে আমাদের সমস্ত কর্মের হানি হবে। তাই তুমি সপরিবারে আশ্রম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাও। এই বলে তারা গৌতমকে লাঠি দিয়ে প্রহার করতে শুরু করলেন। এরপর গৌতম, অহল্যা সপরিবারে সেই আশ্রম ত্যাগ করে এক ক্রোশ দূরে গিয়ে এক স্থানে অবস্থান করতে শুরু করলেন।
একদিন ঋষি পত্নীগণ দূর থেকে তাকে দেখে বস্ত্র দিয়ে মুখ ঢাকলেন। গৌতম তাই দেখে অতিশয় দুঃখিত হয়ে ঋষিদের কাছে এসে বললেন, আপনারা দয়া করে আমাকে উপদেশ দিন যে আমি কী কার্য করে এই পাপের থেকে নিষ্কৃতি পাব? ঋষিরা প্রথমে বিদ্বেষবশত কোন কিছুর উত্তর না দিলেও পরে তার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ১১ বার ব্রহ্ম গিরি প্রদক্ষিণ করে শত কমল পূর্ণ জলে স্নান করবার পর দেবী গঙ্গাকে এখানে নিয়ে এসে তাতে স্নান করে কোটি শিবলিঙ্গের পুজো করলেই তোমার চিত্তশুদ্ধি লাভ হবে।
এরপর গৌতম মুনি যথাবিধি শিব পুজো করলেন দেবী অহল্যার সঙ্গে। দেবাদিদেব মহাদেব যখন তাঁকে দর্শন দিলেন তখন গৌতম মুনি প্রার্থনা করলেন," হে দেব শংকর তুমি নির্দয় হলেও তুমি পুরুষ ও প্রকৃতি। তুমি বিষ্ণু ও ব্রহ্মার পূজ্য ব্রহ্মস্বরূপ। হে দেব আমায় নিষ্পাপ করো।" তখন দেবাদিদেব মহাদেব বললেন-"হে মহামুনি তুমি ধন্য। তুমি কর্তব্যকর্ম করেছ। তোমার দেহ সত্যিই নিষ্পাপ। কেবল ঐ স্ত্রী পরায়ন ঋষিগণ তোমায় ছলনা করেছে। যারা তোমার ওপর এরূপ অত্যাচার করেছে তারা প্রায়শ্চিত্ত করলেও সিদ্ধিলাভ করতে পারবে না। তোমার মধ্যে যদি কোন পাপ সঞ্চার হয়ে থাকে তাহলে আমাকে দর্শন করার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিদূরিত হয়েছে। "এই বলে দেবাদিদেব মহাদেব ঋষিদের সমস্ত কাণ্ডের কথা গৌতমকে খুলে বললে গৌতম মুনি অবাক হয়ে বললেন, সেই ঋষিগণ ধন্য তারা আমার অশেষ উপকার করেছেন। তাদের কৃপায় আমি আপনার দর্শন পেলাম। তারা এই উপদেশ না দিলে কিন্তু আমি আপনার দর্শন পেতাম না। এরপর গৌতম মুনির কথায় দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন হয়ে বললেন," তুমি ধন্য তুমি উত্তম বর প্রার্থনা করো।" তখন গৌতম মুনি মনে মনে ভাবলেন যখন আমার পাপ পৃথিবীতে প্রচারিত হয়েছে তখন তা মুছে ফেলাই আমার উচিত। এই ভেবে তিনি মহাদেবকে বললেন, "হে দেবাদিদেব মহাদেব যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে আমাকে গঙ্গা প্রদান করুন"
দেবাদিদেব মহাদেব তখন গঙ্গাজল গৌতম মুনিকে দান করেন। দেবী গঙ্গা তখন আবির্ভূত হয়ে বলেন, "আমি এই ঋষিকে সপরিবারে পবিত্র করব বটে কিন্তু পরে আমি শংকরেই বিলীন হবো" অন্যদিকে দেবাদিদেব মহাদেব বলেন, "যতদিন কলি পূর্ণ না হয় ততদিন তুমি এখানেই থাকবে।" দেবী গঙ্গা ও সম্মত হলেন যে, যদি ভগবান শংকর পার্বতী সহ তার কাছে থাকেন তবেই তিনি কাশীতে অবস্থান করবেন। দেবী গঙ্গা এও বলেন যে, "আমি এই ছলকারী ঋষিগণকে পবিত্র করতে পারব না। তাদের মুখদর্শন করব না।" এরপর দেবগণ ও ঋষিগণ সেই তীর্থ কাশীতে উপস্থিত হয়ে গঙ্গা, ভগবান শংকর ও গৌতমকে পূজা করে আনন্দিত হৃদয়ে তাদের স্তব করতে শুরু করলেন। গঙ্গা দেবী ও দেবাদিদেব শংকর সেই স্তবে প্রসন্ন হয়ে তাদের বর প্রার্থনা করতে বললেন। তখন ঋষিগণ বললেন, হে দেবী, দেবাদিদেব, আপনারা যদি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তাহলে আপনারা এই স্থানে অবস্থান করুন। এই বর আমরা প্রার্থনা করি।
গঙ্গাদেবী বললেন, “তোমরা থাকতে আমার প্রয়োজন কী? তোমরাই তো পৃথিবীকে পবিত্র করো। আমি মহর্ষি গৌতমকে পবিত্র করে চলে যাব।” ঋষিরা তখন বললেন, “হে দেবী, আমাদের পবিত্র করবার জন্য আপনাদের এই স্থানে থাকতে হবে।”
তখন গঙ্গা বললেন, “ তোমাদের থেকে আমার বিশেষত্ব ও গুরুত্ব কীরূপে জানা যাবে?”
তখন দেবগণ ঋষিগণ নদী ও তীর্থ সকল বললেন, “হে দেবী আমরা ১১ বছর ধরে লোকের পাপক্ষালন করে মালিন্য প্রাপ্ত হই সেই মালিন্য ও পাপ স্খলনের জন্য সুর গুরু বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে গত হলে আপনার কাছে আমরা সকলেই আসব। তাই আমাদেরও লোকের হিতের জন্য আপনাকে ভগবান শঙ্করকে এই স্থানে থাকতে হবে। বৃহস্পতি যতদিন সিংহ রাশিতে থাকবেন ততদিন আমরা আপনাকে ত্রিসন্ধ্যা স্নান করে ও ভগবান শংকরকে দর্শন করে পাপমোচন করব এই বিষয়ে সন্দেহ নেই।"
তাদের এই প্রার্থনা শুনে দেবাদিদেব মহাদেব ও গঙ্গা দেবী সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। সেই দিন থেকে বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে গত হলে সকল তীর্থক্ষেত্র ও দেবগন সেখানে আগমন করে থাকেন। কেবলমাত্র বৃহস্পতির সিংহ রাশিতে অবস্থান কালে গঙ্গা, রেবা, গোমতী নদী ও গয়া ক্ষেত্রে গমন করলে ফল লাভ হবে অন্য কোথাও গেলে হবে না।
এইভাবে গৌতমী তটে মহাপাতকনাশন ত্র্যম্বক নামে বিখ্যাত জ্যোতির্ময় লিঙ্গ কেন অবস্থান করলেন তা আপনাদের বলা হলো।
এরপর সূত গঙ্গা দেবীর অবতরণ ও মাহাত্ম্য কথা বলতে শুরু করলেন আর সেই সব দুষ্ট ঋষিগণ যারা মহর্ষি গৌতমের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছিলেন তাদের কথাও তিনি বলেন। সূত বলতে থাকেন, “দেবগণ ও মহর্ষি গৌতমের প্রার্থনায় গঙ্গা দেবী স্বয়ং সেই ব্রহ্ম গিরি থেকে ভূতলে অবতীর্ণ হলেন। তার প্রবাহ উদুম্বর বৃক্ষের শাখা থেকে ভূতলে পতিত হলো তখন মহর্ষি গৌতম ও সমাগত সকলেই সেই গঙ্গা জলে স্নান করলেন। ওই প্রবাহ গঙ্গাদার নামে প্রসিদ্ধ হল”।
তবে সেই দুরাত্মা ঋষিগণ গঙ্গায় স্নান করতে এলে গঙ্গা অন্তর্হিত হলেন তা দেখে মহর্ষি গৌতম গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি অন্তর্হিত হবেন না। এরা সজ্জন হোক, দুর্জন হোক এদের জন্য আমি আপনার দর্শন লাভ করেছি”। তখন আকাশবাণী হলো," হে ঋষিশ্রেষ্ঠ গৌতম, এরা অতি দুর্বৃত্ত, তাপসবেশ ধারী অসাধু ব্যক্তি, আমি এদের মুখ দেখব না।"
গৌতম আবার বললেন,"হে মাতা আমার কথা শুনুন উপকারীর উপকার করাই মহত্ত্বের রীতি। ভগবান শংকর আপনাকে এইমাত্র বললেন যে," তুমি এই স্থানে থেকে সকলকে পবিত্র করো। এখন তার কথা পালন করা উচিত।" তখন আবার দৈববাণী হল, মহর্ষি তুমি সত্য কথাই বলেছ কিন্তু ওরা তোমার প্রতি যে অন্যায় ব্যবহার করেছে তার জন্য ব্রহ্ম্য গিরি পর্বতকে একশতবার প্রদক্ষিণ করে আগে ওদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তা না করলে ওরা কিছুতেই আমার অনুগ্রহভাজন হবে না। গৌতমের মুখে গঙ্গাদেবীর এই কথা শুনে সেই দুষ্ট ঋষিরা প্রদক্ষিণ করে প্রায়শ্চিত্ত করলো, পরে গৌতম গঙ্গা দেবীর আদেশে গঙ্গা দ্বারের নিম্নভাগে কুশাবর্ত নামে এক উত্তম তীর্থ নির্মাণ করলেন। সেখানে গঙ্গাদেবী আবির্ভূতা হলেন, এই তীর্থে স্নান করলে মানুষ মুক্তি লাভ করে।
মহাত্মা গৌতমের এইরূপ প্রভাব দেখে মহর্ষি গৌতম এর সাথে অন্যায় করা সেই ঋষিগণ ও ঋষি পত্নীগণ অনুতপ্ত হয়ে মহর্ষি গৌতম ও তার স্ত্রী অহল্যার স্তব করে গঙ্গায় স্নান করলেন। তারপর ত্র্যম্বকেশ্বরকে দর্শন করে পরমানন্দ লাভ করলেন। ত্র্যম্বকেশ্বর তীর্থে গঙ্গা স্নান মাহাত্ম্য সম্পর্কে শিব পুরাণে বর্ণিত আছে যে, এই তীর্থস্নান করলে অশেষ পূণ্য ফল লাভ হয়। আমরণ বারাণসীতে যে ফল হয় এই স্থানে প্রহর মাত্র বাস করলে সেই ফল লাভ হয়।
উল্লেখ্য, শিব পুরাণের 'জ্ঞান সংহিতা'র ষড়বিংশতি অধ্যায়ে মহর্ষি গৌতমের সঙ্গে ঋষিদের করা ছলনার কথা এবং দেবাদিদেবের তপস্যায় গঙ্গা আনয়ন করার কথা উল্লেখিত আছে আর জ্ঞান সংহিতার সপ্তবিংশতি অধ্যায়ে রয়েছে ত্র্যম্বকেশ্বর তীর্থে গঙ্গা স্নানের মাহাত্ম্য এবং ছলনাকারী ঋষিদের প্রায়শ্চিত্ত করার কথা বলা আছে।