সমগ্র বাংলা জুড়েই নানান জায়গায়, নানান নামে, নানান রূপে পূজিত হন মা কালী। তেমনই হলেন বর্ধমানের মা দুর্লভা কালী। বর্ধমানের প্রসিদ্ধ কালী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম লাকুড্ডি দুর্লভা কালী, প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দেবী এখানে পুজো পেয়ে আসছেন।
বর্ধমান পৌরসভার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এই মন্দির। দুর্গাপুজোর সময় এখানেই চারদিন ধরে মাকে দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। আবার কালীপুজোর সময় অর্থাৎ দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে রাতভর চলে মায়ের আরাধনা। এছাড়াও বৈশাখ মাসে যোগাদ্যা দেবীর পুজো হয়। আর প্রতিদিনের নিত্যপুজো তো আছেই। এখানে আজও নিত্য পূজার পাশাপাশি দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়।
মন্দির প্রতিষ্ঠার পরে পেরিয়ে গিয়েছে তিন তিনটি শতাব্দী, আজও বর্ধমান শহর লাগোয়া লাকুড্ডিতে দুর্লভা কালী মাকে নিয়ে ঘিরে রয়েছে একাধিক রহস্য। কখনও দুর্গা, কখনও চণ্ডী আবার কখনও বিপত্তারিণী রূপে পূজিতা হন দেবী। কালী, দুর্গা, চণ্ডী অথবা বিপত্তারিণী; বছরভর বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন নামে দেবী পূজিত হলেও, সব দেবীরই পুজো হয় একই মূর্তিতে। তবে দীপাবলিতেই এই মন্দিরে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পুজো করা হয়। প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। মানুষ ভিড় করে ভোগ খান। কথিত আছে সাধক কমলাকান্তও এখানে তন্ত্র সাধনা করতে আসতেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই দেবী মায়ের দর্শন পাওয়া অতি দুর্লভ, তাই দেবীর অপর নাম দুর্লভা কালী। এই কালীমন্দিরে ঘটের আবাহন বা বিসর্জন নেই। ঘট ছাড়াই শুধু বিগ্রহের নিত্য পূজা হয় এই কালী মন্দিরে। তবে একটি প্রস্তর খন্ডও পূজিত হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, জনৈক এক তান্ত্রিক গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী এই অঞ্চলেরই (এখন যেখানে মন্দির রয়েছে তার পাশে) এক জলাশয়ে স্নান করতে নেমে একটি পাথর পান। সেই পাথরকেই তিনি মা কালী রূপে পুজো করতেন। সেই পাথর খণ্ড প্রতিষ্ঠিত হয় রাজার তৈরি করে দেওয়া মন্দিরে। পরে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও আজও সেখানে সেই পাথর খণ্ড সামনে রেখেই পুজো করা হয়। এই মন্দিরে বিসর্জন নেই। বর্ধমানরাজের দান করা জমিতে, তাঁর অর্থানুকুল্যেই গড়ে উঠেছিল এই মন্দির। বর্ধমানের রাজারাই এই মন্দিরে ভোগঘর তৈরি করে দেন। তাঁরাই পুজোর ব্যয়ভার বহন করতেন।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রায় আড়াইশো-তিনশো বছর আগের কথা এই অঞ্চলে তখন চারদিকে ঘন জঙ্গল। একদা গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক সন্ন্যাসী ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গল ঘেরা লাকুড্ডিতে এসে হাজির হন। শুরু করেন মা কালীর আরাধনা। এক দিন গোকুলানন্দ স্থানীয় পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে তাঁর পায়ে একটি পাথরে ঠেকে। তিনি ওই পাথর টিকে তুলে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন। এক দিন মা দুর্লভা গোকুলানন্দকে স্বপ্নাদেশ দেন। তাকে প্রতিষ্ঠা করে পুজোর সূচনা করতে বলেন। সন্ন্যাসী গোকুলানন্দ তার পরেই লাকুড্ডি জঙ্গলে মা দুর্লভার আরাধনা শুরু করেন। প্রথমে তালপাতার ছাউনি করে মা দুর্লভা কালীর আরাধনা শুরু করেন।
সেই পুজো শুরুর পর, ওখানেই কালী সাধনা করতেন তান্ত্রিক গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী। লোকমুখে তাঁর নানান অলৌকিক ক্ষমতার কথা তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা বর্ধমান জুড়ে। গোকুলানন্দের সাধনা ও বিভিন্ন দৈবী শক্তির রাজার কানে পৌঁছায়, সেই ক্ষমতার কথা শুনেই একদিন রাত্রে শিকার ফেরত বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদ মন্ত্রী-পারিষদের নিয়ে সেখানে গেলেন, তান্ত্রিককে পরখ করতে।
মহারাজ তান্ত্রিকের অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে চান তাঁর কাছে। তান্ত্রিক গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারীও বুঝে গিয়েছিলেন যে, রাজা তাঁর ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে এসেছেন। সেদিন ঘোর অমাবস্যা। রাজা জানতে চাইলেন, আজ কি তিথি? তান্ত্রিক জানালেন, আজ পূর্ণিমা। রাজা বললেন, আমাকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখাতে পারেন। মৃদু হাসলেন গোকুলানন্দ। চারদিক তখনই জ্যোৎস্নার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।
আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে তান্ত্রিক বললেন, ঐ যে পূর্ণিমার চাঁদ। দেখুন মহারাজ...।
অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে তান্ত্রিকের সাধনায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন মহারাজ, তৈরি করে দিলেন কালী মন্দির। সেদিন থেকেই আজ পর্যন্ত বর্ধমানের লাকুড্ডির দুর্লভা কালীবাড়িতে নিত্য পুজো চলে আসছে।
যদিও একদল ঐতিহাসিক বলেন, তেজচাঁদ নয়, তখন বর্ধমানের সিংহাসন সামলাচ্ছিলেন বিজয়চাঁদ মহতাব, এবং বিজয়চাঁদের সঙ্গেই এই ঘটনা ঘটেছিল। বিজয়চাঁদই প্রায় দশ বিঘে জমি উপর গড়ে তোলেন একটি মন্দির। পাশেই তিনটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
কথিত আছে, গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পরে দুর্লভ ভট্টাচার্য নামে একজনকে ব্রাহ্মণকে এই মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করেন বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চাঁদ। পরে রাজার অনুগ্রহে দুর্লভা মন্দির এবং সম্পত্তিরও অধিকারী হন তিনি। এই দুর্লভ ভট্টাচার্যের নামেই পরবর্তীতে দেবীর নাম হয় দেবী দুর্লভা। সেই নামেই পুজিত হন দেবী দুর্লভা। আজও এই ভট্টাচার্য পরিবারই দেবীর পুজো করেন।
দেবী মূর্তি এখানে শ্বেত পাথরের। যদিও মূর্তিটি প্রথমে মাটিরই ছিল। পরে অষ্টধাতুতে মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। সেই মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। এরপর মহারাজা বিজয়চাঁদ বেলকাঠের দেবী মূর্তি তৈরি করেন। তারপর থেকেই ঐ বেলকাঠের মূর্তি পূজিত হতে থাকে। এরপর সিমেন্টেরও, মূর্তি করা হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সেই মূর্তিতে ফাটল ধরে, তারপর রাজস্থান থেকে সাড়ে চার ফুট উচ্চতার শ্বেত পাথরের মূর্তি আনা হয়। সেই মূর্তিকেই এখন দেবী দুর্লভা রূপে পুজো করা হয়।