আষাঢ়ের আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে গোটা পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের তীরে এই রাজ্যটির দিকে। হাজার হাজার মানুষ পথে প্রভু জগন্নাথের জন্য। জয় জগন্নাথ ধ্বনিতে মুখর চারপাশ। জনতার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসছে তিনটি রথ। রথে চড়ে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়ি যাচ্ছেন শ্রী জগন্নাথদেব। রথ উৎসবের পুণ্য তিথিতে জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
প্রথমেই দেখা যায় বড় ভাই বলভদ্রের রথ চোদ্দ চাকার তালধ্বজ। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল।
সামান্য দূরে বোন সুভদ্রার রথ ১২ চাকার দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় ৪৩ ফুট। রথের পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা থাকে তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল।
সব শেষে থাকে শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবের ১৬ চাকার রথ নন্দীঘোষ। পতাকায় জয় হনুমানের চিহ্ন তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। রথটির আবরণের রঙ হলুদ।
তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগের রং থাকে লাল।
রথকে কেন্দ্র করেই উৎসব। তাই সব নজর থাকে রথের দিকেই। মেতে ওঠে গোটা দেশ। ভারতীয় জগন্নাথ সংস্কৃতিতে ‘রথ’ শুধু মাত্র ‘রথ’ নয়, রথ আসলে এক দর্শন। রথ মানবদেহেরই প্রতীক। ২০৬ টি হাড় দিয়ে তৈরী হয় মানুষের দেহ। পুরীর রথও নির্মিত হয় ২০৬ টিই কাঠ দিয়ে। সেই কাঠামোয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন রথে অধিষ্ঠিত দেবতা। এই তত্ত্বের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় মানবদেহও রথের মতোই। তার আসল চালক অন্তরে নিহিত পরমাত্মা।
পুরীর রথের চাকার মাধ্যমেও আলাদা দর্শন উপস্থাপিত হয়। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার রথে সব মিলিয়ে মোট ৪২ টি চাকা দেখা যায়। জগন্নাথের নন্দী ঘোষের রথে রয়েছে ১৬ টি চাকা দশ ইন্দ্রিয় আর ছয় রিপুর প্রতিনিধিত্ব করে। বলরামের রথ তালধ্বজের ১৪ টি চাকায় ধরা থাকে ১৪ ভুবনের কথা। আর সুভদ্রার রথ, দর্পদলন বা পদ্মধ্বজের ১২ টি চাকা বোঝায় ১২ মাসই ভজনের সময়।
এই তিনটি রথই সম্পূর্ণভাবে কাঠে তৈরি। তবে যে সে কাঠ হলে চলবে না। ফাসি, ভাউনরা, আসানা মূলত এই তিন ধরনে কাঠের প্রয়োজন হয় রথ নির্মাণে। প্রচলিত লোকবিশ্বাস প্রতি বছর মহানদীর স্রোতে ভেসে আসে জগন্নাথের রথ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠ। তার গায়ে শ্রী বিষ্ণুর চিহ্ন শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম অঙ্কিত থাকে।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকেই রথের নির্মাণ শুরু হয়ে যায়। রথ তৈরি করতে প্রায় ২ মাস সময় লাগে। প্রতি বছর বসন্ত পঞ্চমীর দিনে দশপল্লার জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করা শুরু হয়। শোনা যায় পুরীর রথের নির্মাণে ১,১০০ বড় কাঠের প্রয়োজন হয়। ১২ ধরনের কাঠ থেকে ৮ ফুটের বিশেষ ৮৬৫ টি গুঁড়ি বেছে নেওয়া হয়।
মহানদীর তীর থেকে কাঠ ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়। এরপর দসাপাল্লা নামে একটি স্থান থেকে একদল বিশেষ কাঠমিস্ত্রি এসে রথ নির্মাণ করে। দসাপাল্লা আগে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এখানকার কাঠের মিস্ত্রিরা অত্যন্ত দক্ষ। রথযাত্রার শুরুর সময় থেকেই দসাপাল্লার কাঠমিস্ত্রিরাই রথ নির্মাণ করেন।
কোনওরকম আধুনিক সরঞ্জাম, কৌশল ছাড়াই রথ নির্মাণ করা হয়। শোনা যায়, রথ নির্মাণের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য মাপগুলো হাতের মাপে নেওয়া হয়। পেরেক, নাট বল্টু, বা ধাতব কিছুরই ব্যবহার চলে না। প্রায় ১৪০০ কর্মী নিযুক্ত থাকেন রথ নির্মাণে। রথের কারিগররা সকলেই বংশপরম্পরায় প্রভু জগন্নাথের রথ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
রথের ছাউনি তৈরি করতে ১,২০০ মিটার কাপড় লাগে।
বলভদ্র, সুভদ্রা এবং প্রভু জগন্নাথের রথে ঘোড়াও আছে। আলাদা আলাদা নাম রয়েছে তাদের প্রত্যেকের। জগন্নাথদেবের রথের চারটি ঘোড়ার নাম শঙ্খ, বলহাকা, শ্বেতা, হরিদশ্ব। বলরামের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোড়া, দীর্ঘশর্মা, স্বরনাভ। শুভদ্রার চারটি ঘোড়ার নাম রুচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিত। জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার রথের সারথীর নাম মাতালি, দাঁড়ুকা ও অর্জুন।
রথ যাত্রার সময় রথ চললে শব্দ হয়। এই শব্দেরো হিন্দু ধর্মে ব্যাখ্যা আছে। বেদে বলা হয় 'শব্দই ব্রহ্ম'। রথ চললে চাকার ঘর্ষণে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় বেদ। অর্থাৎ এই শব্দ বেদের মতোই সত্য।
রথ তিনটিতে বলরাম, সুভদ্রা এবং জগন্নাথের মূর্তি নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়। ২০৮ কেজি সোনা দিয়ে সজ্জিত।
রথযাত্রায় রথের রশিতে টান দিতে, রশি স্পর্শ করতে আকুল হয় ভক্তরা। প্রভু জগন্নাথের রথের রশি একবার ছুঁয়ে দেখতে কোনও বাধাই তাদের কাছে বাধা নয়। ভক্তদের বিশ্বাস, বাসুকি নাগই নাকি রথের রশি হিসেবে দারুদেবের কাছে নিজেকে উৎসর্গ তাই এই বিশেষ দিনটিতে রথের দড়ি ধরলে বাসুকিনাগের কৃপা লাভ হয়৷ যারা দড়ি ধরার সুযোগ পান না, তারা রথ চলার সময়, চাকার দাগ, ধূলো ছুঁয়ে পুণ্য লাভ করেন।
তিনটি রথের তিনটি দাগ, গঙ্গা , যমুনা , সরস্বতী- এই তিন পবিত্র নদীর সমান। ভক্তরা গঙ্গা , যমুনা , সরস্বতীতে অবগাহনের ফল লাভ করেন ৷