শিব আর পার্বতীর বিয়ের ভারি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়, গল্পও পাওয়া যায়। কিন্তু, লক্ষ্মী ও নারায়ণের বিয়ের কোন ঘটা নেই, গল্পও নেই। পুরাণকার সেদিকে নজরই দেননি একেবারে। শুধুমাত্র লক্ষ্মী যে নারায়ণের স্ত্রী, এটুকু উল্লেখ করেই দায় সেরেছেন তিনি। লক্ষ্মীর জমজমাট জন্ম কাহিনিও নেই। 'বিষ্ণু পুরাণ'-এ ব্যাসদেব একটি শ্লোকেই লক্ষ্মীর জন্মবৃত্তান্ত অন্ত করেছেন:
সেকালে ভৃগু নামে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল, খ্যাতি। এঁদেরই সন্তান লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর দুই ভাই, ধাতা ও বিধাতা। এর বেশি গল্প ব্যাসদেব লক্ষ্মীর আদ্যকথা নিয়ে টানেননি।
লক্ষ্মী তাহলে শিব-পার্বতীর সন্তান বলে পরিচিত হলেন কখন? বেশিদিন আগে নয়, এই ধরুন প্রায় ছশো বছর আগে। আসলে, লক্ষ্মীকে শিব-পার্বতীর পরিবারের একজন করে তুলল বাংলার লোকসমাজ। তারা নতুন গল্প তৈরি করল, গান বানিয়ে ফেলল মুখে মুখে। তারপর তাদের সেই মৌখিক সাহিত্য লিখিত রূপ পেল মঙ্গলকাব্যের যুগে এসে। 'শিবায়ন', 'দুর্গা মঙ্গল' প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যে। বাঙালি জীবনের সঙ্গে শারদ উৎসবের যোগ অচ্ছেদ্য হল। সপরিবারে মা দুর্গার আগমণ বলতে মায়ের সঙ্গে পুত্রকন্যা হিসেবে কার্তিক-গণেশের পাশাপাশি লক্ষ্মী-সরস্বতীরও আগমণের বিধি তৈরি হল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে লক্ষ্মীর প্রকৃত উদ্ভব হল কোন সময়? সময়টা হচ্ছে, বৈদিক যুগ। তখন তাঁর নাম ছিল, 'শ্রী'। তখন থেকেই তিনি ঐশ্বর্যের দেবী। বেদে তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত নেই। বাপমায়ের নামও নেই। পুরাণের যুগে এসে তিনি ভৃগু ও খ্যাতিকে বাপমা হিসেবে পেলেন, নারায়ণকে পেলেন স্বামী হিসেবে। আর পেলেন নতুন নাম, 'লক্ষ্মী'। তাঁর বাস স্বর্গের বৈকুণ্ঠ লোকে। তাঁর জন্যই স্বর্গের যত সম্পদ, যত শ্রী, যত পরাক্রম, যত আনন্দ। কিন্তু, সেই সুখের সুরে একদিন লাগল দুঃখের ছোঁয়া! কীভাবে?
দেবরাজ ইন্দ্র সে-বার অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁর ঐরাবতে চড়ে মহাআনন্দে ফিরছিলেন। রাগি-ঋষি দুর্বাসা তখন একখানা পরিজাতের মালা হাতে নিয়ে সেদিকেই আসছিলেন। ইন্দ্রকে দেখে তাঁর ভাব উথলে উঠল, ইন্দ্রের গলায় বিজয়মালার মতো করে সেই মালা পরিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। কিন্তু, ইন্দ্র হাতির পিঠে, তাঁকে পরাবেন কী করে? কাজেই মালাটি ইন্দ্রের দিকে এমনভাবে ছুঁড়লেন, যাতে সেটি গলার শোভা হয়ে ওঠে। কিন্তু, মালাটি ইন্দ্র অব্দি পৌঁছল না, পড়ল গিয়ে হাতির মাথায়। হাতি বুঝল না সুঝল শুঁড়ে তুলে মালা মাড়িয়ে দিল পায়ে। আর যায় কোথায়! তাই দেখে দুর্বাসার পিত্তি জ্বলে গেল। তাঁর ভাব আসতে যতক্ষণ, জ্বলে উঠতেও ততক্ষণ। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ইন্দ্রের ওপর। দিলেন কষে অভিশাপ। সেই অভিশাপে স্বর্গ লক্ষ্মীহারা হল, লক্ষ্মী গিয়ে লুকোলেন সমুদ্রের নীচে। লক্ষ্মী স্বর্গ ছাড়া হতেই দেবতাদের সৌভাগ্যে কালি পড়ল, অসুরদের আক্রমণে ইন্দ্রের গদি গেল, লড়াইয়ের ক্ষমতা গেল, মনের আনন্দ গেল, প্রাণের সুখ গেল--সব গেল!
তখন দেবতারা ছুটলেন বিষ্ণুর কাছে। ছিরিচাঁদহীন জীবন থেকে বেরোবার পথ জানতে চাইলেন। বিষ্ণু জানালেন যে, লক্ষ্মীকে সমুদ্র থেকে আবাহন করতে হবে। আবাহন করতে হলে সমুদ্র মন্থন করতে হবে। একা দেবতাদের দিয়ে সে কাজ হবে না, জোটাতে হবে অসুরদেরও। দেবতাদের শক্তির সঙ্গে আসুরিক শক্তির মিলন ঘটাতে হবে। মন্থনজাত অমৃতের লোভ দেখিয়ে অসুরদের ডাকা হল। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। মন্দর পর্বতকে মন্থনি করে বাসুকিকে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হল। মন্থনের ফলে ঐরাবত উঠল, ইন্দ্র নিলেন। পারিজাত ফুলের গাছ উঠল, দেবতারা নিলেন। বিষ উঠল, শিব গলায় ধারণ করলেন। লক্ষ্মী উঠে এলেন, বৈকুণ্ঠে গেলেন। দেবতারা আবার সমৃদ্ধ হলেন, স্বর্গলোকে আবার 'শ্রী' ফিরে এলো। অমৃত উঠল, বিষ্ণু হরণ করলেন। অসুরদের কপালে জুটল লাভের বেলায় ঘন্টা। আসলে, বিষ বা অমৃত জাতপদার্থ মাত্র, সমুদ্রমন্থন হল লক্ষ্মীর দ্বিতীয় জন্মের কাহিনি। সেখানে তিনি সাগরকন্যা।