ভুবন-সংসারে মোহময় মায়াজাল ছড়িয়ে ভুবনমোহিনীরূপে দেবলোকে আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী দুর্গা। যদিও চার বেদের মধ্যে প্রাচীনতম 'ঋগ্বেদ'-এ কোন দেবীর উল্লেখ নেই, কারণ, তখনও দেবী-উপাসনার কাল শুরু হয়নি।
বেদের দেবতা রুদ্র পুরাণের যুগে এসে যখন শিবরূপে পূজিত হতে শুরু করলেন, তখন আবির্ভাব হল শিবের শক্তিস্বরূপা দেবী উমা বা দেবী দুর্গার। 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ'-এর চণ্ডী উপাখ্যানে বলা হয়েছে এই দেবীর আবির্ভাব কাহিনি। প্রথমে সে-কথাই আসুন আপনাদের শোনাই :
দৈত্যকন্যা মাহিষমতীর পুত্র মহিষাসুর ঘোর তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করে ত্রিলোক বিজয়ী হওয়ার ও কোন পুরুষের হাতে বধ্য না-হওয়ার বরলাভ করেছিল। মহিষাসুর ভেবেছিল, তার মতো বীরকে পরাজিত করতে পারে এমন স্ত্রীলোক ত্রিলোকে কোনদিন জন্ম নিতেই পারে না। তাই শিবের বরে ঘুরেফিরে তার অমরত্ব নিশ্চিত।--এই ভাবনার বশীভূত হতেই সে একেবারে ত্রিলোকেশ্বর হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল।
ফলত, শিবের বরে বলীয়ান মহিষাসুর অচিরেই স্বর্গ অধিকার করে দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করল। শুরু করল তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার। তখন মহিষাসুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের সঙ্গে দেবতারা এক অমিত শক্তির আধারস্বরূপা দেবীর আবাহন করতে শুরু করলেন, যে দেবী মহিষাসুরকে বোধ করতে পারবেন।
দেবতাদের সম্মিলিত আহ্বানে আবির্ভূতা হলেন দেবী দুর্গা। দেবতাদের দুর্গতির হাত থেকে উদ্ধার করতে আবির্ভাব হল বলে এই দেবী 'দুর্গা' নামে আখ্যাত হলেন। সমস্ত দেবতাদের দেহের জ্যোতিপুঞ্জ সম্মিলিত হয়ে গড়ে উঠেছিল দেবীর অবয়ব। এক একজন দেবতার তেজপুঞ্জ থেকে সৃষ্টি হল তাঁর এক একটি অঙ্গ। দেবী হলেন অমিত তেজময়ী, কিন্তু প্রসন্নবদনা।
দেবী সাকার হবার পর বিষ্ণু-শিব-যম প্রভৃতি দশজন দেবতা দেবীর হাতে তুলে দিলেন তাঁদের প্রিয় অস্ত্রসম্ভার। সেই অস্ত্র ধারণ করতে দেবী প্রকট করলেন তাঁর দশটি হাত। দশটি আয়ুধ ধারণ করে দেবী হলেন 'দশপ্রহরণধারিণী'।
অস্ত্রমালায় সজ্জিত দেবী তারপর সিংহের ওপর অধিষ্ঠান করে ঘোর যুদ্ধে দেবতাদের শত্রু মহিষাসুরকে বধ করলেন, হলেন, 'মহিষাসুরমর্দিনী'।
দেবতাদের দুর্গতি নাশ করে দেবী তখন পেলেন দেবতাদের পূজা। কিন্তু, মর্তের আরাধ্যা দেবী হয়ে উঠতে, মর্ত্যলোকে পূজা পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হল আরও বহুকাল।
'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-অনুসারে মর্ত্যধামে দেবী দুর্গার প্রথম পূজা করেছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
তবে, 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ'-অনুসারে মর্তে দেবীপূজার সূচনা হয়েছিল রাজা সুরথের হাতে। কীভাবে? বলছি :
একসময় রাজা সুরথ তাঁর বীরত্ব ও প্রতাপে সারা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়েছিলেন। কিন্তু, একদিন অমাত্যদের চক্রান্তে রাজ্য-সৈন্য-সম্পদ সব হারালেন। তখন মনের দুঃখে ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য ছেড়ে রাজা হাজির হলেন এক বনে। সেই বনে ছিল মেধা ঋষির আশ্রম।
বনে ঢুকে ঘোড়াটিকে ছেড়ে দিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে শেষে তিনি হাজির হলেন গিয়ে ঋষি মেধার আশ্রমে। ঋষিবর তখন আশ্রমে ছিলেন না। তাই রাজা আশ্রমের উদ্যানে ইতস্তত ঘুরতে লাগলেন।
রাজ্য হারিয়ে বনের মাঝে আশ্রমে এসেও রাজ্যের ভালোমন্দের চিন্তা তাঁর মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছিলেন না তিনি। বরং তা বার বার তাঁর মনকে ভারাক্রান্ত করে অস্থির করে তুলছিল। ঠিক সেইসময়ই রাজা দূরে তাঁরই মতো আর এক দুঃখী মানুষকে বসে থাকতে দেখলেন। তখন তিনি গেলেন তার কাছে। আলাপ করলেন। জানতে পারলেন, লোকটির নাম সমাধি।
সমাধি জাতিতে বেনে। সমস্ত সহায়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাঁর স্ত্রীপুত্রেরা তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সংসারের প্রতি ঘৃণায় মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে তিনিও এই আশ্রমে হাজির হয়েছেন। তবু, সংসারে তাঁর তিতিক্ষা আসেনি। তাই বোধহয় মোহের বশে স্ত্রীপুত্রের ভালোমন্দের কথাই বার বার চিন্তাক্লিষ্ট করে তুলছে তাঁর মনকে।
রাজা সুরথ ও সমাধি যখন একে-অপরকে নিজেদের দুঃখের কথা বলছিলেন, তখন আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন ঋষি মেধা। তিনি এঁদের সমস্ত কথাই শুনতে পেয়েছিলেন। তাই দু'জনকেই বললেন, সব ছেড়েও কোন কিছুই মন ছাড়তে চায় না। আর এটা হয় একমাত্র দেবী মহামায়ার প্রভাবে।
ঋষির কথা শুনে সুরথ ও সমাধি দু'জনেই সচকিত হলেন। তারপর ঋষির চরণ-বন্দনা করে জানতে চাইলেন, কে এই দেবী মহামায়া? কেমন তাঁর মায়া?
তখন মেধা ঋষি তাঁদের শোনালেন দেবী দুর্গার আবির্ভাবের আশ্চর্য কাহিনি। জানালেন, যিনিই দেবী 'মহামায়া', তিনিই 'উমা', তিনিই 'মহিষাসুরমর্দিনী', তিনিই শক্তিস্বরূপা দেবী 'দুর্গা'।
ঋষির মুখে দেবীর মাহাত্ম্যের কথা শুনে দীর্ঘ তপস্যা ও স্তবে দেবীকে পরিতুষ্ট করলেন রাজা সুরথ ও বণিক সমাধি। দেবীর বরে তাঁরা ফিরে পেলেন হারানো রাজ্য, হারানো সংসার।
তখন চৈত্রমাসের ভরা বসন্ত, তখন নব পত্রপুষ্পে ভরে উঠেছে প্রকৃতি, সেই সময় ধরাধামে রাজা সুরথ আয়োজন করলেন দেবীপূজার। এই প্রথম দেবী দুর্গা মানুষের হাতে পূজা পেলেন, ঠাকুরদালানে ঠাঁই পেলেন।
সেই সময় থেকেই বসন্তকালে পূজিতা হয়ে দেবী মহামায়া দুর্গা ভক্তহৃদয়ে আরাধ্যা হলেন 'দেবী বাসন্তী' নামে।